চাপে শেয়ারবাজার, গতি ফেরানোর চেষ্টায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা
ফ্লোর প্রাইস বা সর্বনিম্ন দামে আটকে রয়েছে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত অর্ধেকের বেশি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিট। ক্রেতার অভাবে দিনের পর দিন লেনদেন হচ্ছে না এসব সিকিউরিটিজের। কমে এসেছে লেনদেনও। প্রাতিষ্ঠানিক ও বড় বিনিয়োগকারীদের একটি অংশও বাজারে নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। সরকারবিরোধী একটি চক্রের পাঁয়তারায় এসব বিনিয়োগকারী নিষ্ক্রিয় অবস্থায় রয়েছে বলে অভিযোগ উঠছে। সব কিছু মিলে এক ধরনের চাপের মধ্যে রয়েছে শেয়ারবাজার।
অর্ধেকের বেশি প্রতিষ্ঠান ফ্লোর প্রাইসে আটকে থাকায় ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরাও রয়েছেন বিপদে। ক্রেতা না থাকায় প্রয়োজনের সময়ও শেয়ার বিক্রি করে টাকা তুলতে পারছেন না তারা। প্রতিদিন ফ্লোর প্রাইস লেনদেন শুরুর সঙ্গে সঙ্গে লাখ লাখ শেয়ার ও ইউনিটের বিক্রির আদেশ আসছে। কিন্তু ক্রেতা না পাওয়ায় বিক্রির আদেশ দেওয়া বিনিয়োগকারীরা হতাশ হচ্ছেন প্রতিদিন।
আরও পড়ুন >> ভালো নেই ব্যাংক
এ পরিস্থিতিতে শেয়ারবাজারে গতি ফেরাতে নানামুখী প্রচেষ্টা চালাচ্ছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। এর অংশ হিসেবে ২৬টি বিমা কোম্পানিকে ইক্যুইটির কমপক্ষে ২০ শতাংশ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের যে শর্ত দেওয়া হয়েছে, তার তদারকি বাড়ানো হচ্ছে। একই সঙ্গে যেসব ব্যাংকের বিনিয়োগ আইনিসীমার নিচে রয়েছে, শেয়ারবাজারে তাদের বিনিয়োগ বাড়ানোর চেষ্টা করছে বিএসইসি।
এদিকে শেয়ারবাজারে গতি বাড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে চিঠি দিয়ে কয়েকটি দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএমবিএ)। সব ধরনের বন্ড, ডিবেঞ্চার ও মিউচ্যুয়াল ফান্ড পুঁজিবাজার এক্সপোজারের বাইরে রাখা। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে নিজ সাবসিডিয়ারিকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে একক ঋণসীমা বা সিঙ্গেল বরোয়ার এক্সপোজার রিলাক্স করা।
আরও পড়ুন >> পরিবারের সদস্যদের নিয়ে শেয়ারবাজারে কারসাজি
এছাড়া পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিলে ১ শতাংশ সাধারণ সঞ্চিতি রাখার ব্যবস্থা করা, যা বর্তমানে রয়েছে ২ শতাংশ। সমন্বিত পুঁজিবাজার এক্সপোজার হিসাব রিপোর্টিং স্থগিত করা এবং ভালো প্রতিষ্ঠান বা যারা ভালো ব্যবসা করেন তারা সহজে যে কোনো পরিমাণ ঋণ যেন পায় তার দাবি জানিয়েছে বিএমবিএ।
শেয়ারবাজার পর্যালোচনায় দেখা যায়, চলতি বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক ছিল ৭ হাজার ৮৫ পয়েন্টে। এরপর থেকেই মূলত শেয়ারবাজারে দরপতন শুরু হয়। দফায় দফায় পতন হওয়ায় বর্তমানে ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক নেমে ৬ হাজার ২৪৫ পয়েন্টে। কিছুদিন আগেও নিয়মিত হাজার কোটি টাকার ওপরে লেনদেন হলেও এখন তা পাঁচশ কোটি টাকার নিচে নেমে গেছে। শেষ ১২ কার্যদিবসে পাঁচশ কোটি টাকার ওপরে লেনদেন হয়েছে মাত্র দুদিন। এর মধ্যে সবশেষ ছয় কার্যদিবসে (১ ডিসেম্বর পর্যন্ত) লেনদেন পাঁচশ কোটি টাকার ঘর স্পর্শ করতে পারেনি।
