বিনিয়োগ পেলেই বাজারে মিলবে ‘সোনালি ব্যাগ’
নিষিদ্ধের দুই দশকের বেশি সময় পেরুলেও বাংলাদেশে কমেনি পলিথিনের ব্যবহার। এখনো হাট-বাজার ছেয়ে আছে নিষিদ্ধ পলিথিনে। দূষণ ঘটাচ্ছে পরিবেশের। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্যও হয়ে উঠেছে মারাত্মক হুমকির। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ দেখিয়েছিল পাট থেকে তৈরি পরিবেশবান্ধব ‘সোনালি ব্যাগ’। পলিথিনের মতো দেখতে পচনশীল এই ব্যাগ সুনাম কুড়িয়েছিল দেশ-বিদেশে। তবে দীর্ঘ সময় পেরুলেও আসেনি মানুষের হাতের নাগালে। বিনিয়োগ পেলে এই ব্যাগের বাণিজ্যিক কার্যক্রম শিগগির শুরু করা যাবে বলে মনে করছে বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশন (বিজেএমসি)।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বড় বিনিয়োগ ও গবেষণার খুঁটিনাটি বিষয় বাকি থাকায় এখনো সোনালি ব্যাগ ব্যাপকভাবে উৎপাদনে যেতে পারেনি। প্রয়োজনীয় অধিকাংশ মেশিন চলে আসায় এখন বিনিয়োগকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। বড় কোনো বিনিয়োগ পেলেই বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাবে সোনালি ব্যাগ। তখন মানুষের নাগালে আসবে।
পরিবেশবিদরা বলছেন, পলিথিন দামে সস্তা। হালকা ওজনের বা ব্যবহারে সুবিধার জন্য খুব অল্প সময়ে সারা বিশ্বে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। কিন্তু পলিথিন মাটিতে পচে না, পানিতে গলে না বিধায় সারা বিশ্বে পরিবেশ দূষণের অন্যতম প্রধান কারণ। বিশ্বের অনেক দেশেই পলিথিন নিষিদ্ধ। বাংলাদেশ সরকার ২০০২ সালে সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকের ব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছিল। কিন্তু বিকল্প না থাকায় সে সিদ্ধান্ত কোনো কাজে আসেনি।
পলিথিনের বিকল্প উপাদান আবিষ্কার না হলে পরিবেশ দূষণ ও ব্যবহার কোনোটিই কমানো যাবে না। এটি উপলব্ধি করেই পরমাণু শক্তি গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) প্রফেসর ড. মোবারক আহমদ খান পচনশীল, পরিবেশবান্ধব পলিথিনের সাদৃশ্য পলিব্যাগ আবিষ্কারের পরিকল্পনা করেন।
প্রথমে তিনি ভাতের মাড় কিংবা স্টার্চজাতীয় উপাদান, জিলাটিন, চিংড়ি মাছের খোলস ইত্যাদি প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে পলিব্যাগ তৈরি করেন। কিন্তু এসব উপাদান পর্যাপ্ত ও সহজলভ্য না হওয়ায় সেলুলোজ দিয়ে পলিব্যাগ তৈরির পরিকল্পনা করেন যা সস্তা, সহজলভ্য এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে বাংলাদেশে পাওয়া যায়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি পরমাণু শক্তি গবেষণা ইনস্টিটিউটে দীর্ঘদিনের গবেষণার পর সফলতার সঙ্গে ল্যাব স্কেলে পাটের সেলুলোজের ওপর ভিত্তি করে উন্নত প্যাকেজিং উপাদান তৈরি করেন, যা মাটিতে সম্পূর্ণরূপে পচনশীল, কম্পোস্টেবল, পরিবেশবান্ধব ও সম্পূর্ণ প্লাস্টিকমুক্ত।
ড. মোবারক আহমদ খান ২০১৭ সালে পাট থেকে টেকসই ও স্বল্প ব্যয়ের জৈব সংশ্লেষযোগ্য প্যাকেজিংয়ের একটি নতুন আধুনিক এবং বাণিজ্যিকীকরণের প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতেই বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনে (বিজেএমসি) বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা হিসেবে যোগ দেন। পাটের সোনালি আঁশ এই ব্যাগ তৈরির মূল উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই প্যাকেজিং উপাদানের নাম রাখেন ‘সোনালি ব্যাগ’। ২০১৮ সালের ২ অক্টোবর পাট থেকে সোনালি ব্যাগ বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনের জন্য যুক্তরাজ্যের কোম্পানি ফিউটামুরা কেমিক্যাল লিমিটেডের সঙ্গে বিজেএমসির একটি সমোঝতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। যদিও পরে যুক্তরাজ্যের সেই কোম্পানি চুক্তি থেকে সরে যায়।
