পোশাকখাতে অনেক চ্যালেঞ্জ, সুযোগ সীমাহীন
বিদায়ী বছর ছিল তৈরি পোশাকশিল্পের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। করোনা মহামারি, যুদ্ধ, অর্থনৈতিক সংকট ছিল বছরজুড়ে। এর পরও দেশের রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৪ শতাংশ নেতৃত্ব দেওয়া এ খাত প্রমাণ করেছে যে কোনো পরিস্থিতিতে তারা টিকে থাকতে সক্ষম। রপ্তানি ছুঁয়েছে নতুন মাইলফলক। গ্রিন কারখানায়ও এগিয়েছে বেশ। বাজার আরও বড় করতে কাজ করছেন শিল্প সংশ্লিষ্টরা। তারা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে কাজে লাগাতে চান সুযোগ।
দেশের পোশাক শিল্প উদ্যোক্তারা বলছেন, ‘আমরা একটি নতুন চ্যালেঞ্জের মধ্যে আছি। কারণ, আমাদের অর্থনীতি এখনো মহামারির সংকট থেকে পুরোপুরি পুনরুদ্ধার করতে পারিনি। এরই মধ্যে উন্নত অর্থনীতিগুলো মন্দার দিকে যাচ্ছে। বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক সংকটের কারণে একদিকে জ্বালানি তেল, খাদ্যের কাঁচামালসহ প্রায় সব ধরনের দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়ছে। অন্যদিকে ২০২২ সালে বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতির হার ৮ দশমিক ৮ শতাংশ ছুঁয়ে রেকর্ড করেছে, যা ২০২১ সালে ৪ দশমিক ৭ শতাংশ ছিল। ফলস্বরূপ, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের চাহিদা ও ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। এসবই খুচরা বাজারকে প্রভাবিত করার পাশাপাশি বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইনকে ব্যাহত করছে।’
আরও পড়ুন>>ইউরোপে পোশাক রপ্তানি প্রবৃদ্ধির শীর্ষে বাংলাদেশ
তবে সব প্রতিকূলতার মধ্যেই চ্যালেঞ্জ নিয়ে এ খাত এগোতে সক্ষম বলে মনে করেন তারা। পোশাকখাত সংশ্লিষ্টরা জানান, পোশাকশিল্পের জন্য অনেক চ্যালেঞ্জের সঙ্গে সুযোগও রয়েছে সীমাহীন। পোশাক রপ্তানি ক্রমাগতভাবে বাড়ছে, যা আশা জাগানিয়া। ২০২১-২২ অর্থবছরে পোশাক রপ্তানি ছিল ৪২ দশমিক ৬১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। পোশাক শিল্পের ৪০ বছরের যাত্রাপথে ৪০ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি ছাড়িয়ে যাওয়া শিল্পের ইতিহাসে, যা এক নতুন মাইলফলক।
বাংলাদেশের প্রধান দুটি রপ্তানি বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এই দুই বাজার ছাড়াও অপ্রচলিত বাজারগুলোতে রপ্তনি শেয়ার বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে যা ছিল ৬ দশমিক ৮৭ শতাংশ, ২০২১-২২ অর্থবছরে তা বেড়ে হয়েছে ১৪ দশমিক ৯৬ শতাংশ। উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধিসহ প্রধান অপ্রচলিত বাজারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল জাপান, ভারত ও দক্ষিণ কোরিয়া।
আরও পড়ুন>>ইউরোপে পোশাক রপ্তানি বেড়েছে, কমেছে রাশিয়া-চীনে
২০২১ সালে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) ‘বিশ্ব বাণিজ্য পরিসংখ্যান পর্যালোচনা’ অনুসারে বিশ্ব বাজারে ৬ দশমিক ৩৭ শতাংশ শেয়ার নিয়ে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক হিসেবে মর্যাদা পুনরুদ্ধার করেছে বাংলাদেশ। এরই মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের জন্য শীর্ষ ডেনিম-সোর্সিং দেশে পরিণত হয়েছে। এখন আমরা চীনের বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারকদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় রয়েছি।
অনেক চ্যালেঞ্জ আর বৈশ্বিক সংকটের মধ্যেও সদ্য বিদায়ী বছরটি কেমন ছিল- এ নিয়ে কথা হয় তরুণ শিল্প উদ্যোক্তা ও তৈরি পোশাক শিল্প মালিক এবং রপ্তানিকারক সমিতি বিজিএমইএ’র পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেলের সঙ্গে।
