পুষ্টি বিষয়ক প্রশিক্ষণে ৪৮ কোটি ৬৪ লাখের ব্যয়প্রস্তাব নিয়ে প্রশ্ন
চলমান বৈশ্বিক সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে দেশবাসীকে কৃচ্ছ্রসাধনের পরামর্শ দিচ্ছে সরকার। বিদেশ ভ্রমণসহ নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে অনেক সরকারি ব্যয়। এরই মধ্যে নতুন প্রকল্পের আওতায় ৭ হাজার ৪৪৯টি ব্যাচের প্রশিক্ষণের প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৮ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। ‘কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে পুষ্টি ও খাদ্যনিরাপত্তা জোরদারকরণ’ প্রকল্পের আওতায় এ প্রশিক্ষণ ব্যয়ের আবদার করেছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই)। সংস্থাটির এমন প্রশিক্ষণ ব্যয় ও সংখ্যা ‘অযৌক্তিক’ উল্লেখ করে প্রশ্ন তুলেছে পরিকল্পনা কমিশন।
জানা যায়, এরই মধ্যে প্রস্তাবিত প্রকল্প নিয়ে পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্য (সচিব) একেএম ফজলুল হকের সভাপতিত্বে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সভা হয়েছে কমিশনে। এতে প্রকল্পের অযৌক্তিক প্রশিক্ষণ ও কেনাকাটা বাবদ ব্যয় বাদ দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে একেএম ফজলুল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা জোরদারকরণ প্রকল্পের কিছু প্রশিক্ষণ বাদ দেওয়ার সুপারিশ করেছি। কারণ যেসব বিষয়ে কৃষক কোনো না কোনোভাবে প্রশিক্ষণ পেয়েছেন নতুন করে সেগুলো দরকার নেই। কৃষি কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ ব্যয় কমাতে বলেছি। তবে যেসব কৃষি কর্মকর্তা নতুন তারা প্রশিক্ষণ নিতে পারেন স্বল্পপরিসরে। সুপারিশ অনুযায়ী প্রকল্পের ব্যয় কমানো হলেই প্রকল্পটি একনেক সভায় অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে। আমার কাছে প্রকল্পের বেশকিছু খাতের ব্যয় অযৌক্তিক মনে হয়েছে।’
প্রকল্প প্রস্তাবনায় দেখা গেছে— ৬০ ব্যাচ ডিএই’র অফিসার্স প্রশিক্ষণ খাতে ৭৯ লাখ, ৪৯০ ব্যাচ উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা প্রশিক্ষণ খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ কোটি ৯৭ লাখ, ৩ ব্যাচ মাশরুম চাষ, বিপণন ও সম্প্রসারণবিষয়ক আবাসিক কৃষক প্রশিক্ষণ খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১০ লাখ ২০ হাজার টাকা। উপজেলা পর্যায়ে কৃষক প্রশিক্ষণ ধরা হয়েছে ৪ হাজার ৬৫০ ব্যাচ, এ খাতে ব্যয় হবে ৩৫ কোটি ১ লাখ, জেলা পর্যায়ে ৭৭৫ ব্যাচে কৃষক প্রশিক্ষণ ব্যয় ৭ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। নার্সারি ব্যবস্থাপনাবিষয়ক আবাসিক কৃষক প্রশিক্ষণে ৫টি ব্যাচে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৭ লাখ টাকা।
আরও পড়ুন >> সবধরনের অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমাতে হবে: প্রধানমন্ত্রী
