‘একজন মানুষের দৈনিক ১২০ টাকা মজুরি অমানবিক’

সায়েম সাবু
সায়েম সাবু সায়েম সাবু , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৮:২৮ পিএম, ১৪ আগস্ট ২০২২

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে দিশেহারা চা শ্রমিকরা। সমাজের তৃণমূল পর্যায়ের এই শ্রমিকগোষ্ঠী কোনোভাবেই খাপ খাইয়ে চলতে পারছে না বাজার পরিস্থিতিতে। দৈনিক ১২০ টাকা মজুরি পেয়ে এক প্রকার মানবেতর জীবনযাপন করছেন বলে আন্দোলনে জানিয়েছেন শামিল হওয়া শ্রমিকরা।

সম্প্রতি মজুরি ও অন্যান্য সুবিধার দাবিতে আন্দোলনের ডাক দেন চা শ্রমিকরা। মজুরি বাড়ানো না হলে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘটের ঘোষণাও দিয়েছে এই জনগোষ্ঠী।

চা শ্রমিকদের অধিকার ও আন্দোলন প্রসঙ্গ নিয়ে প্রতিক্রিয়া নেওয়া হয় বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এবং গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকির। মতামত ব্যক্ত করেন শ্রম ও কর্মসংস্থান বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ানও।

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘চা শ্রমিকদের আন্দোলনের সঙ্গে আমাদের নেতাকর্মীরা ওতপ্রোতোভাবে জড়িত। দৈনিক ১২০ টাকা একজন মানুষের মজুরি দেওয়া মানে অমানবিক। তাদের ব্যাপারে মানুষ খুব বেশি জানেও না। অর্থাৎ জানানো হয় না। আমি অবিলম্বে দৈনিক অন্তত ৩শ টাকা মজুরি দেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।

বামপন্থি এই রাজনীতিক বলেন, ‘চা শ্রমিকদের আরও দাবি আছে। বৃষ্টির মধ্যেই তাদের চা পাতা তুলতে হয়। বৃষ্টির সময় কাজ না করলে মজুরি দেওয়া হয় না। তাহলে একটি রেইনকোট তো তাদের অধিকার। এটি দেওয়া হয় না। তাদের বিশ্রামের কোনো জায়গা নেই। বাগানের মাঝে শেড তৈরি করে দিলে প্রচণ্ড রোদে একটু বিশ্রাম নিতে পারে। একজন প্রসূতি মাকে হাসপাতালে নেওয়ার কোনো সুব্যবস্থা নেই। সন্তানদের শিক্ষার সুবিধা দিতে পারে না। একদম ইতর প্রাণীর মতো তাদের মূল্যায়ন করে মালিকপক্ষ।

‘একটি হালের বলদ দেখাশোনা করার জন্যও গৃহস্থ থাকেন। চা শ্রমিকদের হালের বলদের চেয়েও অধম মনে করে মালিকপক্ষ। তাদের দেখাশোনার কোনো গৃহস্থ নেই। চা শ্রমিকদের শ্রমটা শুষে নিয়ে মালিক-রাষ্ট্র মুনাফার হিসাব কষছে। কিন্তু শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই।’

চা শ্রমিকদের আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করে জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘বাংলাদেশে এখন সর্বনিম্ন মজুরি পান চা শ্রমিকরা। আমি বলবো, চা শ্রমিকরা মানবেতর জীবন যাপন করছেন। বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের যে পরিস্থিতি, তাতে একজন শ্রমিকের ১২০ টাকা দৈনিক মজুরি পরিহাস মাত্র। এই টাকা দিয়ে জীবনধারণ একেবারে অসম্ভব এবং কল্পনাও করা যায় না। সরকার দ্রুততম সময়ে জাতীয় মজুরি নীতি ঘোষণা করে এর আওতায় চা শ্রমিকদেরও নিয়ে আসুক।