বর্তমানে শেয়ারবাজারে এমন চিত্র বিরাজ করলেও মহামারি করোনার প্রকোপে সারাবিশ্বে যখন এক ধরনের স্থবিরতা নেমে আসে, সে সময়েও অভাবনীয় সাফল্য দেখায় দেশের শেয়ারবাজার। করোনার প্রকোপের মধ্যেই প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান মূল্যসূচক রেকর্ড ৭ হাজার ৩৬৭ পয়েন্টে উঠে আসে। করোনার শুরুর দিকে যা চার হাজার পয়েন্টের নিচে নেমে যায়।
আরও পড়ুন >> বিশ্বমন্দার প্রভাব শেয়ারবাজারে
সে সময় দেশের বাজার বড় ধরনের সাফল্য দেখালেও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বাধার পর প্রায় নয় মাস ধরে মন্দার মধ্যে রয়েছে শেয়ারবাজার। সম্প্রতি শেয়ারবাজারের সংকট বেশ প্রকট হয়ে উঠেছে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা এবং ডলার সংকট ইস্যু সামনে রেখে একটি বিশেষ চক্র পরিকল্পিতভাবে শেয়ারবাজারে অস্থিরতা সৃষ্টির পাঁয়তারা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। সরকারবিরোধী একটি চক্র এই পাঁয়তারায় লিপ্ত হয়েছে। তাদের ভূমিকার কারণেই ডলার সংকটের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বলে ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকেই অভিযোগ আসছে।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান বলেন, এখন যে ডলার সংকট তা কৃত্রিম। দেশের বিরুদ্ধে চক্রান্তের অংশ এই ডলার সংকট। এর সঙ্গে বিএনপি-জামায়াতের সম্পৃক্ততা রয়েছে। অবৈধ ডলার মজুতের দায়ে যে ছয়টি ব্যাংককে জরিমানা করা হয়েছে, তা বিএনপি-জামায়াতের মালিকানাধীন। বিএনপি-জামায়াতের আমলে এসব ব্যাংক অনুমোদন পাওয়া।
আরও পড়ুন >>> ফুরফুরে শেয়ারবাজার, সতর্কতার সঙ্গে বিনিয়োগের পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের
অপরদিকে শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বর্তমানে শেয়ারবাজারে যে সংকট এর মূলে রয়েছে কিছু প্রাতিষ্ঠানিক ও বড় বিনিয়োগকারীর নিষ্ক্রিয় থাকা। এসব বড় বিনিয়োগকারী ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর সঙ্গে সরকারবিরোধী চক্রের যোগাযোগ রয়েছে।
এ বিষয়ে ডিএসইর এক সদস্য বলেন, বিভিন্ন সময়ে শেয়ারবাজারের মাধ্যমে রাজনৈতিক ফায়দা হাতানোর চেষ্টা করা হয়েছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এখন আবার সেই চেষ্টা চালানো হচ্ছে। একটি বিশেষ চক্র নির্বাচনের আগে শেয়ারবাজার ও অর্থনীতিতে অস্থিরতা সৃষ্টির পাঁয়তারা চালাচ্ছে।
তিনি বলেন, আলোচিত একজন বড় বিনিয়োগকারী সম্প্রতি শেয়ারবাজারে অনেকটাই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন। এই বিনিয়োগকারী শেয়ারবাজার থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ তুলে নিয়েছেন। তার সঙ্গে সরকারবিরোধী চক্রের সম্পর্ক রয়েছে। এমনকি তার সঙ্গে লেনদেন করা একাধিক ব্রোকারেজ হাউজ সম্প্রতি লেনদেন কমিয়ে দিয়েছে। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারলে শেয়ারবাজার আবার ঘুরে দাঁড়াবে।
আরও পড়ুন >> আতঙ্ক জেঁকে বসেছে শেয়ারবাজারে, কাজে দেবে কি বিএসইসির দাওয়াই
ডিএসই’র আরেক সদস্য বলেন, বৈশ্বিক অর্থনীতিতে অস্থিরতা দেখা দিলেও বাংলাদেশ বেশ ভালো অবস্থা রয়েছে। তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোও বিনিয়োগকারীদের জন্য ভালো লভ্যাংশ দিচ্ছে। এ পরিস্থিতে শেয়ারবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার কথা নয়। কিন্তু আমরা দেখছি, শেয়ারবাজার দীর্ঘদিন ধরেই মন্দার মধ্যে পড়ে রয়েছে। এ পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না।