প্রকল্পের আওতায় ডিএইখাতে কৃষি প্রযুক্তি মেলা, ইন্টারনেট, কৃষক প্রশিক্ষণ (জেলা পর্যায়), মোটরযান, অফিস সরঞ্জামাদি, ফটোকপিয়ার (সিলেট অঞ্চল ছাড়া), লেজার কালার প্রিন্টার, স্ক্যানার মেশিন বাবদ ব্যয় ধরা হয়েছে। ল্যান্ড ফোন (আবাসিকসহ), পুষ্টিবিষয়ক অ্যাপস তৈরি, সম্প্রসারণ রক্ষণাবেক্ষণ ও সংরক্ষণসহ কিছু খাতের প্রস্তাবিত ব্যয় অযৌক্তিক বলে দাবি করেছে কমিশন। ফলে প্রকল্প থেকে এসব খাত বাদ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে কমিশনের পক্ষ থেকে।
৮৫টি ফটোকপিয়ার মেশিনে ১ কোটি ২৭ লাখ, ৬টি স্ক্যানারে ৪২ হাজার, ১০টি ল্যান্ড ফোন বাবদ ২০ হাজার, মোটরযান বাবদ ২০ লাখ, মুদ্রণ ও বাঁধাই বাবদ ১৫ লাখ, অফিস সরঞ্জামাদি বাবদ ১৫ লাখ টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। এসব ব্যয়ও অযৌক্তিক দাবি করে বাদ দেওয়ার সুপারিশ করেছে কমিশন।
প্রকল্পে প্রচার ও বিজ্ঞাপন, অডিও-ভিডিও, কৃষক গ্রুপ নির্বাচন, উন্নয়ন ও কৃষি উপকরণ রক্ষণাবেক্ষণ, কৃষক প্রশিক্ষণ (উপজেলা পর্যায়) ইত্যাদি খাতের ব্যয় যৌক্তিক পর্যায়ে কমানোর সুপারিশ করা হয়। পাশাপাশি মাশরুম বিষয়ে এককভাবে একটি প্রকল্প একনেকে উপস্থাপিত হওয়ার অপেক্ষায় থাকায় মাশরুম চাষ, বিপণন ও সম্প্রসারণবিষয়ক আবাসিক কৃষক প্রশিক্ষণ খাতটি প্রকল্প থেকে বাদ দিতে বলা হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশ ফলিত পুষ্টি গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (বারটান) খাতে পরিবহন সেবা কেনার ক্ষেত্রে গ্যাস ও জ্বালানি খাতের সংস্থান রাখার প্রয়োজনীয়তা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে।
প্রকল্পের আওতায় ডিএইর অফিসার্স প্রশিক্ষণ, উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের (এসএএও) প্রশিক্ষণ, তাদের উদ্বুদ্ধকরণ ভ্রমণ রাজস্ব ব্যয়ের আওতায় এবং প্রশিক্ষণের পরিমাণ ও ব্যয় কমাতে বলা হয়েছে। জিঙ্ক সমৃদ্ধ ধানের জাত, ভুট্টা উৎপাদন, মিষ্টি আলু উৎপাদন প্রদর্শনীর সংখ্যা ও ব্যয় হ্রাস এবং চীনা বাদাম উৎপাদন, ডাল, মসলা (যেমন পেঁয়াজ, রসুন, মরিচ, কালোজিরা, ক্যাপসিকাম ইত্যাদি) প্রদর্শনী প্রকল্পে থেকে বাদ দেওয়ার বিষয়ে মতামত দিয়েছে কমিশন। প্রকল্পে ডেস্কটপ কম্পিউটার ও প্রিন্টার, ল্যাপটপ, এয়ার কন্ডিশনার, আইপিএস, আসবাবপত্র এবং বারটান খাতে এয়ার কন্ডিশনার খাতের ব্যয় ও সংখ্যা যৌক্তিক পর্যায়ে কমানোর জন্য ডিএই বরাবর সুপারিশ করেছে কমিশন।
সব মিলিয়ে ‘কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে পুষ্টি ও খাদ্যনিরাপত্তা জোরদারকরণ’ প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১৭৮ কোটি ২২ লাখ টাকা। ডিএই ও বারটান প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে। জানুয়ারি ২০২২ থেকে ডিসেম্বর ২০২৬ মেয়াদে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের প্রস্তাবিত মেয়াদ ধরা হয়েছে। দেশের আটটি বিভাগের ৪৯ জেলার ১৫৫ উপজেলা প্রকল্প এলাকা হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে।
আরও পড়ুন >> পুষ্টিকর খাবারের অভাবে বিশ্বে কৃশকায় শিশুর সংখ্যা বাড়ছে: ইউনিসেফ
প্রকল্পের উদ্দেশ্য
