আদা-রসুন
চাহিদার বিপরীতে উৎপাদনে ধীরগতি, বাড়ছে আমদানিনির্ভরতা
দেশে গত এক দশকের ব্যবধানে আদার চাহিদা পাঁচগুণ, রসুনের তিনগুণ বেড়েছে বলে দাবি ব্যবসায়ীদের। বিপরীতে আদার উৎপাদন থেমে আছে প্রায় এক জায়গায়। রসুনের উৎপাদন কিছুটা বাড়লেও সেটা চাহিদার তুলনায় কম। এতে বাড়ছে আদা-রসুনের আমদানিনির্ভরতা। ডলার সংকটে বাড়ছে আমদানি খরচ। ভোক্তার পকেট থেকেও যাচ্ছে বাড়তি টাকা। মসলজাতীয় পণ্যের উৎপাদন বাড়াতে একটি প্রকল্প নিয়েছে সরকার। সেটা কার্যকর হলে কিছুটা বাড়তে পারে উৎপাদন।
ট্যারিফ কমিশনের সবশেষ তথ্য বলছে, দেশে বছরে তিন লাখ টন আদা ও ছয় লাখ টন রসুনের চাহিদা রয়েছে। এ হিসাব কিছুটা পুরোনো।
ব্যবসায়ীদের দাবি, বর্তমানে দেশে আদার চাহিদা সাড়ে চার লাখ টন এবং রসুনের চাহিদা প্রায় ৯ লাখ টন, যা এক দশক আগের তুলনায় যথাক্রমে পাঁচ ও তিনগুণ ছাড়িয়েছে।
আরও পড়ুন>>রসুন চাষে হতাশ শরীয়তপুরের কৃষকরা
পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব বলছে, ২০১৩-১৪ অর্থবছর থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত দেশে আদার উৎপাদন থমকে রয়েছে। এই এক দশক ধরে উৎপাদন মাত্র ৮০ হাজার টনের সামান্য এদিক-সেদিক করছে মসলাটি। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে দেশে ৭৭ হাজার টন আদা উৎপাদন হয়, যা ২০১৯-২০-এ এসে সর্বোচ্চ ৮৪ হাজারে উঠেছিল। ২০২১-২২-এ কমে আবার ৮২ হাজার টনে নেমেছে।
একই অবস্থা রসুনেরও। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে দেশে সাড়ে তিন লাখ টন রসুন উৎপাদন হয়। এক দশক বাদে এখন উৎপাদন ঠেকেছে ৫ লাখ ১৬ হাজার টনে। ঠিক একই সময়ের ব্যবধানে চাহিদা বেড়েছে তিনগুণের বেশি।
কৃষি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উন্নত জাতের অভাব, দীর্ঘমেয়াদি জীবনকাল ও উঁচু জমির ফসল বলে এ দুই ফসলে খুব বেশি আগ্রহী নয় চাষিরা। আবার উৎপাদন খরচের চেয়ে মসলার বাজারদর কম হওয়াও বড় কারণ।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) ঢাকার বাজারদরের হিসাব অনুযায়ী, গত এক বছরের ব্যবধানে বাজারে আদার দর বেড়েছে ১২২ শতাংশ পর্যন্ত। রসুনের দাম বেড়েছে ১১০ শতাংশ। মাসের ব্যবধানে বেড়েছে যথাক্রমে ৫৩ ও ৬০ শতাংশ।
আরও পড়ুন>>বছরের শুরুতে দাম বেড়েছে আলু-রসুন-আদার, কমেছে আটা-ময়দার
এসব বিষয়ে পুরান ঢাকার শ্যামবাজারকেন্দ্রিক মসলাজাতীয় পণ্যের আমদানিকারক ও বিক্রেতা আবদুল মাজেদ জাগো নিউজকে বলেন, দেশি আদা-রসুনের চেয়ে এখন বিদেশির (আমদানি) চাহিদা বেশি। সে কারণে কখনো আনতে সংকট হলেই দাম বেড়ে যায়। এখনো ডলারের কারণে আমদানি ঘাটতি, বাজারে সে প্রভাব পড়েছে।
তিনি বলেন, দেশি জাতের আদা-রসুন ছোট। সেগুলো এখন মানুষ কম খায়। মানুষ বড় আকারের আদা-চীনা রসুন কিনতে অনেকটা অভ্যস্ত হয়ে গেছে। সেগুলো সহজে কাটা-বাটা যায়। নির্ঞ্ঝাট মনে করে। ফলে এগুলোর চাহিদা থাকবেই। সে কারণে বাজারে দেশি আদা-রসুন দাম পায় না।
