বিদ্যুৎ সংকট
ব্যবহারকারীর অপচয়, রাষ্ট্রের খাতায় চাহিদা
মাস চারেক আগে দেশে শতভাগ বিদ্যুতায়নের ঘোষণা দেয় সরকার। সেই উৎসবের আমেজ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। এরই মধ্যে প্রকট হয় বৈশ্বিক সংকট। পাল্টে যায় অনেককিছু। টাকার অবনমন ও ডলারের দাম ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকায় সংকট ঘনীভূত হয় আরও। কৃচ্ছ্রসাধনের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ডলার বাঁচাতে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশভ্রমণ কমানোসহ বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বিদ্যুৎ ব্যবহারেও আসে বেশকিছু নির্দেশনা। বিদ্যুতের অপচয় রোধের পাশাপাশি শিডিউল লোডশেডিং চলছে। আলোকসজ্জা না করাসহ আরও কিছু নির্দেশনা থাকলেও তা কাজে আসছে না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদ্যুতের চাহিদা মেটানো সরকারের জন্য যেমন বড় চ্যালেঞ্জ তেমনি সব ধরনের গ্রাহক পর্যায়ে অপচয় বন্ধ করাও চ্যালেঞ্জ। সরকারের দায়িত্ব যেমন শতভাগ বিদ্যুতায়ন বাস্তবায়ন করা তেমনি জনগণেরও দায়িত্ব বিদ্যুতের অপচয় না করা।
প্রশ্ন থেকে যায়, দেশে কী পরিমাণ বিদ্যুৎ অপচয় হয়? এর কোনো হিসাব আছে কি? একজন গ্রাহক যদি মাসে এক হাজার টাকার বিদ্যুৎ খরচ করেন তাহলে তিনি এক হাজার টাকাই বিল দেবেন। তবে তার বাস্তবিক প্রয়োজন যদি হয় ৫শ টাকার, তাহলে বাড়তি খরচ করা ৫শ টাকা তিনি দিলেও এর চাপ গিয়ে পড়ে অন্য গ্রাহকের ওপর। খরচটা এক গ্রাহকের ওপর পড়লেও সামগ্রিকভাবে অপচয়ের দায়ভার সবার ওপরেই বর্তায়। সরকারের উৎপাদন সক্ষমতা যতটুকু ততটুকু বিতরণে সমন্বয় করতেই লোডশেডিং করছে। আর সেই লোডশেডিংয়ের ভুক্তভোগী সবাই।
রাজধানীর অভিজাত শপিংমল বা মার্কেটগুলোতে প্রবেশ করলে এখনো চোখে পড়ে নানা রঙের বাতি। প্রায় প্রতিটি শপিংমলেই এসিও চলছে আগের মতোই। রাজধানীর বেশ কয়েকটি শপিংমল ঘুরে দেখা যায়, বাহারি বাতির আলোয় চকচক করছে বিভিন্ন পণ্যের শোরুম। পণ্যের প্রদর্শনীতে কোনো প্রকার ঘাটতি না রাখতে সর্বোচ্চ আলোর ব্যবস্থা রাখা হয়েছে এসব শোরুমে।
বসুন্ধরা শপিংমলে একটি কাপড়ের শোরুমে গিয়ে দেখা যায়, এলইডি লাইটের চোখ ধাঁধানো আলোয় চকচক করছে পুরো শোরুম।
ওই শোরুমের এক বিক্রয়কর্মী বলেন, দৈর্ঘ্যে ৩০ ফুট ও প্রস্থে ২০ ফুটের দোকানটিতে এলইডি লাইট আছে ১৫টিরও বেশি। এছাড়া শোরুমে বাড়তি সৌন্দর্যের জন্য রাখা হয়েছে রঙিন বাতি। গ্রাহক যখন বেশি থাকে তখন সেগুলোও জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।
এত বেশি লাইট কী কারণে জ্বালাতে হয়, এমন প্রশ্ন করলে ওই বিক্রয়কর্মী বলেন, লাইট যত বেশি থাকে, কাস্টমার তত তাড়াতাড়ি কাপড় পছন্দ করেন। চোখের সামনে চকচক করলে একবার দেখেই যেমন কাপড়ের ভালো-খারাপ বোঝা যায়, তেমনি চকচকে আলোয় কাপড় পছন্দও হয় বেশি। এ কারণেই এত বেশি লাইট জ্বালিয়ে রাখা হয়।
একই মার্কেটের ভেতর একটি গয়নার দোকানে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় প্রতি এক ফুট দূরত্বে একটি করে এলইডি লাইট জ্বালিয়ে রাখা হয়েছে। আবার অধিকাংশ গয়নার ওপর আলাদা করে লাইট বসানো।
