লোকসানের ঝুঁকি
ডলারের দাম বাড়ায় চাল আমদানিতে অনীহা ব্যবসায়ীদের
বাংলাদেশে ডলার সংকটের শুরু গত বছরের শেষ দিকে। চলতি বছরের শুরুতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে আমদানি ব্যয় বাড়ায় তা প্রকট আকার ধারণ করে। এরপর জ্বালানি তেল, ভোগ্যপণ্য ও জাহাজভাড়া বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হু হু করে বাড়তে থাকে ডলারের দাম। নিম্নমুখী প্রবণতা দেখা দেয় প্রবাসী আয়ে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে দেশের আমদানি খাতেও। লোকসানের ঝুঁকিতে বেশি দামে পণ্য আমদানিতে অনাগ্রহ তৈরি হয় ব্যবসায়ীদের মাঝে।
সরকার দেশের মোট চাহিদার ঘাটতি মেটাতে বিদেশ থেকে চাল আমদানি করে। বেসরকারি পর্যায়েও এ চাল আমদানি হয়। চলতি বছরও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে চাল আমদানির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। চাহিদা পূরণে প্রায় ১০ লাখ ১০ হাজার টন চাল আমদানির কথা রয়েছে। তবে সে পদক্ষেপে বাঁধ সেধেছে অস্থিতিশীল ডলারের বাজার তথা ডলার সংকট। প্রতিবেশী দেশ ভারতেও চালের বাজার খানিকটা ঊর্ধ্বমুখী। ফলে আমদানির পর ব্যবসায়ীরা দেশের বাজারে চাল বিক্রিতে লাভের মুখ দেখতে পারবেন কি না, এ নিয়ে তৈরি হয়েছে সংশয়।
চালের পর্যাপ্ত মজুত নিশ্চিত করতে এবং দামে লাগাম টানতে এরই মধ্যে চাল আমদানিতে শুল্ক কমানো হয়েছে। নতুন আরোপিত শুল্ক অনুযায়ী, চাল আমদানিতে এখন নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ৫ শতাংশ, আগাম কর ৫ শতাংশ এবং অগ্রিম আয়কর ৫ শতাংশসহ মোট ১৫ দশমিক ২৫ শতাংশ শুল্ক কর দিতে হবে। এ নির্দেশনা আটোমেটেড ছাড়া সব ধরনের চাল আমদানির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। একই সঙ্গে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার অনুমোদন নিতে হবে। তবে সুগন্ধি চাল আমদানিতে পূর্ণ শুল্ক (৬২ শতাংশ) দিতে হবে। তবে শুল্ক কমালেও গত চার মাসে দেশে কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ চাল আমদানি হয়নি।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, বর্তমানে যারা কিছু কিছু চাল আমদানি করেছেন তারা বড় অঙ্কের লোকসানে পড়েছেন। আবার বড় আমদানিকারকরা এলসি খুলতে পারলেও ছোট বা মাঝারি আমদানিকারকরা ডলার সংকটে তা পারছেন না। ডলারের বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক না পর্যন্ত আমদানিতে লোকসানের সম্ভাবনাই বেশি। এ অবস্থায় সরকারের অনুমোদন থাকা সত্ত্বেও আমদানির ঝুঁকি নিতে চাইছেন না ব্যবসায়ীরা। আমদানিকারকরা বলছেন, এতে আমদানিতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
