ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ‘বাংলা কিউআর কোড’, আগ্রহ নেই ক্রেতা-বিক্রেতার

ইয়াসির আরাফাত রিপন
ইয়াসির আরাফাত রিপন ইয়াসির আরাফাত রিপন
প্রকাশিত: ১১:০৮ এএম, ৩০ জানুয়ারি ২০২৩

ক্যাশলেস সোসাইটি গড়ার লক্ষ্যে সম্প্রতি চালু হয়েছে ‘বাংলা কিউআর কোড’। এজন্য মার্চেন্ট ব্যাংক হিসাব খুলে দেওয়া হয়েছে ফুটপাথের ফল বিক্রেতা, চা দোকানি, মুচি-মুদি ও হোটেলসহ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের। কিউআর কোড স্ক্যান করে মূল্য পরিশোধ করতে পারছেন সব ধরনের গ্রাহক। যে কোনো ব্যাংক বা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের গ্রাহক একই সেবা নিয়ে মূল্য পরিশোধ করতে পারবেন। তবে এতে আগ্রহ নেই ক্রেতা-বিক্রেতা কারোরই।

ফলে মতিঝিল এলাকায় সম্প্রতি ১২শ দোকানে কিউআর কোড সরবরাহ করা হলেও সেগুলোতে লেনদেন নেই তেমন। টাকায় চলছে সব ধরনের লেনদেন। গ্রাহকদের সাড়া না পেয়ে দোকানিরাও কিউআর কোড ফেলে রাখছেন আড়ালে।

যদিও বিক্রেতারা বলছেন, এ পদ্ধতি ভালো। নগদ টাকার ঝামেলা নেই। তবে ক্রেতারা বলছেন, এমন মাধ্যমে মূল্য পরিশোধ করা বাড়তি ঝামেলা।

বিক্রেতারা জানিয়েছেন, হিসাব খুলে দেওয়া দশ দিন হয়েছে। এখনো ক্রেতাদের কিউআর কোডের মাধ্যমে মূল্য পরিশোধে কোনো আগ্রহ নেই। কয়েকটি দোকানে দু-একটি লেদদেন হলেও তা একেবারেই নগণ্য।

আরও পড়ুন: মতিঝিলে মুদি দোকান-হোটেলে লেনদেন কিউআর কোডে

অন্যদিকে মতিঝিল এলাকার ক্ষুদ্র এসব দোকানের ক্রেতারা বলছেন, এভাবে মূল্য পরিশোধ করা বাড়তি ঝামেলা। মোবাইল ফোনে ক্যাশ ইন করবো, দোকানি চেক করে দেখবে, এতে সময়ের প্রয়োজন। আবার দোকানিও বুঝছেন না কিউআর কোড। এ কারণে নগদ টাকাতেই ভরসা রাখছি।

রোববার (২৯ জানুয়ারি) সরেজমিন মতিঝিল এলাকা ঘুরে দেখা গেছে এ চিত্র।

সেখানে কথা হয় জুতা সেলাইয়ের কাজ করা রাকেশ রিশির সঙ্গে। তিনি জানান, কিউআর কোডে মূল্য পরিশোধের ব্যবস্থা করা হয়েছে, এটা ভালো দিক। তবে এ মাধ্যমে লেনদেনের ঝামেলাও আছে। এক হাজারের কম হলে আমি বুথ থেকে ওঠাতে পারবো না। এতে আমার এক হাজার টাকা পড়ে থাকবে, আবার উঠাতে গিয়েও ৯ টাকা কাটবে। আমার কাস্টমারের জন্য দুই মাধ্যমই আছে। নগদ টাকাও দিতে পারেন আবার চাইলে মোবাইলেও দিতে পারেন। দশ জনের নয় জনই বুঝতে পারছেন না এ লেনদেনের ব্যাপার। আগ্রহ নেই তাদের।

