এসএওসিএল
লুব অয়েল আমদানির নামে অর্থপাচার, তদন্তে কাস্টমস
#একই ব্যক্তি আমদানি ও রপ্তানিকারক দুই প্রতিষ্ঠানেই পরিচালক
#৩ লাখ ৮৭ হাজার ৮৪৯ ডলার পাচারের অভিযোগ
#যোগসাজশ থাকতে পারে কাস্টমসের লোকদের
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) অংশীদার প্রতিষ্ঠান স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের (এসএওসিএল) বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ থামছেই না। এবার প্রতিষ্ঠানটি নতুন করে আলোচনায় এসেছে লুব অয়েল আমদানির নামে অর্থপাচারের ঘটনায়। আট বছর আগে ২০১৪ সালের এ ঘটনায় সম্প্রতি এসএওসিএলের ৪৭২ কোটি টাকার অনিয়ম তথা আত্মসাৎ তদন্ত করে তিন মাসের মধ্যে ব্যবস্থা নিতে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) নির্দেশ দিয়েছেন উচ্চ আদালত। এরই মধ্যে নতুন করে প্রায় তিন কোটি টাকার বেশি অর্থপাচারের অভিযোগ তদন্ত শুরু করেছে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজ।
অভিযোগ উঠেছে, ঋণপত্র বা এলসির কম মূল্যের লুব অয়েল আমদানি করে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে পুরো টাকা যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিষ্ঠানে পাচার করা হয়েছে। আমদানি ও রপ্তানিকারক উভয় প্রতিষ্ঠানেই পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন হারুন আল রশিদ নামের একই ব্যক্তি। তবে মুদ্রাপাচারের অভিযোগ অস্বীকার করে এসএওসিএল বলছে, রাজস্ব কম দেওয়ার জন্যই আন্ডার ইনভয়েসিং করে পণ্য খালাস নেওয়া হয়েছিল।
আরও পড়ুন: এসএওসিএলে কোটি কোটি টাকা তছরুপ, উদ্ধারে উদাসীন কর্তৃপক্ষ
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসএওসিএলে বিপিসির মালিকানা রয়েছে ৫০ শতাংশ। বাকি ৫০ শতাংশের মালিক এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানি নামে প্রতিষ্ঠানটির দুই পরিচালক মঈন উদ্দিন আহমেদ এবং মিশু মিনহাজ। তাদের একজন নিয়মিতভাবে এসএওসিএলের ম্যানেজমেন্ট অ্যাডভাইজারি কমিটির (ম্যাক) প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মিশু মিনহাজকে এসএওসিএলের পরিচালক করা হয় ২০১৩ সালের ৩ জানুয়ারি। ২০১৩ সালের ২ জুলাই রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিতেও (আরজেএসসি) জমা দেওয়া তালিকায় তাকে এসএওসিএলের পরিচালক হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এর আগে মঈন উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে এশিয়াটিক অয়েলের পক্ষে এসএওসিএলের পরিচালক ছিলেন হারুন আল রশিদ নামের এক ব্যক্তি।
কিন্তু হারুন আল রশিদকে একই সময়ের পরিচালক দেখিয়ে মেসার্স ক্যাল ট্রান্সপ্যাক এশিয়াটিক এলএলসি নামে আমেরিকান প্রতিষ্ঠান থেকে লুব অয়েল আমদানির জন্য আইএফআইসি ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখায় ঋণপত্র (এলসি) খুলে এসএওসিএল। ২০১৩ সালের ১৭ আগস্ট এলসি খোলার জন্য এসএওসিএলের পক্ষে আইএফআইসি ব্যাংকে দেওয়া চিঠিতে দেখা যায়, পরিচালক হিসেবে মঈন উদ্দিন আহমেদ ও হারুন আল রশিদ চিঠিতে সই করেছেন। পরবর্তীকালে ২০১৪ সালের ৪ মার্চ আইএফআইসি ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখায় ৫ লাখ ৬৪ হাজার ৯২৭ ডলার ১৬ সেন্ট মূল্যমানের ঋণপত্রটি (০৮০১১৪০১৩৭১৭) খোলা হয়, যা ওই সময়ে বাংলাদেশি টাকায় (প্রতি ডলার ৭৮ টাকা ৫ পয়সা হিসাবে) ৪ কোটি ৪০ লাখ ৯২ হাজার ৫৬৪ টাকা ৮৪ পয়সা প্রায়।
আরও পড়ুন: বিপিসিতে ৪৭২ কোটি টাকার অনিয়ম, ব্যাখ্যা চাইলেন হাইকোর্ট
সম্প্রতি চট্টগ্রাম কাস্টমসে দাখিল করা এক অভিযোগে দেখা যায়, এসএওসিএলের পক্ষে ওই এলসির কাগজপত্রে পরিচালক হিসেবে সই করেন হারুন আল রশিদ। অন্যদিকে যে প্রতিষ্ঠান থেকে লুব অয়েল কেনা হয়েছে সেই মেসার্স ক্যাল ট্রান্সপ্যাক এশিয়াটিক এলএলসির পরিচালকও হারুন আল রশিদ। তিনি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন।
অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, ৫ লাখ ৬৪ হাজার ৯২৭ ডলার ১৬ সেন্ট ব্যাংকটি চ্যানেলে পরিশোধ করা হলেও মূলত লুব আমদানি করা হয়েছিল ১ লাখ ৭৭ হাজার ৭৭ ডলার ৫৩ সেন্ট মূল্যমানের। বাকি ৩ লাখ ৮৭ হাজার ৮৪৯ ডলার ৬২ সেন্ট মূল্যমান হিসেবে বাংলাদেশি টাকায় ৩ কোটি ২ লাখ ৭১ হাজার ৬৬৩ টাকা ৬২ পয়সা পাচার করা হয়েছিল। ওই চালানের লুব অয়েল খালাসের দায়িত্বে ছিল চট্টগ্রামের সদরঘাট এলাকার সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠান এম আই চৌধুরী অ্যান্ড কোং (চিটিজি) লিমিটেড।
এক পর্যায়ে অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্তে নামে চট্টগ্রাম কাস্টমস। তদন্তে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ জানতে পারে আইএফআইসি ব্যাংকের ০৮০১১৪০১৩৭১৭ নম্বর এলসির বিপরীতে ২০১৪ সালের ১৪ জুন বিল অব এন্ট্রির অনুকূলে (সি-৪৬১৯০) নেট ১ লাখ ১৫ হাজার ৯৮২ কেজি ১৭০ গ্রাম লুব্রিকেটিং অয়েল আমদানি হয়েছে। বিল অব এন্ট্রি অনুযায়ী, আমদানি করা চালানের ইনভয়েস মূল্য ছিল ১ লাখ ৭৭ হাজার ৭৭ ডলার ৫৩ সেন্ট। এক্ষেত্রে ৩ লাখ ৮৭ হাজার ৮৪৯ ডলার ৬২ সেন্ট মূল্যের কোনো পণ্য আমদানির তথ্য কাস্টমসের এসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমে পায়নি কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। পরবর্তীকালে বিষয়টি জানতে আইএফআইসি ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখায় চিঠি দেয় কাস্টমস। ওই চিঠির উত্তরে ০৮০১১৪০১৩৭১৭ নম্বর এলসির বিপরীতে পুরো অর্থই রপ্তানিকারকের ব্যাংকে ট্রান্সফার করে দেওয়ার তথ্য জানায় ব্যাংকটি। এরপর গত ৩১ জানুয়ারি এসএওসিএলে চিঠি দেয় কাস্টমস।
আরও পড়ুন: এশিয়াটিক অয়েলে ব্যাপক অনিয়ম, অনুসন্ধান করবে দুদক
চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজের কমিশনার মোহাম্মদ ফাইজুর রহমান স্বাক্ষরিত দাপ্তরিক ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, আইএফআইসি ব্যাংকের ০৮০১১৪০১৩৭১৭ নম্বর এলসির বিপরীতে কাস্টমসের এসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমে সি-৪৬১১৯০ বিল অব এন্ট্রি ছাড়া অন্য কোনো বিল অব এন্ট্রির তথ্য পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে ১৫ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টায় লিখিত বক্তব্যসহ শুনানিতে উপস্থিত থাকার অনুরোধ করা হয় ওই চিঠিতে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থপাচারের অভিযোগ তদন্তের বিষয়টি উল্লেখ করে চট্টগ্রাম কাস্টমসের সেকশন-২ এর উপ-কমিশনার আরজিনা খাতুন জাগো নিউজকে বলেন, এসএওসিএলের একটি এলসির অনিয়ম নিয়ে আমরা কাজ শুরু করেছি। বিষয়টি তদন্তাধীন।
এ বিষয়ে কথা হলে এসএওসিএলের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিপিসির মহাব্যবস্থাপক (অর্থ) মণি লাল দাশ জাগো নিউজকে বলেন, আমি এসএওসিএলে দায়িত্ব পেয়েছি মাত্র এক বছর হয়েছে। এলসিতে অনিয়মের যে বিষয়টি উঠেছে সেটি ২০১৪ সালের।
আরও পড়ুন: বিজ্ঞপ্তি-পরীক্ষা ছাড়াই নিয়োগ, পদোন্নতিও পাচ্ছেন সেই ১৪ কর্মকর্তা
কাস্টমসের চিঠি পাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, কয়েকদিন আগে আমরা কাস্টমস থেকে একটি চিঠি পেয়েছি। ১৫ ফেব্রুয়ারি আমাদের শুনানিতে ডাকা হয়েছে। আমাদের আইন কর্মকর্তা ওইদিন কাস্টমসের শুনানিতে যাবেন। তারপরও চিঠিটি পাওয়ার পর আমি বিষয়টি জানার চেষ্টা করেছি। ওই এলসির বিপরীতে পুরো মূল্যের লুব অয়েল আমদানি হয়েছে। কিন্তু রাজস্ব কম দেওয়ার জন্য আন্ডার ইনভয়েসিং করা হয়েছিল।
আন্ডার ইনভয়েসিং হলে কমার্শিয়াল ইনভয়েসের বিপরীতে আইএফআইসি ব্যাংক কীভাবে এলসির অর্থ ছাড় করলো- এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিপিসির এ কর্মকর্তা বলেন, তখন ডকুমেন্ট অনলাইনে দেওয়া হতো না। কাস্টমসের লোকজনের যোগসাজশ ছাড়া এ কাজ সম্ভব নয়। কাস্টমসের যোগসাজশেই ব্যাংকে ইনভয়েস মেনুপুলেটেড করে দেওয়া হয়েছিল হয়তো। তা না হলে ব্যাংক এলসির পুরো অর্থ ছাড় দিতে পারতো না। এখন যেহেতু কাস্টমস তদন্ত করছে, ফলে পুরো ঘটনা উঠে আসতে পারে।
এ বিষয়ে জানতে এসএওসিএলের পরিচালক মঈন উদ্দিন আহমেদের মুঠোফোনে বেশ কয়েকবার ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরে মোবাইল ফোন ও হোয়াটসঅ্যাপে খুদে বার্তা দিলেও তিনি কোনো সাড়া দেননি।
ইকবাল হোসেন/এমকেআর/এসএইচএস/এএসএম