নানাবিধ সংকটে ধুঁকছে পদ্মা লাইফ
নানা অনিয়মে জড়িয়ে গ্রাহকদের বিমা দাবির টাকা ঠিকমতো পরিশোধ করতে পারছে না শেয়াবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি পদ্মা ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্স লিমিটেড। ফলে গ্রাহকদের আস্থা হারিয়ে একদিকে কোম্পানির আয় যেমন কমছে, অন্যদিকে খরচের লাগাম টানতে না পারায় অবৈধভাবে গ্রাহকের টাকা ব্যয় করছে কোম্পানিটি। এমন সংকটে কোম্পানিটিকে উদ্ধার করতে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার (সিইও) দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে অন্য একটি বিমা কোম্পানি থেকে বহিষ্কৃত একজনকে।
সম্প্রতি পদ্মা ইসলামী লাইফের পরিচালনা পর্ষদ কোম্পানিটির সিইও হিসেবে হেমায়েত উল্লাহকে নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কোম্পানি পরিচালনায় বিভিন্ন অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, আর্থিক অনিয়ম, বিমা পলিসি গ্রাহক ও বিমাকারীর স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর এবং নিয়মপরিপন্থি কার্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে গত বছর ফারইস্ট ইসলামী লাইফ থেকে হেমায়েত উল্লাহকে বহিষ্কার করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। একই সঙ্গে হেমায়েত উল্লাহকে কোনো বিমা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ না দিতে নির্দেশ দেয় আইডিআরএ। অথচ সংকটে পড়া পদ্মা ইসলামী লাইফের পরিচালনা পর্ষদ তাকেই সিইও করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
কোনো বিমা কোম্পানিতে হেমায়েত উল্লাহকে নিয়োগ না দিতে আইডিআরএ’র নির্দেশনা থাকলেও কেন তাকেই বেছে নেওয়া হচ্ছে এমন প্রশ্নের উত্তরে পদ্মা ইসলামী লাইফের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোরশেদ আলম সিদ্দিক জাগো নিউজকে বলেন, আইডিআরএ চিঠি দেওয়ার পর উনি রিট করে সানফ্লাওয়ার লাইফে উপদেষ্টা হিসেবে ছিলেন।
তিনি বলেন, আমরা আমাদের প্রতিষ্ঠানকে (পদ্মা ইসলামী লাইফ) একটা ভালো পর্যায়ে আনার পরিকল্পনা করেছি, সে কারণে ভালো সিইও খুঁজছিলাম। যদিও ওনার বিষয়ে কিছু বদনাম মার্কেটে আছে, তারপরও উনি বড় কোম্পানি চালিয়েছেন। তার অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর জন্য আমরা তাকে এখানে আনতে চাচ্ছি। যদি আইডিআরএ অনুমোদন না দেয় সেক্ষেত্রে তো কিছু করার থাকবে না।
হেমায়েত উল্লাহকে বহিষ্কার করা হয় ফারইস্ট থেকে
একসময় ভালো ব্যবসা করা ফারইস্ট লাইফের বিরুদ্ধে নজিরবিহীন লুটপাটের তথ্য বেরিয়ে এলে গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেয় পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। পর্ষদ ভেঙে দেওয়ার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটিতে ১০ জন স্বতন্ত্র পরিচালকও নিয়োগ দেওয়া হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের ডিন ড. মুহাম্মদ রহমতউল্লাহকে চেয়ারম্যান করে নতুন পর্ষদে পরিচালক হিসেবে রাখা হয় মোহাম্মদ সানাউল্লাহ অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের সিইও মোহাম্মদ সানাউল্লাহ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং ও বিমা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. রফিকুল ইসলাম, অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব মো. মোফাজ্জল হোসেন, অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল গাজী মো. খালিদ হোসেন, স্নেহাশীষ অ্যান্ড কোম্পানির পার্টনার স্নেহাশীষ বড়ুয়া, একাত্তর মিডিয়ার প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মোজাম্মেল হক, জি সেভেন সিকিউরিটিজের চেয়ারম্যান সাজেদুর রহমান, জনতা ব্যাংকের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. জিকরুল হক এবং নর্দান ইসলামী ইন্স্যুরেন্সের সাবেক চেয়ারম্যান জহিরুল ইসলাম চৌধুরীকে।
