ট্রাস্ট লাইফের সীমাহীন ব্যয়, হুমকিতে গ্রাহকের টাকা

সাঈদ শিপন
সাঈদ শিপন সাঈদ শিপন , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৭:০২ পিএম, ০৫ মার্চ ২০২৩

আইন লঙ্ঘন করে বছরের পর বছর ধরে বিমা গ্রাহকদের টাকা অবৈধভাবে খরচ করছে নতুন প্রজন্মের জীবন বিমা কোম্পানি ট্রাস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স। সেই সঙ্গে প্রতি বছর কোম্পানিটি যে নতুন বিমা পলিসি বিক্রি করছে, তার সিংহভাগই হয়ে যাচ্ছে তামাদি। এতে দুর্বল হয়ে পড়ছে কোম্পানিটির আর্থিক অবস্থা। ফলে ভবিষ্যতে এই জীবন বিমা কোম্পানিটি গ্রাহকদের দাবির টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হতে পারে বলে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) তদন্তে বেরিয়ে এসেছে এমন তথ্য।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত করে আইডিআরএ। ‘মাত্রাতিরিক্ত কমিশন ও প্রশাসনিক ব্যয় এবং অন্যান্য অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে ভবিষ্যতে গ্রাহকের বিমা দাবি পরিশোধে ব্যর্থ হতে পারে’ এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ২৪ জুলাই ১৩টি বিমা কোম্পানির আর্থিক সক্ষমতা তদন্তের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে আইডিআরএকে নির্দেশ দেওয়া হয়।

এরপর একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করে বিমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা। সম্প্রতি ট্রাস্ট ইসলামী লাইফের বিষয়ে করা তদন্ত নিয়ে প্রতিবেদন দাখিল করেছে আইডিআরএ’র তদন্ত দল। তদন্তে ট্রাস্ট লাইফের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয়, পলিসি তামাদির উচ্চ হার, দ্বিতীয় বর্ষ নবায়ন কম হওয়া, কোম্পানির নগদ আন্তঃপ্রবাহ কম থাকাসহ বেশ কিছু অনিয়মের চিত্র উঠে এসেছে।

আরও পড়ুন: টিকে থাকার লড়াইয়ে বেশিরভাগ নতুন জীবন বিমা কোম্পানি 

তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, ট্রাস্ট ইসলামী লাইফ প্রতিবছর যে প্রিমিয়াম আয় করছে, তার প্রায় পুরোটাই ব্যবস্থাপনা খাতে ব্যয় হয়ে যাচ্ছে। ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত কোম্পানিটির পাঁচ বছরের আর্থিক চিত্র পর্যালোচনা করেছে তদন্ত কমিটি। এই পাঁচ বছরে কোম্পানিটি ব্যবস্থাপনা খাতে আইন লঙ্ঘন করে অবৈধভাবে ব্যয় করেছে ২৫ কোটি ৮১ লাখ টাকা।

একটি জীবন বিমা কোম্পানি ব্যবস্থাপনা খাতে কী পরিমাণ অর্থ খরচ করতে পারবে তা আইন দিয়ে নির্ধারিত। আইন অনুযায়ী, ২০২১ সালে ব্যবস্থাপনা খাতে কোম্পানিটির সর্বোচ্চ ব্যয়ের সীমা ছিল ১৮ কোটি ১৯ লাখ টাকা। কিন্তু কোম্পানিটি খরচ করে ২০ কোটি ৯ লাখ টাকা। অর্থাৎ আইন লঙ্ঘন করে এ খাতে অবৈধ খরচ হয়েছে ১ কোটি ৯০ লাখ টাকা।

আগের বছর ২০২০ সালে এ খাতের সর্বোচ্চ ব্যয়ের সীমা ছিল ১৬ কোটি ১৯ লাখ টাকা। কিন্তু কোম্পানিটি খরচ করে ২২ কোটি ১৬ লাখ টাকা। সীমার অতিরিক্ত ব্যয় হয় ৫ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। ২০১৯ সালে আইন লঙ্ঘন করে খরচ করা হয় ৬ কোটি ১৯ লাখ টাকা। আইন অনুযায়ী ওই বছরে ব্যবস্থাপনা খাতে সর্বোচ্চ ব্যয়ের সীমা ছিল ১৬ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। কিন্তু কোম্পানিটি খরচ করে ২২ কোটি ৬৪ লাখ টাকা।