পুষ্টিমান ও খাদ্যনিরাপত্তা বিবেচনায় সুনির্দিষ্ট ফসলের উৎপাদনশীলতা ৮ থেকে ১০ শতাংশ বাড়ানো, নিরাপদ ও পুষ্টিসমৃদ্ধ ফসল গ্রাম সৃজনের মাধ্যমে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনে অবদান রাখা, বারটানের আঞ্চলিক কার্যালয়ে সাতটি মিনি নিউট্রিশন ল্যাবরেটরি স্থাপন, সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও সুবিধাভোগী জনগোষ্ঠীকে নিরাপদ কৃষি, পুষ্টি ও আয়বর্ধক কার্যক্রম সম্পর্কে জ্ঞানের পরিধি ও দক্ষতা বাড়ানো।
আরও পড়ুন >> কৃষিতে বিপ্লব ঘটাতে যাচ্ছে নারীদের পুষ্টি বাগান
প্রকল্পের মূল কার্যক্রম
উপজেলা পর্যায়ে ৪ হাজার ৬৫০ ব্যাচ কৃষক প্রশিক্ষণ, জেলা পর্যায়ে ৭৭৫ ব্যাচ কৃষক প্রশিক্ষণ, ৫ ব্যাচ নার্সারি ব্যবস্থাপনাবিষয়ক (আবাসিক), ৩ ব্যাচ মাশরুম চাষ, বিপণন ও সম্প্রসারণবিষয়ক প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। ৬০ ব্যাচ কর্মকর্তা এবং ৪৯০ ব্যাচ এসএএওদের প্রশিক্ষণ খাত ধরা হয়েছে। ১৮ হাজার ৮৫৮টি পুষ্টিসমৃদ্ধ প্রদর্শনী, পানিসাশ্রয়ী ফসলের প্রদর্শনী, ১৫৫টি সবজি, ফল ও মসলা জাতীয় ফসলের মডেল বাগান ও মিশ্র ফল বাগান প্রদর্শনী স্থাপন করা হবে। ২ হাজার ৯৩৪টি কর্নসেলার, ৮ হাজার ৮০২টি হ্যান্ড স্প্রে বোতল, ২ হাজার ৯৩৪ টি ফুট পাম্প ইত্যাদি কেনা হবে। ৯৮ ব্যাচ এসএএওদের উদ্বুদ্ধকরণ ভ্রমণ (স্থানীয়), ১৫৫ ব্যাচ কৃষকদের উদ্বুদ্ধকরণ ভ্রমণ (স্থানীয়) এবং ৫০টি কৃষি প্রযুক্তি মেলা করা হবে।
আরও পড়ুন >> ‘নগরে পুষ্টি কার্যক্রমে সমন্বয় জরুরি’
বারটান খাতের কার্যক্রম
৮৩৭ ব্যাচ কৃষককে পুষ্টিবিষয়ক প্রশিক্ষণ, ৩৭২ ব্যাচ এসএএও, ইমাম, এনজিওকর্মী, স্কুলশিক্ষককে খাদ্য ও পুষ্টিবিষয়ক প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। ৬০ ব্যাচ খাদ্য পুষ্টিবিষয়ক প্রশিক্ষণ (টিওটি), এক ব্যাচ মিনি ল্যাবরেটরির কর্মকর্তা ও টেকনেশিয়ান, ৩০ ব্যাচ খাদ্য পুষ্টিবিষয়ক প্রশিক্ষণ (টিওটি), ১০ ব্যাচ বারটান কর্মকর্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি বিষয়ক, ১২০ ব্যাচ গৃহবধূ, সমাজকর্মী, রন্ধনশিল্পী, সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী ও পুষ্টিবিষয়ক আগ্রহী জনগোষ্ঠীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। ৩৫০টি সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন, ১৫৫টি পুষ্টি গ্রামে পুষ্টিবিষয়ক সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন ও পুষ্টি মেলার আয়োজন করা হবে। নির্মাণ করা হবে নয়টি আদর্শ রন্ধনশালা, সাতটি মিনি নিউট্রিশন ল্যাবরেটরি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. বেনজীর আলম জাগো নিউজকে বলেন, পরিকল্পনা কমিশনে প্রকল্পের প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। প্রকল্পটি নিয়ে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভাও হয়েছে। সভায় যেভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তাই হবে। কোনোটা হয়তো কম হয়েছে কোনোটা বেশি। সবকিছু শতভাগ সঠিক হয়নি। সেজন্য পিইসি সভায় পরিকল্পনা কমিশন, ডিএই কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টরা বসে সিদ্ধান্ত নেই। পরিকল্পনা কমিশন কিছু খাতের ব্যয় কমাতে বলেছে। কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী ব্যয় কমানো হবে।
এমওএস/এমএএইচ/এএসএ/জেআইএম