চালের দামে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব কতটা যৌক্তিক?
গত আগস্ট মাসে জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে সরকার। এরপর দফায় দফায় অন্য নিত্যপণ্যের সঙ্গে বেড়েছে চালের দাম। যে মোটা চাল আগে কেজিপ্রতি ৪৬-৪৮ টাকা ছিল, সেটা এখন ৫৬-৫৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সরু ও মাঝারি চালের অবস্থাও একই। যদিও বর্তমানে বাজারে বিক্রি হওয়া অধিকাংশ চালের উৎপাদন জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির আগে। আবার বহন খরচ যদি হিসাব করা হয়, তাহলে দেখা যায় কেজিপ্রতি চালে বাড়তি খরচ হচ্ছে সর্বোচ্চ ৫০ পয়সা। অথচ বাজারে চালের দাম বেড়েছে কয়েকগুণ বেশি। কৃষকের বাড়তি খরচে উৎপাদিত ধান উঠবে আসন্ন মৌসুমে। এ অবস্থায় অতিরিক্ত দাম বাড়ানোর যৌক্তিকতা নিয়ে উঠছে প্রশ্ন।
মিল মালিকদের দাবি, তাদের খরচ ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বেড়েছে। যদিও বিশ্লেষকরা মনে করেন, উৎপাদন খরচ ততটা বাড়েনি যতটা বাজারে চালের দাম বাড়িয়েছেন মিল মালিকরা।
চালকল মালিকরা বলছেন, এ জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব বহুমাত্রিক। প্রথমত, তাদের পণ্য পরিবহন খরচ বেড়েছে। সঙ্গে বেড়েছে উৎপাদন খরচ। বিশেষ করে দেশে চলমান বিদ্যুৎ সংকটের কারণে এমনিতেই এখন শিল্পে ডিজেলের ব্যবহার আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। ডিজেলের ব্যবহার বাড়ায় আগের চেয়ে বেশি খরচ হচ্ছে এ খাতে।
আরও পড়ুন>> চাল নিয়ে সিন্ডিকেটের ‘চালবাজি’
বাংলাদেশ অটো রাইস মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি একেএম খোরশেদ আলম জাগো নিউজকে বলেন, গত আগস্ট থেকে এখনকার সময় বিবেচনা করলে জ্বালানির জন্য আমাদের মিলের খরচ ১৫ শতাংশের মতো বেড়েছে। সঙ্গে বেড়েছে ধান-চাল পরিবহন খরচও। আসন্ন মৌসুমে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। কারণ তখন যে ধান কেনা হবে সেটি বাড়তি সেচ খরচ দিয়ে উৎপাদন করা। তখন ধানের দাম আরও বাড়বে। যে প্রভাব চালের বাজারে পড়বে।
তিনি বলেন, দেশের চালকলগুলো বিভিন্ন প্রান্তিক এলাকায়। চলমান বিদ্যুৎ সংকটের কারণে সেখানে ডিজেল ব্যবহার করে মিল চালাতে হচ্ছে। অন্যদিকে, মিলগুলোতে বিদ্যুতের ইউনিট খরচও বেড়েছে। পাশাপাশি আমরা কৃষিখাতে রিবেট সুবিধা পাচ্ছি না। সবকিছু মিলিয়ে হিসাবে নিলে আমাদের খরচ ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ বেড়েছে। যদিও বাজারে এর চেয়ে চালের দাম বেড়েছে কম হারে।
খোরশেদ আলম বলেন, মিলগুলো অধিকাংশ বিদ্যুতে চলে। কিন্তু নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের অভাবে তেলের নির্ভরতা বেড়েছে। এখন বিদ্যুৎ ছাড়া চালের দাম কমানো কোনোভাবে সম্ভব নয়।
এদিকে ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, তেলের কারণে চাল পরিবহন খরচ বেড়েছে ৮ থেকে ১০ শতাংশ। যদিও সে হিসাবে কিছু গরমিল আছে।
কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর থেকে দূরত্বভেদে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে আসতে পণ্যবোঝাই ট্রাকপ্রতি বাড়তি ভাড়া গুনতে হচ্ছে ২ থেকে ৫ হাজার টাকা। সেখানে প্রতি কেজি চালে ভাড়া বাবদ বাড়তি দিতে হচ্ছে ২৫ থেকে ৫০ পয়সার মতো, যা মূল্যবৃদ্ধির হিসাবের তুলনায় খুবই কম।
আরও পড়ুন>>> হিসাবের খাতায় দেশে চাল ‘উদ্বৃত্ত’, বাস্তবে আমদানিনির্ভর
বাবুবাজার আলেক চাঁন রাইস এজেন্সির স্বত্বাধিকারী আলেক হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, আগে যেখানে কুষ্টিয়া থেকে ১৭ হাজার টাকায় বড় ট্রাক আসতো, সেটা এখন ২০-২২ হাজার টাকা। একটি বড় ট্রাকে ২৫০ বস্তা চাল আসে। বাড়তি ভাড়ার কারণে প্রতি কেজি চালে সর্বোচ্চ ৫০ পয়সা বেশি খরচ হচ্ছে।
তবে চলতি আমন ও আসন্ন অন্য মৌসুমগুলোতে জ্বালানি তেলের দাম সরাসরি প্রভাব ফেলবে চালের দামে। কারণ সেগুলোতে কৃষক পর্যায়ে তেলের বাড়তি দাম গুনতে হচ্ছে। দেশের ৭৫ শতাংশ সেচ কার্যক্রম এখনো ডিজেলনির্ভর। কৃষিকাজে বছরে ৯ লাখ ৭২ হাজার টন ডিজেল ব্যবহার হয়। এতে কৃষকের খরচ হয় ৭ হাজার ৭৭৬ কোটি টাকা। আগস্টের পর নতুন করে প্রতি লিটার ডিজেলের দাম ৩৪ টাকা বাড়িয়েছে সরকার। তাতে এখন ব্যয় হবে ১১ হাজার ৮০ কোটি টাকা। অর্থাৎ, ডিজেলের দাম বাড়ায় কৃষকের ব্যয় বাড়ছে ৩ হাজার ৩০৪ কোটি টাকা।
কৃষি বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশে বছরে জ্বালানি তেলের চাহিদা প্রায় ৬৫ লাখ টন। এর মধ্যে ৭৩ শতাংশই ডিজেল। পরিবহনের পরে সবচেয়ে বেশি ডিজেল ব্যবহার হয় কৃষিখাতে। ডিজেলের দাম সাড়ে ৪২ শতাংশ বাড়ায় বড় প্রভাব পড়বে সার্বিক উৎপাদনে। ব্যয় বাড়ায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কৃষকের মধ্যে। আসন্ন মৌসুমে আরও বাড়তি দাম গুনতে হবে ভোক্তাকে।
একই কথা বলছেন কৃষকরাও। নওগাঁ হোগলবাড়ির কৃষক সুধা মিয়া জাগো নিউজকে বলেন, চলতি আমনে প্রতি বিঘা জমিতে শ্যালো মেশিনে পানির খরচ হয় প্রায় সাড়ে তিন হাজার টাকা। আগে একবার সেচ দেওয়ার জন্য তিনশ টাকা নিতো। আমনে সেটা হয়েছে পাঁচশ টাকা। বিঘায় খরচ পাঁচ হাজারের বেশি।
শুধু উৎপাদন নয়, ডিজেলের জন্য এখন ফসল মাড়াই খরচও বেশি হবে। আসন্ন বোরো মৌসুম পুরোপুরি সেচনির্ভর।
এসব বিষয়ে কৃষি অর্থনীতিবিদ জাহাঙ্গীর আলম খান জাগো নিউজকে বলেন, উৎপাদন খরচ বেড়ে গেলে অনেক কৃষক বাড়তি ব্যয়ে ফসল উৎপাদন করতে পারবেন না। ডিজেলের এ মূল্যবৃদ্ধি নিঃসন্দেহে উৎপাদন বৃদ্ধি ও খাদ্যনিরাত্তার জন্য হুমকি।
আরও পড়ুন>>সংকটে বিশ্ব, খাদ্য নিরাপত্তা ধরে রাখাই চ্যালেঞ্জ
তিনি বলেন, আবার সেই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে ব্যবসায়ীরাও কিছুটা ফায়দা নিচ্ছে সেটাও সত্য। যে যার অবস্থান থেকে মূল্যবৃদ্ধির হিসাব দেখিয়ে সবকিছুর দাম বাড়াচ্ছে। সেগুলো কতটা যৌক্তিক সেটাও দেখার বিষয়।
জাহাঙ্গীর আলম খান আরও বলেন, যেটাই হোক সবকিছুর মাশুল দিতে হচ্ছে সাধারণ ভোক্তাদের। সেজন্য এখন উৎপাদন ঠিক রাখা, কৃষক ও ব্যবসায়ীদের প্রকৃত ব্যয় সাশ্রয়ে নগদ ভর্তুকি সহায়তা দেওয়া প্রয়োজন। কারণ চালের দামের এ অস্বাভাবিক বৃদ্ধি সরকারের জন্যও অস্বস্তির।
এনএইচ/এএসএ/জিকেএস