আরও পড়ুন>>দেশে ‘সবুজ কারখানা’ বাড়ছেই, আরও ৩ প্রতিষ্ঠানকে স্বীকৃতিh
তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘২০২২ সাল আমাদের জন্য একটি বিশেষ বছর হয়ে থাকবে। এই বছরই আমরা ৫০ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি ছাড়িয়েছি, যখন আমরা আমাদের স্বাধীনতার ৫০ বছরপূর্তি উদযাপন করছি। আবার একই সময়ে বছরটি বাংলাদেশের অবকাঠামোখাতে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনার জন্য একটি বিশেষ বছর হয়েই থাকবে। পদ্মা সেতু চালু হয়ে জাতীয় অর্থনীতিতে নতুন দিগন্তের সূচনা হয়েছে। আরও অনেক মেগা প্রকল্প সমাপ্তির পথে। এ বছরটি সত্যিই বহু অর্জনের বছর। ২০২২ সালের সবচেয়ে বড় সাফল্যের মধ্যে অন্যতম ছিল বিজিএমইএ-এর উদ্যোগে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ উইক’ উদযাপন।’
অ্যাপারেল ডিপ্লোমেসি
সদ্য বিদায়ী বছরের অ্যাপারেল ডিপ্লোমেসিতে বড় অর্জন রয়েছে দেশের পোশাকখাতের উদ্যোক্তাদের। তারা বিভিন্ন দেশ সফরে নতুন নতুন বাজার সন্ধান করেছেন। লিড গ্রিন কারখানার সংখ্যাও বেড়েছে এবছর সবচেয়ে বেশি। এ নিয়ে বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ নেতারা বলছেন, ২০২২ সালে আমাদের পোশাকশিল্পের সাফল্যের তালিকায় অনেকগুলো অর্জন যুক্ত হয়েছে। সদ্য বিদায়ী বছরে যে বিষয়গুলোতে অগ্রাধিকার দিয়েছি, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ‘অ্যাপারেল ডিপ্লোমেসি’। ২০২২ সালে আমরা ইএসজি অগ্রাধিকার ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০ এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পোশাকশিল্পের রূপকল্প প্রণয়ন করেছি।
লিড গ্রিন কারখানা
আমাদের দেশে রয়েছে ইউএসজিবিসি প্রত্যয়িত সর্বোচ্চ সংখ্যক লিড গ্রিন কারখানা। শুধু সদ্য বিদায়ী বছরই প্রায় ২০টি কারখানা গ্রিন সনদ পয়েছে। বর্তমানে লিড গ্রিন কারখানার সংখ্যা ১৮৩টি, যার মধ্যে ৬০টি প্লাটিনাম রেটেড। আমরা শুধু সাসটেইনেবিলিটির মধ্যে নিজেদের সীমাবদ্ধ থাকিনি। বরং, বিজিএমইএ তার নিজস্ব প্রাঙ্গণে ‘সেন্টার ফর ইনোভেশন, ইফিশিয়েন্সি অ্যান্ড ওএসএইচ’ প্রতিষ্ঠা করেছে। এই কেন্দ্রের মাধ্যমে আমরা দক্ষতা উন্নয়ন এবং ব্যয় অপ্টিমাইজেশনের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন ও সক্ষমতা বাড়ানোর নতুন উপায়ে মনোনিবেশ করবো।
আরও পড়ুন>>যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বেড়েছে পোশাক রপ্তানি
নতুন বছর পোশাকশিল্পের জন্য কেমন হবে- এ নিয়ে বিজিএমইএ পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল জাগো নিউজকে বলেন, শুধু ২০২৩ সালই নয়, পরবর্তী দশকেও আমাদের এই সব রূপান্তর ধরে রাখতে হবে। আমাদের খাতটির মূল সুযোগ রয়েছে পণ্য, ফাইবার, বাজারের বহুমুখীকরণ এবং মূল্য সংযোজনে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের মধ্যে। আমাদের ব্যাকওয়ার্ড ও ফরওয়ার্ড লিঙ্কেজ শিল্পে সক্ষমতা বাড়াতে হবে। একই সময়ে উদ্ভাবন, প্রযুক্তিগত আপগ্রেডেশন, নকশা ও দক্ষতা উন্নয়ন এবং সামগ্রিক ব্যবসায়িক সক্ষমতার ওপর জোরালোভাবে গুরুত্ব দিতে হবে।
তিনি আরও বলেন, একটি নতুন চ্যালেঞ্জের মধ্যে আছি। কারণ, আমাদের অর্থনীতি এখনো মহামারির সংকট থেকে পুরোপুরি পুনরুদ্ধার করতে পারেনি। নতুন বছরে আমাদের অনেক চ্যালেঞ্জ আছে, সুযোগও রয়েছে সীমাহীন। সবুজ রূপান্তরের অগ্রযাত্রায় আমাদের উদ্যোগগুলো ত্বরান্বিত করতে হবে এবং সব কারখানা, বিশেষ করে ছোট ও মাঝারি কারখানাগুলো যেন এই উদ্যোগগুলোতে সম্পৃক্ত হতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। এসএমই প্রতিষ্ঠানগুলো বিশ্ব বাজারে সংযুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে ভার্চ্যুয়াল মার্কেটপ্লেস গেটওয়ে হতে পারে।
ইএআর/এএসএ/জিকেএস