ব্যবসায়ীরা জানান, দেশে রসুনের মৌসুম ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি থেকে এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত। আদার মৌসুম ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি- দুই মাস। এ সময় আদা-রসুনের দাম পাইকারি ২০-৩০ টাকার মধ্যে নেমে যায়। যে কারণেও চাষিরা আগ্রহ হারায়।
এ বিষয়ে নীলফামারী সদরের কৃষক ইলিয়াস হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ছয় মাস ধরে এসব মসলা চাষ করে দাম পাই না। আবার চাষের জন্য ভিটার জমি লাগে। অন্য ফসল লাভজনক এখন। সে কারণে কয়েক বছর আদা-রসুন করছি না।
আরও পড়ুন>>পাইকারিতে মসলার দাম স্বাভাবিক, খুচরায় চড়া
যে পরিমাণ অর্থ আদা-রসুন আমদানিতে ব্যয় হচ্ছে এর ৫০ ভাগের এক ভাগ কৃষককে ভর্তুকি সহায়তা দিলে বর্তমান উৎপাদন তিন থেকে চারগুণ বাড়ানো সম্ভব বলে মনে করেন কৃষি অর্থনীতিবিদ জাহাঙ্গীর আলম খান। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, অনাগ্রহের ফসলগুলো প্রয়োজনীয় হয়ে উঠলে সেগুলো চাষের জন্য কৃষককে আগ্রহী করতে হবে, তাদের বাজারদর নিশ্চিত করতে হবে, আমদানির ব্যয় বিবেচনায় প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে।
মসলা চাষ বাড়াতে প্রকল্প
চাষাবাদ বাড়াতে ‘মসলার উন্নত জাত ও প্রযুক্তি সম্প্রসারণ প্রকল্প’ নামে একটি প্রকল্প শুরু হয়েছে গত বছর। মসলার আমদানিনির্ভরতা কমাতে ১১৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে নতুন প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে দুই লাখ ৩৬ হাজার মেট্রিক টন মসলা উৎপাদন বাড়বে। ফলে মসলার আমদানিনির্ভরতা কমবে।
জানা যায়, মসলার উন্নত জাত ও প্রযুক্তি সম্প্রসারণ প্রকল্পটি জুলাই ২০২২ থেকে জুন ২০২৭ মেয়াদে বাস্তবায়ন করা হবে। দেশের ১১০টি উপজেলা ও ২৫টি হর্টিকালচার সেন্টারে এটা বাস্তবায়ন করা হবে। আধুনিক-টেকসই প্রযুক্তি ও উৎপাদন ব্যবস্থাপনা সম্প্রসারণের মাধ্যমে মসলাজাতীয় ফসলের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও বহুমুখীকরণ, মসলা ফসল সংগ্রহোত্তর প্রযুক্তি সম্প্রসারণের মাধ্যমে উৎপাদনোত্তর অপচয় হ্রাস এবং শস্য নিবিড়তা বাড়ানো হবে দুই থেকে পাঁচ শতাংশ। মসলা প্রক্রিয়াজাতকরণ ও মূল্য সংযোজনের মাধ্যমে কৃষকের আয় বৃদ্ধি ও প্রতিকূল পরিবেশে অভিযোজন ক্ষমতাসম্পন্ন জাত প্রচলন করা হবে।
প্রকল্প পরিচালক রাসেল আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, প্রকল্পটি প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। বাজেটের অর্থও একদম কম পাওয়া গেছে। তারপরও প্রদর্শনীর কাজ করে যাচ্ছি। এখন ন্যাশনাল ওয়ার্কশপের ব্যবস্থা হচ্ছে। তবে সময় রয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে এ প্রকল্পের সময়কালে উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, এ প্রকল্পের মাধ্যমে মসলার আবাদ পাঁচ শতাংশ বাড়বে। পাশাপাশি মসলা উৎপাদন বাড়বে দুই লাখ ৩৬ হাজার মেট্রিক টন। মানুষের মসলার ক্যালরির চাহিদা পূরণ হবে। কমবে আমদানিনির্ভরতা।