আরও পড়ুন: ১০ বছরের মধ্যে ‘ক্যাশলেস সোসাইটি’ গড়ে তোলা সম্ভব

কথা হয় ক্ষুদ্র দোকানি সেফালী দাশের সঙ্গে। তিনি বলেন, কিউআর কোডে আগ্রহ নেই মানুষের। দশ দিন হলেও এখন পর্যন্ত ৩৯৫ টাকা লেনদেন হয়েছে মাত্র। প্রথম দিন অ্যাকাউন্ট খুলে দেওয়ার সময় ব্যাংকের লোকজনই লেনদেন করেছেন। পরে আর তেমন এ মাধ্যমে মূল্য পরিশোধ করেন না কেউ। কোনো গ্রাহকের ৩০ টাকা বিল হলে তিনি ৪০ টাকা মূল্য পরিশোধ করবেন। কারণ আমাকে টাকা উঠাতে গেলে টাকা দিয়ে উঠাতে হবে।

ফল বিক্রেতা শহিদ। কিউআর কোড তিনি ব্যাগের ভেতরেই রেখে দিয়েছেন। তিনি বলেন, কেউ চাইলে বের করবো। এখন পর্যন্ত কেউ এ মাধ্যমে লেনদেন করেনি।

ফুটপাতে কাপড় বিক্রেতা হাবিব বলেন, আমি ক্রেতাদের বলেছি এ মাধ্যমে টাকা পরিশোধ করতে। কিন্তু ৪০ টাকা ৫০ টাকার বিল কেউ মোবাইলে দিতে চায় না। সবাই নগদ টাকা দিতে চায়। আর ফুটপাথের ক্রেতারা বেশি সময় নেয় না, মাল পছন্দ হলে কেনেন না হলে চলে যান। মূল্য পরিশোধের এ মাধ্যমকে অনেকেই বাড়তি ঝামেলা মনে করেন। এ কারণে এখন আর কাউকে সেভাবে বলছি না।

কিউআর কোডে মূল্য পরিশোধ: আগ্রহ নেই কারোই

একই রকম কথা জানান জুতা বিক্রেতা আবুল কালাম আজাদ, কাপড় বিক্রেতা আব্দুল খালেক, খেজুর বিক্রেতা সালমান রাজুসহ আরও অনেকেই।

কথা হয় আনাস আহমেদের সঙ্গে। তিনি ফল কেনার পর কিউআর কোডের মাধ্যমে মূল্য পরিশোধ না করে নগদ টাকা দিলেন বিক্রেতাকে। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, আমি চলতি পথে এটা কিনেছি। বাড়তি সময় নেই দাঁড়ানোর। পছন্দ না হলেও এই ক্রেতার কাছে কিনতাম না।

সুলাইমান নামে অপর এক ক্রেতা বলেন, আমি দাম পরিশোধ করবো কীভাবে, সেটাই বুঝছি না। দোকানিও আমাকে বোঝাতে পারছেন না। আমার কাছে নগদ টাকাই আস্থা বেশি।

গত ১৮ জানুয়ারি নগদ লেনদেনবিহীন বাংলাদেশ বা ক্যাশলেস সোসাইটি গড়ার যাত্রা শুরু হয়। রাজধানীর মতিঝিল এলাকায় প্রায় ১২শ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর কাছে বাংলা কিউআর কোড সরবরাহ করা হয় সেদিন। এ লেনদেনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দেশের ১০টি ব্যাংক এবং ৩টি মোবাইল ব্যাংকিং কোম্পানি। পরবর্তী সময়ে দেশের বিভিন্ন জেলা শহরে যুক্ত হবে এ সেবা, পরিধি বাড়বে ব্যাংকের সংখ্যারও।

