রাশিয়া-ইউক্রেন চুক্তি
কাটবে খাদ্য সংকট, কমবে মূল্যস্ফীতি
খাদ্যশস্য রপ্তানির জন্য কৃষ্ণসাগরের বন্দরগুলো খুলে দিতে জাতিসংঘ-সমর্থিত একটি চুক্তি সই করেছে রাশিয়া ও ইউক্রেন। যুদ্ধ চলাকালে বিশ্বজুড়ে যে খাদ্যসংকট দেখা দিয়েছিল, সই হওয়া এ চুক্তির ফলে তা থেকে মুক্তির পথ খুলেছে। এখন চুক্তি বাস্তবায়ন হলে সারাবিশ্ব যেমন উপকৃত হবে, তেমনি বাংলাদেশও উপকৃত হবে। ফলে বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের দাম কমবে। সেই সঙ্গে কমবে মূল্যস্ফীতি। এমনই অভিমত দিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা।
তারা বলছেন, রাশিয়া ও ইউক্রেন বিশ্বের খাদ্যশস্য রপ্তানিকারক দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। যুদ্ধ চলাকালে খাদ্যশস্য রপ্তানির ক্ষেত্রে এই দুই দেশ যে চুক্তি করেছে তা ঐতিহাসিক। এ চুক্তি বাস্তবায়ন হলে ইউক্রেন ও রাশিয়া থেকে গম, সানফ্লাওয়ার, সার, কীটনাশক রপ্তানি হবে। বাংলাদেশ এর সুফল পাবে। গমভিত্তিক বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের দাম কমবে। সেই সঙ্গে কমবে ভোজ্যতেলের দাম। পাশাপাশি সারে সরকারের ভর্তুকি কমে আসবে।
চলতি বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরু করে রাশিয়া। রাশিয়া হামলা শুরুর পর ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। বিশ্ব অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। হু হু করে বেড়েছে বিভিন্ন পণ্যের দাম। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে খাদ্যসংকট দেখা দিয়েছে। বিশ্বব্যাপী মন্দা ও দুর্ভিক্ষের পদধ্বনির মধ্যেই খাদ্যশস্য রপ্তানির জন্য কৃষ্ণসাগরের বন্দরগুলো খুলে দিতে শুক্রবার (২২ জুলাই) বাংলাদেশ সময় রাত ৮টার দিকে জাতিসংঘ-সমর্থিত চুক্তিটি সই করেছে রাশিয়া ও ইউক্রেন।
এ চুক্তির ফলে বাংলাদেশে কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ইউক্রেন-রাশিয়ার চুক্তির ফলে আশা করা যায় আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যপণ্যের দাম কিছুটা কমবে। এরই মধ্যে গমের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে কিছুটা কমেছে। আমাদের দেশে গম অনেকটাই আমদানিনির্ভর। সুতরাং আমরা তার থেকে (গমের দাম কমা) কিছুটা সুফল পাবো। সেটা হয়তো আমাদের মূল্যস্ফীতির ওপর কিছুটা ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলেও আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে দাম কমতে একটু সময় লাগে। সে কারণে এদিকে সরকারকে একটু সচেতন থাকতে হবে।
রাশিয়া-ইউক্রেনের চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠান, সংগৃহীত ছবি
অন্যদিকে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর জাগো নিউজকে বলেন, এখানে অনেক অনিশ্চয়তা আছে। কারণ যুদ্ধের মধ্যে যেকোনো কিছু ঘুরে যেতে পারে। যদি কোনো অঘটন না ঘটে এবং চুক্তি যদি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয় তাহলে এর বিরাট বড় একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
বিশিষ্ট এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ইউক্রেনে দুই কোটি টন গম জমা আছে। রাশিয়ায় আরও বেশি পরিমাণ গম জমা আছে। যুদ্ধের কারণে এখন রাশিয়া ও ইউক্রেন কেউই তা রপ্তানি করতে পারছে না। চুক্তি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হলে সেটা পৃথিবীর বাজারে চলে আসবে। এরই মধ্যে গমের দাম কমে গেছে।
কাজেই সেটা আমাদের জন্য সুবিধা হবে। আমাদের গমের দাম কমে যাবে। একই সঙ্গে ভুট্টার দাম কমবে। সেই সঙ্গে ভোজ্যতেলের দামও কমবে। কারণ ইউক্রেন হলো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সানফ্লাওয়ার রপ্তানিকারক দেশ। সানফ্লাওয়ার তেল যদি বাজারে বেশি আসে, তাহলে সয়াবিনের দাম কমে যাবে। পাম অয়েলের দামও কমবে। কাজেই সেদিক থেকেও আমরা বেনিফিটেড হবো এবং সারাবিশ্ব বেনিফিটেড হবে।
তিনি বলেন, বিশ্বে দুর্ভিক্ষের একটা ছায়া পড়ে গিয়েছিল। আফগানিস্তান, সোমালিয়া, কেনিয়ার মতো বিভিন্ন গরিব দেশগুলোতে অবস্থা ভয়াবহ। লেবানন, সিরিয়ার মতো মধ্যপ্রাচ্যের কিছু কিছু দেশে গমের দাম বাড়ায় ক্ষুধা এবং দারিদ্র্য বেড়ে গেছে। রাশিয়া-ইউক্রেনের চুক্তি বাস্তবায়ন হলে সে জায়গা থেকে পৃথিবী বেরিয়ে আসতে পারবে। এতে পৃথিবীর উপকার হবে, আমাদের দেশেরও উপকার হবে।
ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, দুর্ভিক্ষের যে পদধ্বনি শোনা যাচ্ছিল এ চুক্তির ফলে তা থেকে মুক্তি পাওয়ার একটা পথ খুললো। এটা আমাদের দেশের জন্য অনেক উপকারে আসবে। ফলে বাণিজ্য ঘাটতি কমে আসবে। মূল্যস্ফীতির ওপর বড় ধরনের ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। কারণ গমের দামের সঙ্গে চালের দাম সম্পৃক্ত। সেই সঙ্গে সারের দাম কমবে। কারণ রাশিয়া থেকে সবচেয়ে বেশি কীটনাশক ও সার রপ্তানি হয়। এটা বন্ধ ছিল। এই চুক্তির ফলে তা আবার রপ্তানি শুরু হবে। এটি আমাদের বিশাল উপকারে আসবে। আমাদের ৩০ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হয় সারে, সেটা কমে আসবে অনেকটা।
এই চুক্তির বিষয়ে দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সিনিয়র সহ-সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু জাগো নিউজকে বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন চুক্তি খুবই ভালো সংবাদ। এই চুক্তি যদি বাস্তবায়ন হয় তাহলে ওখান থেকে আমাদের দেশে গম আসবে। গম এলে আমাদের গমভিত্তিক যেসব খাদ্য আছে তার দাম কমে আসবে। এরই মধ্যে গমের দাম কমেছে আমরা দেখতে পাচ্ছি। এছাড়া সানফ্লাওয়ার ওখানে হয়, ওখান থেকে সানফ্লাওয়ারের বিজ আসে। সুতরাং এগুলোর দাম কমে যাবে। ভোজ্যতেলের দাম কমেছে, সামনে আরও কমবে। পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন পণ্যের দাম কমতে পারে, তখন আমাদের দেশেও কমবে।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি রিজওয়ান রাহমান জাগো নিউজকে বলেন, এই চুক্তির ফলে আমাদের দেশেও ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। খাদ্যনিরাপত্তার ক্ষেত্রে ইউক্রেন অনেক এগিয়ে ছিল। ইউক্রেনে সমস্যা হওয়ার কারণে বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীতে এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। এখন তাদের মধ্যে চুক্তি হলে তার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
তিনি বলেন, সমস্যা এখন রাশিয়া-ইউক্রেনের নয়, এটা বৈশ্বিক সমস্যা হয়ে গেছে। এখন বিশ্বব্যাপী বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সমস্যা হয়ে গেছে। রাশিয়া এবং ইউক্রেন গ্লোবাল প্লেয়ার। তারা যখন যুদ্ধে নেমে যায় তাদের খরচ বেড়ে যায়, এদের থেকে আমাদের ওপরও প্রভাব পড়ে। এখন তাদের মধ্যে যেকোনো ধরনের সমঝোতা হলে তার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
কুয়েত বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মো. হাবিবুর রহমান (হাবিব) জাগো নিউকে বলেন, এই মুহূর্তে এটি একটি ঐতিহাসিক চুক্তি। কারণ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে সারাবিশ্ব যখন স্তম্ভিত, খাদ্যের জন্য দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি হচ্ছিল ঠিক সে মুহূর্তে এ চুক্তি হয়েছে। এটি বিশ্ববাসীর জন্য, বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এর প্রভাব বাংলাদেশেও পড়বে। এর সুফল বাংলাদেশও ভোগ করবে।
তিনি বলেন, যে আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল দুর্ভিক্ষে পড়ে মানুষ না খেয়ে হাহাকার করবে, সেটা থেকে মুক্তির পথ এই চুক্তির মাধ্যমে উন্মুক্ত হলো। বাংলাদেশ এর সুফল অবশ্যই, অবশ্যই ভোগ করবে। আমি আশা করি, সামনে ভিন্ন পণ্যের দাম কমবে। এরই মধ্যে ভোজ্যতেলের দাম কমেছে। ধীরে ধীরে জ্বালানি তেলের সমস্যার সমাধানও হবে।
রাশিয়া-ইউক্রেন চুক্তিতে যা আছে
কৃষ্ণসাগরের পূর্বপরিকল্পিত পথে পণ্যবাহী জাহাজ যাত্রা করার আগে ইউক্রেনীয় বন্দরগুলোতে শস্য ভর্তির কাজ নিরীক্ষণ করবে তুরস্ক, ইউক্রেন ও জাতিসংঘের কর্মীদের একটি দল। ইউক্রেনের বন্দরগুলোতে পেতে রাখা মাইন এড়াতে ইউক্রেনীয় নাবিকরা জাহাজে মানচিত্র ব্যবহার করে শস্য বহনকারী বাণিজ্যিক জাহাজগুলো নিয়ে যাবে। জাহাজগুলো কৃষ্ণসাগর অতিক্রম করে তুরস্কের বসফরাস প্রণালির দিকে যাবে।
জাতিসংঘ, ইউক্রেন, রাশিয়া ও তুরস্কের প্রতিনিধিরা ইস্তাম্বুলের একটি যৌথ সমন্বয় কেন্দ্র থেকে জাহাজ পর্যবেক্ষণ করবেন। ইউক্রেনে প্রবেশকারী জাহাজগুলোও একইভাবে যৌথ সমন্বয় কেন্দ্রের তত্ত্বাবধানে পরিচালনা করা হবে, যাতে তারা ইউক্রেনে অস্ত্র বহন করতে না পারে। রাশিয়া ও ইউক্রেন শস্য পরিবহনে নিযুক্ত কোনো বাণিজ্যিক জাহাজ বা বন্দরগুলোতে আক্রমণ করবে না।
এমএএস/এমএইচআর/জিকেএস