একইভাবে অতিরিক্ত ৬ কোটি ৬৭ লাখ টাকা এবং ২০১৭ সালে অতিরিক্ত খরচ করা হয় ৫ কোটি ৮ লাখ টাকা।

আরও পড়ুন: বিমা কোম্পানিগুলোর শতকোটি টাকার ব্যবসা হাতছাড়া 

শুধু এই পাঁচ বছরে নয়, ব্যবসা শুরুর পর থেকেই কোম্পানিটি এভাবে মাত্রাতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করেছে। জাগো নিউজের অনুসন্ধানে জানা গেছে, ব্যবসা শুরুর প্রথম বছর ২০১৪ সালে কোম্পানিটি বিমা পলিসি বিক্রি করে প্রিমিয়াম আয় করে ১১ কোটি ৩০ লাখ টাকা। এর বিপরীতে ব্যয় করে ১৫ কোটি ৬৪ লাখ টাকা।

পরের বছর ২০১৫ সালে প্রিমিয়াম বাবদ আয় হয় ১৬ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। বিপরীতে ব্যয় হয় ১৭ কোটি ১৪ লাখ টাকা। একইভাবে ২০১৬ সালে ২০ কোটি ৭ লাখ টাকা আয়ের বিপরীতে ব্যয় করে ২১ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। অর্থাৎ ব্যবসা শুরুর কয়েক বছর প্রতিষ্ঠানটি যে আয় করে তারচেয়ে ব্যয় করে বেশি অর্থ।

এদিকে আইডিআরএ’র তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, প্রতিবছর কোম্পানিটির সিংহভাগ পলিসি তামাদি বা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ২০২১ সালে কোম্পানিটির মোট বিমা পলিসি ছিল ১১ হাজার ৮১১টি। বছরটিতে পলিসি তামাদি হয় ৭ হাজার ৭৪৩টি। এতে সচল পলিসির সংখ্যা দাঁড়ায় ৪ হাজার ৬৮টি। বছরটিতে তামাদি পলিসির হার ৬৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ।

আগের বছর (২০২০ সাল) তামাদি পলিসির হার ছিল ৮২ দশমিক ২১ শতাংশ। বছরটিতে মোট বিমা পলিসি ছিল ১২ হাজার ৭২২টি। এর মধ্যে ১০ হাজার ৪৫৯টি পলিসি তামাদি হয়ে যায়। ফলে সচল পলিসির সংখ্যা দাঁড়ায় ২ হাজার ২৬৩টি। ২০১৯ সালে পলিসি তামাদির হার ছিল ৮৫ দশমিক ১৫ শতাংশ। বছরটিতে মোট বিমা পলিসি ছিল ১০ হাজার ৮২টি। এর মধ্যে ৮ হাজার ৫৮৫টি তামাদি হয়ে যায়। ফলে চলমান পলিসির সংখ্যা দাঁড়ায় ১ হাজার ৪৯৭টিতে।

আরও পড়ুন: বিমা করার আগে যেসব বিষয় জানা জরুরি 

একইভাবে ২০১৮ সালে কোম্পানিটিতে তামাদি পলিসির সংখ্যা দাঁড়ায় ৭ হাজার ১৭৭টি। এ বছর মোট বিমা পলিসি ছিল ১০ হাজার ৬৭টি। ফলে বছর শেষে সচল পলিসির সংখ্যা দাঁড়ায় ২ হাজার ৮৯০টি। আর তামাদি পলিসির হার দাঁড়ায় ৭১ দশমিক ২৯ শতাংশ। ২০১৭ সালে পলিসি তামাদির হার ছিল ৭৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ। বছরটিতে ৯ হাজার ১৪৫টি বিমা পলিসির বিপরীতে তামাদি পলিসি দাঁড়ায় ৭ হাজার ৮৬টি। এতে সচল পলিসি থাকে ২ হাজার ৫৯টি।