এই রাজনীতিক বলেন, ‘চা শ্রমিকরা যে বছরের পর বছর ধরে বঞ্চিত হয়ে আসছে, তা সরকারের উদাসীনতার কারণেই। চা একটি রপ্তানিখাত এবং এখান থেকে বৈদেশিক আয় হচ্ছে। মালিকরা চাইবেন একেবারে কমমূল্যে শ্রম পেতে। বিনামূল্যে হলে তাদের জন্য আরও ভালো। কিন্তু সরকার তো সবার। জনগণের চাহিদা পূরণ করবে সরকার। মালিক-শ্রমিকের মধ্যকার দরকষাকষির ভূমিকায় থাকবে সরকার। এই দরকষাকষির জায়গা থেকেই চার বছর আগে গার্মেন্ট শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু চা শ্রমিকদের জন্য সরকার আসলে কোনো ভাবনা করেনি। মূলত মালিকদের সুবিধা দেওয়ার জন্যই সরকার শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে সচেষ্ট থাকে না।’

গার্মেন্ট শ্রমিকরা আন্দোলন করে দাবি আদায় করে নিয়েছেন। চা শ্রমিকরা পারছেন না কেন? জবাবে তিনি বলেন, ‘শ্রমিকরা আন্দোলন করেন না, তা নয়। তারা মাঠে নামেন। কিন্তু সরকার আসলে জনঅধিকারের কোনো বিষয় কর্ণপাত করে না। সরকার তো কারও কাছে জবাবদিহি করার প্রয়োজনবোধ করে না। দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন নেই, মানুষ ভোট দিতে পারে না। জনগণের কাছে তো ভোট চাইতে হয় না সরকারকে।’

‘সরকার উন্নয়ন বলতে কতগুলো স্থাপনা নির্মাণকে বোঝাতে চাইছে। স্বাধীনতার পর মানুষকে এটি বোঝানো হয়েছে সরকারগুলোর পক্ষ থেকে। প্রকৃত উন্নয়ন যে মানুষের জীবন-মানের উন্নয়ন বোঝায়, তা পরিকল্পিতভাবে ভুলিয়ে রেখেছে।’

‘মানুষের মৌলিক অধিকার বাস্তবায়নে সাংবিধানিক কোনো গ্যারান্টি নেই। বাস্তবায়ন না করলে কি হবে, তার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। গবির মানুষের না খেয়ে থাকার অবস্থা। সাধারণ মানুষ প্রয়োজনীয় পুষ্টি পাচ্ছে না। সব জিনিসের সঙ্গে চায়ের দামও বাড়ছে। মালিকের মুনাফা বাড়ছে। রাজস্ব আয় হচ্ছে। কিন্তু চা শ্রমিকের মজুরি বাড়ছে না। সমাজে একটি অন্যায় ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, তার প্রমাণ হচ্ছে চা শ্রমিকদের অধিকার বঞ্চিত রাখা।’ বলেন জোনায়েদ সাকি।

তবে চা শ্রমিকদের দাবির বিষয়ে সরকার শিগগির ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেবে বলে জানিয়েছেন শ্রম ও কর্মসংস্থান বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান। তিনি বলেন, ‘শ্রমিকরা মজুরি বৃদ্ধির যে দাবি জানিয়ে আসছে সে ব্যাপারে সরকার অবগত। আমি বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে খোঁজ-খবর রাখছি। শ্রমিক-মালিকপক্ষকে নিয়ে আগামী ২৩ আগস্ট সভা আহ্বান করেছি। সভায় এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা হবে।’

‘সভায় চা শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি এবং অন্যান্য বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে। বাজার পরিস্থিতি আমরাও বুঝতে পারি। চা শ্রমিকদের সুযোগ-সুবিধা কীভাবে বাড়ানো যায়, তা নিয়ে আমাদের ভাবনা রয়েছে। মজুরি কমশিন রয়েছে। কমিশনকে সম্পৃক্ত করা হচ্ছে।’

প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘আমি শ্রমিক নেতাদের বলেছি, আন্দোলনে যাওয়ার আর দরকার হবে না। ২৩ আগস্টের সভায় ইতিবাচক সিদ্ধান্ত আসবে। গত পরশুদিনও এক নেতাকে এ ব্যাপারে আশ্বস্ত করেছি। এরপরও ধর্মঘট-আন্দোলন ডাকার মানে হয় না। তাদের এই আন্দোলনে অন্য পক্ষ সুবিধা নিতে পারে। এ ব্যাপারেও সতর্ক আছি। সতর্ক থাকতে হবে শ্রমিকদেরও।’

এএসএস/এএসএ/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।