দেশে আদা-রসুনের উৎপাদন অন্য ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির তুলনায় এত শ্লথ কেন- এমন প্রশ্নের জবাবে রাসেল আহম্মেদ বলেন, সময় বেশি লাগা, অন্য সফলের তুলনায় কম লাভজনক ও উন্নত জাত না থাকায় এসব মসলায় আগ্রহ কম।
যে অবস্থায় আছে অন্য মসলা
শুধু দেশে নয়, মসলার অভ্যন্তরীণ চাহিদার পাশাপাশি বৈশ্বিক চাহিদাও ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। চাহিদার কারণে বাজারমূল্য অন্য ফসলের তুলনায় বেশি। দেশে প্রায় ৫০ ধরনের মসলা ব্যবহার করা হলেও মাত্র সাত ধরনের মসলাজাতীয় ফসল দেশে উৎপাদিত হয়। ফলে অভ্যন্তরীণ চাহিদার অধিকাংশই আমদানির মাধ্যমে পূরণ করা হয়।
বাংলাদেশ মসলা গবেষণা কেন্দ্র এ পর্যন্ত ২২টি মসলাজাতীয় ফসলের ৪৭টি জাত উদ্ভাবন করেছে। এছাড়া, মৃত্তিকা ও পানি ব্যবস্থাপনা, পোকামাকড় ও রোগবালাই ব্যবস্থাপনা, পোস্ট-হারভেস্ট প্রযুক্তিসহ ৬৬টি উন্নত প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হয়েছে। তবে এসব জাত ও প্রযুক্তির মাঠে প্রয়োগের ক্ষেত্রে রয়েছে দুর্বলতা।
সব মিলে দেশে মসলার বাজার প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার। দীর্ঘদিন এসব মসলার চাহিদার বেশিরভাগই পূরণ করা হতো আমদানির মাধ্যমে। বেশ কিছু জাতের দামি মসলা এখনো বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। আবার অবৈধ পথেও ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আসছে নানা ধরনের মসলা। এক্ষেত্রে আমদানির ওপর নির্ভরতা কিছুটা কমানোর সুযোগ থাকলেও বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা।
এ বিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব বলাই কৃষ্ণ হাজরা জাগো নিউজকে বলেন, প্রকল্প চলছে। মসলার জাত সম্প্রসারণে গবেষণা পর্যায়েও আরেকটি প্রকল্প রয়েছে। আমরা এরই মধ্যে রোডম্যাপের মাধ্যমে পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়িয়েছি। আদা-রসুনসহ অন্য সফলের বিষয়েও আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে।
আদা-রসুন উৎপাদনের তথ্যে গরমলি
বিবিএস যে হিসাব দেয়, তার সঙ্গে কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে বড় ফারাক রয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয় উৎপাদনের তথ্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দেশব্যাপী নিযুক্ত কৃষি কর্মকর্তাদের মাধ্যমে সংগ্রহ করে। সেখান থেকে দেওয়া মন্ত্রণালয়ের হিসাবে দেখা গেছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে আদার উৎপাদন হয়েছে এক লাখ ৯১ হাজার টন। অর্থাৎ, দুই সংস্থার (বিবিএস ও কৃষি মন্ত্রণালয়) উৎপাদনের হিসাবের মধ্যে আদার ক্ষেত্রে ফারাক এক লাখ ৯ হাজার টন।
আবার ওই বছর মন্ত্রণালয়ের হিসাবে রসুনের উৎপাদন ৭ লাখ ৭০ হাজার টন, যা বিবিএসের চেয়ে ২ লাখ ৫৪ হাজার টন কম।
এনএইচ/এএসএ/এএসএম