তিনি বলেন, যেসব প্রাতিষ্ঠানিক বা ব্যক্তি বড় বিনিয়োগকারীদের বর্তমান পরিস্থিতিতে নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করছে, তাদের বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের ক্ষতিয়ে দেখা উচিত। সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলতে তারা পরিকল্পিতভাবে এসব করতে পারে। কারণ এর আগে ১৯৯৬ এবং ২০১০ সালে শেয়ারবাজারে যে ধস নেমেছিল, সে সময় আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় ছিল। এবারও ক্ষমতায় রয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে শেয়ারবাজারে ধস নামে- এমন একটি বিষয় সাধারণ মানুষের সামনে দাঁড় করানোর চেষ্টা করছে এ চক্র। এমনকি এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজবও ছড়ানো হচ্ছে।
বিশেষ চক্রের পাঁয়তারায় শেয়ারবাজারে মন্দা ও লেনদেন খরা দেখা দেওয়ায় ফ্লোর প্রাইস তুলে দেওয়ার দাবি তুলছেন কেউ কেউ। তবে বিনিয়োগকারীদের বড় অংশই ফ্লোর প্রাইস রাখার পক্ষে। এমনকি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসিও বর্তমান পরিস্থিতিতে ফ্লোর প্রাইস না ওঠানোর পক্ষে রয়েছে।
মো. মিনাজুর রহমান নামে একজন বিনিয়োগকারী জাগো নিউজকে বলেন, অধিকংশ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার দাম এখন ফ্লোর প্রাইসে আটকে রয়েছে। এতে বেশিরভাগ বিনিয়োগকারী তাদের কাছে থাকা শেয়ার বিক্রি করতে পারছেন না। বিক্রি করতে না পারলেও এই ফ্লোর প্রাইস বিনিয়োগকারীদের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করছে। ফ্লোর প্রাইস না থাকলে বিনিয়োগকারীদের পুঁজি বর্তমানে যা আছে, তার অর্ধেকের নিচে চলে যেত। তাই যতদিন বাজার ভালো না হবে ততদিন ফ্লোর প্রইস ওঠানো ঠিক হবে না।
তবে ফ্লোর প্রাইস তুলে দেওয়া উচিত বলে মনে করছেন শেয়ারবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, এখন ৮০ শতাংশ প্রতিষ্ঠান ফ্লোর প্রাইসে আটকে রয়েছে। গুটিকয়েক কোম্পানির শেয়ার এখন লেনদেন হচ্ছে। এর সুযোগ নিচ্ছে কারসাজি চক্র। যেহেতু ৮০ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার দাম ফ্লোর প্রাইসে আটকে রয়েছে, তাই সাধারণ বিনিয়োগকারীরা বাধ্য হচ্ছেন কারসাজির শেয়ারে বিনিয়োগ করতে। ফ্লোর প্রাইস দিয়ে মূলত কারসাজি চক্রকে সহায়তা করা হচ্ছে।
যোাগাযোগ করা হলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম জাগো নিউজকে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়ার বিষয়ে বিএসইসি কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। আমরা মনে করছি ধীরে ধীরে বাজার পরিস্থিতি ভালো হবে। এখন ধীরে ধীরে লেনদেনের গতি বাড়ছে। আশাকরি সামনে বাজারও ভালো হবে।
তিনি বলেন, ২৬টি বিমা কোম্পানিকে ইক্যুইটির ২০ শতাংশ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের শর্ত দেওয়া হয়েছিল। বিমা কোম্পানিগুলো এই বিনিয়োগ করেছে কি না তার তদারকি বাড়ানো হচ্ছে। একই সঙ্গে যেসব ব্যাংকের বিনিয়োগ আইনিসীমার নিচে রয়েছে, তাদের বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য কমিশন প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
এমএএস/এএসএ/জেআইএম