বিএসইসি থেকে এমন পদক্ষেপ নেওয়ার ১৫ দিনের মাথায় কোম্পানিটির সিইও পদ থেকে হেমায়েত উল্লাহকে বহিষ্কার করে আইডিআরএ। আইডিআরএ’র এ সংক্রান্ত চিঠিতে বলা হয়, কোম্পানি পরিচালনার ক্ষেত্রে হেমায়েত উল্লাহর বিভিন্ন অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, আর্থিক অনিয়ম, বিমা পলিসি গ্রাহক ও বিমাকারীর স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর এবং নিয়মপরিপন্থি কার্মকাণ্ডের তথ্য বিভিন্ন মাধ্যমে আইডিআরএ’র নজরে এসেছে। বিমা গ্রাহকদের অভিযোগসহ অনিয়মের তথ্য-প্রমাণ রয়েছে।
এছাড়া হেমায়েত উল্লাহর বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করে নিজ ভোগদখলে রেখে এবং মিথ্যা তথ্য সম্বলিত সম্পদ বিবরণী দাখিলের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মামলা করেছে। তার বিদেশ গমনেও জারি রয়েছে নিষেধাজ্ঞা। এ সংক্রান্ত তথ্য কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) কাছে রয়েছে বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।
এরপর গত বছরের ২১ ডিসেম্বর হেমায়েত উল্লাহকে কোনো বিমা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ না দিতে নির্দেশ দেয় আইডিআরএ। সব বিমা কোম্পানির চেয়ারম্যান ও সিইও বরাবর পাঠানো এ সংক্রান্ত চিঠিতে বলা হয়, ‘হেমায়েত উল্লাহ ২০১১ থেকে ২০২১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে উক্ত বিমা কোম্পানিতে (ফারইস্ট ইসলামী লাইফ) ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি বিমা আইন, ২০১০ ও বিমা আইনের বিভিন্ন বিধিবিধান অনুযায়ী কোম্পানি পরিচালনার জন্য দায়ী থাকবেন মর্মে তার নিয়োগপত্রে সুস্পষ্টভাবে শর্ত আরোপ করা হয়েছিল। কিন্তু দায়িত্বকালে কোম্পানিতে ব্যাপক অনিয়ম সংঘটিত হয়েছে মর্মে সম্প্রতি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়। এজন্য তিনি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দায়ী।’
এর আগে সম্প্রতি কোম্পানিটির পর্ষদ চেয়ারম্যান পদেও পরিবর্তন আসে। গত ১৪ মে পদ্মা ইসলামী লাইফের চেয়ারম্যান করা হয় মেট্রো গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ ফখরুল ইসলামকে। চট্টগ্রামের হোটেল রেডিসন ব্লুতে অনুষ্ঠিত কোম্পানিটির বোর্ড সভায় তাকে চেয়ারম্যান নির্বাচিত করা হয়।
ফখরুল ইসলাম এর আগে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের উদ্যোক্তা ও পরিচালক ছিলেন। ২০০০ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত সময়ে তিনি কোম্পানিটির ভাইস চেয়ারম্যান এবং ইসি কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