কেন এত লাইট, প্রশ্ন করলে দোকানের ম্যানেজার বলেন, ‘গয়না তো ভাই! সব জায়গায় সমানভাবে আলো পড়লে চকচক করে। তখন কাস্টমার আসে।’
সংকট মুহূর্তে এসব লাইট কমালে হয় কি না, এমন প্রশ্ন করলে তিনি দাবি করেন, ‘ছোট ছোট লাইট। বিদ্যুৎ বেশি খরচ হয় না।’
বিদ্যুতের চাহিদা সম্পর্কে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকাশ দেওয়ান জাগো নিউজকে বলেন, সরকার থেকে বলা হয়েছে প্রতিদিন এক ঘণ্টা করে লোডশেডিং করতে। কিন্তু আমাদের বেশি করতে হচ্ছে। কারণ, এক ঘণ্টা লোডশেডিং দিলেও আমাদের দেড় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা থাকে। কিন্তু আমরা তারচেয়েও ২শ মেগাওয়াটের মতো কম পাচ্ছি। এ কারণে বাড়তি লোডশেডিং দিতে হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, যদি গ্রাহক অপচয় না করেন তাহলে হয়তো এক ঘণ্টা লোডশেডিং করেই বাকিটুকুতে হয়ে যায়। কিন্তু অপচয়ের কারণে চাহিদা বেড়ে যাচ্ছে। তখন বাধ্য হয়ে লোডশেডিং করতে হচ্ছে।
প্রয়োজনে বিদ্যুৎ খরচ হচ্ছে নাকি অপ্রয়োজনে বা বিদ্যুৎ কতটা অপচয় হচ্ছে এর কোনো হিসাব ডিপিডিসির কাছে আছে কি না, জানতে চাইলে জাগো নিউজকে বিকাশ দেওয়ান বলেন, এটা কোনোভাবেই নির্ণয় করা সম্ভব নয়। যদি মাঠপর্যায়ে গিয়ে জরিপ করা যায়, তাহলে হয়তো শুধু একটি ধারণা পাওয়া যেতে পারে। তাতেও পরিমাণটা নির্দিষ্ট করে বলা যাবে না। তেমন ব্যবস্থা যেহেতু আমাদের এখনো নেই, তাই আমরা বলতেও পারছি না যে ঠিক কী পরিমাণ বিদ্যুৎ অপচয় হচ্ছে। অপচয় কতটুকু হচ্ছে, এটা একমাত্র তিনিই বলতে পারবেন যিনি অপচয় করছেন। তাই প্রত্যেকের নিজের জায়গা থেকে সচেতন হওয়ায় কোনো বিকল্প নেই।
বিষয়টি নিয়ে আলাপ করলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সাবেক ডিন, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এজাজ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, মানুষ যদি নিজে থেকে সচেতন না হয়, তবে এটা কখনোই নির্ণয় করা সম্ভব নয়। তবে নির্ণয় না করা গেলেও অনুমান করা যায়, আমরা যতটুকু খরচ করি তার অন্তত ১০ শতাংশ খরচ করি অপ্রয়োজনে। অর্থাৎ আমরা অপচয় বন্ধ করলে অনায়াসেই ১০ শতাংশ খরচ কমিয়ে আনা যায়। আর যদি আরেকটু সচেতন হই, তবে আরও বাড়বে।
অনেক দেশেই ঘরে দুইটা লাইট থাকলে একটা সাধারণ প্রয়োজনে, অন্যটা জরুরি প্রয়োজনে ব্যবহার করে জানিয়ে তিনি বলেন, কিন্তু আমাদের সে চর্চা নেই বললেই চলে। অনেক স্বর্ণের দোকানে গিয়ে দেখা যায়, তারা চকচক করবে বলে অতিরিক্ত আলো ব্যবহার করে। কিন্তু সেটার তো একটা প্রকৃতি আছে। যতটুকু আলো হলে বোঝা যাবে সেটা স্বর্ণ, ততটুকুই যথেষ্ট। বাড়তি আলো হলেই সেটার মূল্য বেড়ে গেলো না। আমরা যে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ খরচ করছি, সে হিসাব গিয়ে রাষ্ট্রের কাছে জমা হচ্ছে। আমরা রাষ্ট্রের কাছ থেকে টাকার বিনিময়েই কিনছি। কিন্তু আমাদের অপচয় হলেও রাষ্ট্র ধরে নিচ্ছে সেটা আমাদের চাহিদা। সেটা বন্ধ করতে হলে নিজেদেরই সচেতন হতে হবে।
এমআইএস/এমএইচআর/এএসএ/এমএস