গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকট
রপ্তানির লক্ষ্য অর্জন নিয়ে সংশয়
পণ্য রপ্তানিতে বড় হচ্ছে দেশের স্বপ্ন। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, বৈশ্বিক জ্বালানি সংকট ও করোনা মাড়িয়ে গত অর্থবছর (২০২১-২২) দেশের রপ্তানিখাত আয় করেছে রেকর্ড পাঁচ হাজার ২০৮ কোটি ২৬ লাখ (৫২.০৮ বিলিয়ন) ডলার। ঢুকেছে ৫০ বিলিয়নের ক্লাবে। গত অর্থবছরের তুলনায় ১১ শতাংশ বাড়িয়ে ২০২২-২৩ অর্থবছর রপ্তানির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৬৭ বিলিয়ন ডলার। তবে চলমান গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটের কারণে এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে তৈরি হয়েছে সংশয়।
আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির ঊর্ধ্বগতিতে তেল-গ্যাস আমদানি করতে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করতে হচ্ছে। জ্বালানিতে বিপুল অংকের ভর্তুকি দিতে গিয়ে চাপে পড়েছে সরকার। এ কারণে ১৯ জুলাই থেকে সারাদেশে এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং শুরু হয়েছে। এক থেকে দুই ঘণ্টা বিদ্যুৎ না রাখার কথা বলা হলেও কোথাও কোথাও তিন থেকে চার ঘণ্টাও বিদ্যুৎ থাকছে না। এছাড়া সংকটের কারণে গ্যাসেও রেশনিংয়ের কথা ভাবছে সরকার। এমন অবস্থায় রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন হবে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা।
গত ২০ জুলাই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, সাম্প্রতিক বিশ্ব পরিস্থিতি ও ২০২১-২২ অর্থবছরের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি অর্জনের গতিধারা, পণ্য ও বাজার সম্প্রসারণে সরকারের দেওয়া আর্থিক সুবিধা, রাশিয়া-যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববাণিজ্যের সাম্প্রতিক গতিধারা, চলতি অর্থবছরের বাজেটে করোনা মোকাবিলায় সরকারের নেওয়া নানামুখী উদ্যোগ বিবেচনায় নিয়ে রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৬৭ বিলিয়ন ডলার।
রপ্তানি আয়ের বড় একটি অংশই আসে তৈরি পোশাকখাত থেকে। গত অর্থবছরের মোট রপ্তানি আয়ের ৮১ দশমিক ৮১ শতাংশই এসেছে পোশাকখাত থেকে। এছাড়া পোশাকখাতের আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ। বর্তমান রেশনিং ব্যবস্থায় আগামী অর্থবছরে পোশাকখাত কতটা অবদান রাখবে তা নিয়ে তৈরি হয়েছে সংশয়।
গ্যাস সংকটে বন্ধ রয়েছে সার কারখানার উৎপাদন
এ বিষয়ে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সহ-সভাপতি ও ফতুল্লা অ্যাপারেলসের প্রধান নির্বাহী ফজলে শামীম এহসান জাগো নিউজকে বলেন, বর্তমানে যে পরিস্থিতি চলছে সেটা লংটার্ম হবে না বলে আমরা মনে করি। এটা সর্বোচ্চ একমাস ভোগাতে পারে বলে আমাদের ধারণা।
তবে রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা উচ্চাভিলাষী উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটা অর্জন করা কঠিন হবে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক মন্দা তৈরি হয়েছে। এ পর্যায়ে এসে গত অর্থবছরের তুলনায় আরও ১০ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি রাখাটা কঠিন হয়ে যাবে। সারাবিশ্বে কাপড়ের চাহিদা কমবে, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দিকে মানুষ নজর দেবে।
ফজলে শামীম এহসানের মতে, বাংলাদেশ যেহেতু কম দামি কাপড় বেশি বানায় সেক্ষেত্রে আমাদের খুব বেশি ক্ষতি হয়তো হবে না। আবার মূল কাঁচামাল তুলার দাম প্রায় ৪০ শতাংশ কমেছে। সে কারণে পোশাকের দামও প্রায় ২০ শতাংশ কমবে। ২০ শতাংশ কম দাম ও ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি, মোট ৩০ শতাংশ বাড়তি অর্জন করা আসলে খুব উচ্চাভিলাষী। এটা অর্জন খুব চ্যালেঞ্জিং হবে।
গার্মেন্টস শিল্পেও লোডশেডিংয়ের বিরূপ প্রভাব পড়ছে জানিয়ে তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সহ-সভাপতি ও ব্যবসায়ী রকিবুল আলম চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, দেশে পাঁচ হাজারের মতো গার্মেন্টস কারখানা চলমান। বিদ্যুৎ সমস্যার কারণে কমবেশি প্রতিটি কারখানা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিদ্যুতের সমস্যা সম্প্রতি আলোচনায় এলেও বিগত দুই মাস থেকেই প্রতিদিন চার-পাঁচ ঘণ্টা করে বিদ্যুৎ পাচ্ছিলাম না। বিদ্যুৎ না থাকলে বিকল্প ব্যবস্থায় জেনারেটর ব্যবহার করতে হয়।
বিদ্যুতের বিকল্প হিসেবে জেনারেটর দিয়ে পুরো কারখানা চালানো সম্ভব হয় না জানিয়ে তিনি বলেন, কারখানায়ও রেশনিং করতে হচ্ছে। হয়তো একটি ফ্লোর চালু রেখে অন্য ফ্লোর বন্ধ রাখতে হয়। কখনো দুই লাইন বন্ধ রেখে দুই লাইন চালু রাখতে হচ্ছে। এতে উৎপাদন ব্যয় কয়েকগুণ বেড়ে যাচ্ছে। আবার নির্ধারিত সময়ে উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে অনেকের শিপমেন্ট বিলম্বিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে শুধু রপ্তানি নয়, অন্য সব কিছুই ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এখন খরচ বাড়বে, যদি বিদ্যুৎ না পায় তাহলে কারখানাগুলো ডিজেল দিয়ে চালাতে হবে। ফলে উৎপাদন খরচ আরও বাড়বে। উৎপাদন খরচ বাড়লে সেটা রপ্তানিতেও প্রভাব ফেলবে।
তিনি বলেন, লোডশেডিং পুরো রপ্তানিকে চাপের মধ্যে ফেলবে। যদি লক্ষ্য অর্জন করতেও চায় তাহলে খরচ বাড়বে। সবারই জেনারেটর আছে। সেটা চালালে খরচ আরও বেশি হবে। এ অবস্থা চলতে থাকলে রপ্তানিখাতের যে লক্ষ্যমাত্রা সেটা রক্ষা করা কঠিন হবে।
এসএম/এমএইচআর/এএসএ/জিকেএস