সেদিন বাংলাদেশ ব্যাংকের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ক্যাশলেস বা নগদ টাকার ব্যবহার কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অ্যাপে বাংলা কিউআর কোডের মাধ্যমে সব ব্যাংকের গ্রাহক পণ্যের মূল্য পরিশোধ করতে পারবেন। এক্ষেত্রে যে কোনো ব্যাংকের অ্যাপ থাকলেই চলবে। গ্রাহকদের ব্যাংকের অ্যাপ বা মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের অ্যাপ দিয়ে পণ্য কেনাবেচায় উদ্বুদ্ধ করতেই এমন উদ্যোগ। বাংলা কিউআর কোডের মাধ্যমে মতিঝিল এলাকায় মুদি দোকান, চা দোকান, হোটেল ও ভাসমান বিক্রেতাদের কাছে কিউআর কোড সুবিধার মাধ্যমে সেবা বিল পরিশোধ করছেন গ্রাহক।

কিউআর কোডে মূল্য পরিশোধ: আগ্রহ নেই কারোই

এ উদ্যোগে যুক্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে রয়েছে- দি সিটি ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, পূবালী ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, এবি ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক ও ওয়ান ব্যাংক। এছাড়া রয়েছে এমএফএস প্রতিষ্ঠান বিকাশ, এমক্যাশ, রকেট ও কার্ড সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান মাস্টারকার্ড, ভিসা ও অ্যামেক্স।

আরও পড়ুন: কিউআর কোডে মিলবে নগদ টাকা

এ নিয়ে কথা হয় একটি বেসরকারি ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে। তিনি বলেন, আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা মতো কিউআর কোডের মাধ্যমে লেনদেনের ব্যবস্থা করেছি। কিন্তু কোনো সাড়া পাচ্ছি না। দোকানিরও বুঝতে সমস্যা হচ্ছে আবার ক্রেতারও আগ্রহ কম। তবে লেনদেনের ডিজিটাল এ উদ্যোগটি ভালো ছিল সবার জন্য। এতে নগদ টাকার ওপরে চাপ কমে আসবে।

নগদ লেনদেনবিহীন বাংলাদেশ বা ক্যাশলেস সোসাইটি গড়ার যাত্রা শুরুর দশ দিন পেরিয়েও তা জনপ্রিয়তা পাইনি। এ নিয়ে কথা হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হকের সঙ্গে।

তিনি বলেন, ক্যাশলেস সোসাইটি গড়ার যাত্রা শুরু হয়েছে। প্রথম দিকে কোনো মাধ্যমই জনপ্রিয়তা পায় না। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের যাত্রা ২০১১ সালের দিকে হলেও জনপ্রিয়তা আসে ২০১৮ সালের দিকে। এটিও ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হবে।

তিনি বলেন, পণ্য বা সেবামূল্য পরিশোধের ক্ষেত্রে নগদ অর্থ, কার্ড বা চেক ব্যবহার হয়ে থাকে। নগদ অর্থে পরিশোধ ঝুঁকিপূর্ণ, চেক পরিশোধ সময়সাপেক্ষ, জটিল। কিউআর কোড ব্যবহারে ১০ টাকাও ট্রান্সফার করা যায়। এতে বাড়তি টাকা কেউ নিতে পারবে না বা নেওয়া হচ্ছে না। সবাইকে এ নিয়ে আরও সচেতন করতে হবে। সবাই মিলে সচেতন করতে পারলেই এটিও জনপ্রিয়তা পাবে। এখানে আরও ব্যাংককে আমরা সংযুক্ত করতে চায়। আমরা আগামীতে আরও কয়েকটি জেলা শহরকে যুক্ত করবো।

ইএআর/এমএইচআর/জেআইএম

আমার কাস্টমারের জন্য দুই মাধ্যমই আছে। নগদ টাকাও দিতে পারেন আবার চাইলে মোবাইলেও দিতে পারেন। দশ জনের নয় জনই বুঝতে পারছেন না এ লেনদেনের ব্যাপার। আগ্রহ নেই তাদের।

দশ দিন হলেও এখন পর্যন্ত ৩৯৫ টাকা লেনদেন হয়েছে মাত্র। প্রথম দিন অ্যাকাউন্ট খুলে দেওয়ার সময় ব্যাংকের লোকজনই লেনদেন করেছেন। পরে আর তেমন এ মাধ্যমে মূল্য পরিশোধ করেন না কেউ।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।