এভাবে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ পলিসি তামাদি হওয়ায় কোম্পানিটির নবায়ন প্রিমিয়াম আয়েও ধস নেমেছে। প্রতিবছর কোম্পানিটি নতুন বিমা পলিসি বিক্রি করে যে প্রিমিয়াম আয় করছে, পরের বছরের তার সিংহভাগ আদায় হচ্ছে না। ২০২১ সালে কোম্পানিটির দ্বিতীয় বর্ষ নবায়নের শতকরা হার দাঁড়ায় ৩০ দশমিক ৯৪ শতাংশ। ২০২০ সালে দ্বিতীয় বর্ষ নবায়ন প্রিমিয়াম আদায়ের হার ছিল ২৭ দশমিক ২৭ শতাংশ। তার আগে ২০১৯ সালে ২১ দশমিক ৮১ শতাংশ এবং ২০১৮ সালে ২৫ দশমিক ৮২ শতাংশ আদায় হয়। অর্থাৎ প্রতি বছর কোম্পানিটি নতুন যে পলিসি বিক্রি করছে, পরের বছরেই তার ৭০ শতাংশের বেশি আর আদায় হচ্ছে না।

ট্রাস্ট ইসলামী লাইফের আর্থিক চিত্র পর্যালোচনা করে আইডিআরএ’র তদন্ত দল অভিমত দিয়েছে, দ্বিতীয় বর্ষ প্রিমিয়াম নবায়ন হার, অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয়, পলিসি তামাদি হওয়ার হার এবং প্রিমিয়াম সংগ্রহের ব্যয় কোম্পানির আর্থিক ভিত্তিকে দুর্বল করে রেখেছে। কোম্পানির নগদ আন্তঃপ্রবাহ কম থাকায় ভবিষ্যতে ট্রাস্ট লাইফ গ্রাহকদের উত্থাপিত বিমা দাবি পরিশোধে ব্যর্থ হতে পারে। আবার পাঁচ বছরের মধ্যে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত না হয়ে কোম্পানি অনুমোদনের শর্ত ভঙ্গ করেছে।

তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশে বলা হয়েছে, অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয়, পলিসি তামাদির উচ্চ হার এবং দ্বিতীয় বর্ষ নবায়ন কম হওয়ায় বিমা আইন ২০১০ অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। সেই সঙ্গে প্রকৃত বিমা পলিসি ইস্যুর ক্ষেত্রে জোর দেওয়া, কমিশন ব্যয় হ্রাস করা, পলিসি তামাদি হওয়া কমানো এবং কোম্পানির সম্পদ বিনিয়োগ বিধিমালা অনুযায়ী বিনিয়োগ করার নির্দেশ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। পাশাপাশি কোম্পানির সার্বিক আর্থিক অবস্থার প্রকৃত চিত্র বিশেষ নিরীক্ষার মাধ্যমে চিহ্নিত করার সুপারিশ করেছে আইডিআরএ’র তদন্ত দল।

আরও পড়ুন: অনিয়মে জড়াচ্ছে পদ্মা লাইফ, ঠিকমতো পরিশোধ করছে না বিমা দাবি 

যোগাযোগ করা হলে ট্রাস্ট ইসলামী লাইফের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই। কারণ এই প্রতিবেদন আমাদের কাছে পাঠানো হয়নি।

তিনি বলেন, গত তিন বছরে আমাদের কোম্পানির লাইফ ফান্ড বৃদ্ধি পেয়েছে। সম্পদ বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের সব ইন্ডিকেটর গ্রিন জোনে। আগামী পাঁচ বছরে আমাদের যে টাকা ফেরত দিতে হবে, তার ব্যবস্থা এখন থেকেই করে রাখা হয়েছে। আমাদের পর্যাপ্ত ফান্ড আছে। কোনো তারল্য ঘাটতি নেই।

অন্যদিকে আইডিআরএ’র পরিচালক ও মুখপাত্র মো. জাহাঙ্গীর আলম জাগো নিউজকে বলেন, তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এখন আইন অনুযায়ী যে ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন, সে ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

আইডিআরএ’র চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জয়নুল বারী বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে যে ১৩টি বিমা কোম্পানির বিষয়ে তদন্ত করতে বলা হয়েছিল, সেগুলো তদন্ত করা হয়েছে। এখন আইন অনুযায়ী যে ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া দরকার আমরা নেবো। আমরা আইনের বাইরে যেতে পারবো না। কোম্পানি বন্ধ করে দেওয়া তো কোনো সমাধান নয়। তারপরও প্রয়োজন হলে আমরা সে ধরনের পদক্ষেপও নেবো।

এমএএস/এমএইচআর/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।