এদিকে নানা অনিয়মে জড়িয়ে পদ্মা ইসলামী লাইফের আর্থিক অবস্থা দুর্বল হয়ে পড়েছে। কোম্পানি পরিচালনা করতে গ্রাহকের টাকা অবৈধভাবে ব্যয় করছে জীবন বীমা কোম্পানিটি। সবশেষ সমাপ্ত বছর ২০২১ সালে পদ্মা লাইফ আইন লঙ্ঘন করে ব্যবস্থাপনা খাতে ৪ কোটি ৭০ লাখ টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করেছে। আইন অনুযায়ী, বছরটিতে ব্যবস্থাপনা খাতে সর্বোচ্চ ব্যয়ের সীমা ১১ কোটি ৯৬ লাখ টাকা নির্ধারিত হলেও কোম্পানিটি ব্যয় করেছে ১৬ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। আগের বছরও (২০২০ সালে) কোম্পানিটি আইন লঙ্ঘন করে ব্যবস্থাপনা খাতে অতিরিক্ত ব্যয় করে। ওই বছর আইন লঙ্ঘন করে অতিরিক্ত ব্যয় করা হয় ৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা।
ফখরুল ইসলামকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন কোম্পানির কর্মকর্তারা
ব্যবস্থাপনা খাতে অবৈধভাবে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করায় কোম্পানিটির পলিসিহোল্ডার ও শেয়ারহোল্ডাররা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কারণ আইনি সীমার অতিরিক্ত যে টাকা ব্যয় করা হচ্ছে তার ৯০ শতাংশই প্রতিষ্ঠানের পলিসিহোল্ডারদের প্রাপ্য। বাকি ১০ শতাংশের ভাগিদার শেয়ারহোল্ডাররা।
আরও পড়ুন: ভাগ্য খুলছেই না পদ্মা লাইফের শেয়ারহোল্ডারদের
ব্যবস্থাপনা খাতে অস্বাভাবিক অর্থ ব্যয় করা হলেও প্রতি বছর কোম্পানিটি নতুন যে প্রিমিয়াম আয় করছে পরবর্তী বছরে নবায়ন প্রিমিয়াম বাবদ আদায় হচ্ছে তার খুবই নগণ্য পরিমাণ। আবার নতুন ব্যবসাও খুব একটা আসছে না। এমনকি কোম্পানিটি নতুন ব্যবসা বা প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম আয় যা করছে, ব্যবস্থাপনা খাতে ব্যয় হচ্ছে তারচেয়ে বেশি।
সবশেষ ২০২১ সালে কোম্পানিটি প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম আয় করেছে ১৬ কোটি ৫৪ লাখ টাকা এবং ব্যবস্থাপনা খাতে ১৬ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। আগের বছর ২০২০ সালে প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম আয় হয় ১৫ কোটি ৬০ লাখ এবং ব্যবস্থাপনা খাতে ব্যয় হয় ২১ কোটি ২১ লাখ টাকা। অন্যদিকে ২০২১ সালে নবায়ন প্রিমিয়াম আয় হয়েছে ১৯ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। ২০২০ সালে নবায়ন প্রিমিয়াম আয় হয় ৩৬ কোটি ২৭ লাখ টাকা। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে নবায়ন প্রিমিয়াম আয় অর্ধেকে নেমে এসেছে।
একদিকে আইন লঙ্ঘন করে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়, অন্যদিকে আয় কমে যাওয়ার বিষয়ে পদ্মা লাইফের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোরশেদ আলম সিদ্দিক জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের অনেক বিমা দাবি বকেয়া রয়ে গেছে। সময়মতো বিমা দাবির টাকা দিতে না পারার কারণে এর একটা প্রভাব পড়েছে।
আরও পড়ুন: গোপনে বিক্রি হচ্ছে পদ্মা লাইফ
তিনি বলেন, ২০০০ সালের বিমা কোম্পানিগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি খুব সংকটের মধ্যে আছে। তার মধ্যে পদ্মা লাইফও একটি। যে কারণে আগের যারা উদ্যোক্তা পরিচালক ছিলেন, তারা এটাকে (পদ্মা লাইফ) এস আলম গ্রুপের কাছে দিয়ে চলে গেছেন। তাদের যে দায় সেটা এখন আমরা পরিশোধ করছি। এরই মধ্যে গত দুই-তিন বছরে আমরা আড়াইশ কোটি টাকার ওপরে দাবি পরিশোধ করেছি। আরও কিছু বকেয়া দাবি রয়ে গেছে। সেগুলো হয়তো আগামী বছরের প্রথমার্ধের মধ্যে পরিশোধ করে ফেলতে পারবো।
তিনি আরও বলেন, বিমা দাবির টাকা সঠিক সময়ে দিতে না পারার কারণে আমাদের প্রিমিয়াম আয় একটু কমে গেছে। তবে আমরা পরিকল্পনা করে এগোচ্ছি। আশা করি এবছর পরিস্থিতি কিছুটা পরিবর্তন হবে। আমাদের ব্যবস্থাপনা ব্যয় আইনি সীমার মধ্যে চলে আসবে।
এমএএস/এমএইচআর/এএসএ/এমএস