জুলাই থেকে অক্টোবর- এ চার মাসে ব্যবসায়ীদের ১০ লাখ ১০ হাজার টন চাল আমদানির অনুমতি দিয়েছিল খাদ্য মন্ত্রণালয়। প্রতিদিন গড়ে ৮ হাজার ৪১৭ টন চাল আমদানির কথা। সে হিসাবে ৪২ দিনে বিদেশ থেকে আসার কথা ৩ লাখ ৫৩ হাজার ৫০০ টন চাল। কিন্তু ব্যবসায়ীরা গত ১ জুলাই থেকে ১১ আগস্ট পর্যন্ত মাত্র ৩৪ হাজার টন চাল আমদানি করেছেন।
বাজার নিয়ন্ত্রণ ও সরবরাহ বাড়াতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে চাল আমদানির অনুমতি দিলেও তাতে অনাগ্রহ দেখাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। এ অনীহার কারণও ব্যাখ্যা করছেন তারা। এ প্রসঙ্গে আমদানিকারক এক ব্যবসায়ী জাগো নিউজকে বলেন, ভারতে সম্প্রতি চালের বাজার ঊর্ধ্বমুখী। একই সময়ে দেশের বাজারে চলছে ডলার সংকট। এ অবস্থায় চাল আমদানি করে লোকসানের ঝুঁকি নিতে চান না ব্যবসায়ীরা।
চাল আমদানিতে ব্যবসায়ীদের অনীহার বিষয়ে কথা হয় নীলফামারী রাইস মিল মালিক সমিতির সভাপতি ও অটো রাইস মিল প্রাইভেট লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী এবং চাল আমদানিকারক শামসুল হকের সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের আবেদনে সাড়া দিয়ে সরকার চাল আমদানির অনুমোদন দিয়েছে। এখন কিছু কিছু আমদানি হচ্ছে, তবে সেটা সামান্য। আমদানি লক্ষ্যমাত্রার ২০ থেকে ২৫ শতাংশ আমদানি হয়েছে। আমরাও চাই আমদানি আরও বাড়ুক।
তিনি বলেন, স্থানীয় বাজারে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও ডলার সংকটের কারণে আমদানি ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। আমদানি করা চাল পলিশ (চাল পরিষ্কার ও ঝকঝকে করার পদ্ধতি) করতে গেলে খরচ আরও বাড়বে। তখন বাজারদরের সঙ্গে আমদানি ব্যয়ের হিসাব মেলানো কঠিন হবে। আমদানি ও পলিশে যে খরচ হবে সে দামে চাল বিক্রি করা যাবে না। এতে ব্যবসায়ীদের লোকসান হবে। ডলারের বাজার স্থিতিশীল হলে আগামীতে হয়তো চাল আমদানি বাড়বে। এছাড়া ভারতে চালের বাজারের ঊর্ধ্বমুখিতা ও ডলারের বিনিময় হারের অস্থিতিশীলতাও দেশের ব্যবসায়ীদের আমদানিতে অনীহার বড় কারণ।
যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) তথ্য মতে, বাংলাদেশে ২০২১-২২ বিপণনবর্ষে (মে-এপ্রিল) এক কোটি ১৬ লাখ ২০ হাজার হেক্টর জমিতে ৩ কোটি ৫৮ লাখ ৫০ হাজার টন চাল উৎপাদন হয়েছে। ২০২২-২৩ মৌসুমে ১ কোটি ১৫ লাখ হেক্টর জমিতে এ উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ কোটি ৫৬ লাখ ৫০ হাজার টন, যা আগের ২০২১-২২ অর্থবছরের তুলনায় প্রায় দুই লাখ টন কম।
তথ্য বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরের বোরো মৌসুমে ৪৭ লাখ হেক্টর জমিতে চাল উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৯৩ লাখ ৫০ হাজার টন। আউশ মৌসুমে ১১ লাখ ২০ হাজার হেক্টর জমিতে ২৭ লাখ টন আর আমন মৌসুমে ৫৮ লাখ হেক্টর জমিতে উৎপাদন হয়েছে এক কোটি ৩৮ লাখ টন চাল। চলতি (২০২২-২৩) অর্থবছরের বোরো মৌসুমে ৪৮ লাখ হেক্টর জমিতে চাল উৎপাদন হয় ১ কোটি ৯৭ লাখ টন।
ইএআর/এমকেআর/এসএইচএস/এমএস