‘সোনালি ব্যাগ’র আবিষ্কারক ও বিজেএমসির বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা ড. মোবারক আহমদ খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের গবেষণার অগ্রগতি হচ্ছে। নতুন করে কোনো জিনিস উদ্ভাবন করলে এক-দেড় বছরে তো বাজারে আসে না, এজন্য সময় তো লাগবেই। সোনালি ব্যাগের প্রতিযোগিতা হবে পলিথিনের সঙ্গে, সুতরাং সেটা তো এত সহজ নয়। এটা তো একটা বড় গ্রুপ, আপনি বাজারে যেতে চাইলেই তারা যেতে দেবে কি? আমাদের ডেভেলপমেন্ট হয়ে গেছে, পাইলটিং করার কথা ছিল, সেটি শেষ পর্যায়ে। ব্যাগ মেকিং মেশিনটা বাদে অনেক জিনিসই এসে গেছে। এক মাসের মধ্যে আমরা মিনিটে ৪০ থেকে ৬০টি ব্যাগ তৈরি করতে পারবো এই অটোমেটিক মেশিনে, তাহলেই আমাদের পাইলটিংটা হয়ে যাবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘একটা আবিষ্কারেই তো থেমে থাকবে না। পৃথিবীতে আরও দেশ এটি নিয়ে কাজ করছে। তারাও এর মধ্যে আবিষ্কার করে ফেলতে পারে। বাকিটুকু আমার ক্ষমতার বাইরে। আমরা মন্ত্রণালয়ের কাছে একটি প্রস্তাব দিয়েছি। সেটি প্রকল্প নেবে নাকি কোন ফান্ডে করবে সেটি সরকারের সিদ্ধান্ত। আমি বলেছি, এখন প্রতিদিন ২০ থেকে ৩০ টন প্রোডাকশন প্রতিদিন করতে হবে। এতে মাসে ৫শ কোটি টাকা খরচ হবে।’
যে কারণে পাট থেকে সোনালি ব্যাগ তৈরি
সোনালি ব্যাগের বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যগুলো প্রচলিত পলিব্যাগের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এটি বাজারের পলিব্যাগের চেয়ে দেড়গুণ বেশি ভার বহন করতে সক্ষম। মাটিতে সম্পূর্ণরূপে পচনশীল (এক থেকে ছয় মাসের মধ্যে পচে যায়), কম্পোস্টেবল (উদ্ভিদ বৃদ্ধির জন্য প্রাকৃতিক সার হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে), পানিতে দ্রবণীয়, পানিতে মিশে গেলে জৈব প্লাংটনে পরিণত হয়, যা মাছের খাদ্য হিসেবে জোগান দেবে। আগুনে পুড়লে ছাই হয়ে যায় এবং বিষাক্ত কোনো গ্যাস তৈরি করে না।
সোনালি ব্যাগ দেশকে দুটি উপায়ে লাভবান করবে। পাটের উৎপাদন বাড়াবে এবং বৈদেশিক মুদ্রার বহির্মুখ প্রবাহ হ্রাস করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করবে।
গবেষণায় দেখা যায়, এক হেক্টর পাট গাছ বায়ুমণ্ডল থেকে প্রায় ১৫ টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ হ্রাস করে এবং ১১ টন অক্সিজেন বায়ুমণ্ডলে যুক্ত করে। আবার কাঠের গাছের মতো অন্যান্য প্রচলিত সেলুলোজ উৎসের তুলনায় পাট গাছ থেকে খুব অল্প সময়ে সেলুলোজ সংগ্রহ করা যায়। উদাহরণস্বরূপ, কাঠজাতীয় উদ্ভিদ সেলুলোজ সংগ্রহের জন্য প্রস্তুত হতে প্রায় ১০-১৫ বছর সময় লাগে অন্যদিকে পাট গাছ থেকে সেলুলোজ আহরণ করতে মাত্র ১১০ দিন সময় লাগে।
সোনালি ব্যাগ গবেষণা প্রকল্পের অগ্রগতি
বর্তমানে বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের পৃষ্ঠপোষকতায় ডেমরায় স্থাপিত লতিফ বাওয়ানী জুট মিলে সোনালি ব্যাগ বাণিজ্যিকীকরণের জন্য পাইলট পর্যায়ের একটি প্রকল্প চলমান। স্বল্প পরিসরে সোনালি ব্যাগ উৎপাদনও হচ্ছে। সোনালি ব্যাগের আবিষ্কারক প্রফেসর ড. মোবারক আহমদ খানের নেতৃত্বে প্রকল্পের গবেষণা দল ব্যাপক গবেষণার মাধ্যমে সফলভাবে একটি পাইলট প্ল্যান্ট স্থাপন করেছে। বর্তমানে সেমি-বাণিজ্যিক প্ল্যান্ট স্থাপনের জন্যও প্রস্তুত।
অগ্রগতি প্রসঙ্গে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, সোনালি ব্যাগের প্রধান সমস্যা ছিল অটোমেটিক ব্যাগ বানানোর মেশিন নিয়ে। অধিকতর গবেষণার মাধ্যমে সোনালি ব্যাগ গ্লু, সেলাই মেশিন ও আল্ট্রাসাউন্ড মেশিন দিয়ে সিলিং করা সম্ভব হয়েছে। বর্তমানে প্রকল্পের বরাদ্দ অর্থে লোকাল বাজার থেকে ম্যানুয়াল আল্ট্রাসনিক মেশিন কেনা হয়েছে। গ্লু সিস্টেমে ব্যাগ বানানোর জন্য একটি অটোমেটিক মেশিন টেন্ডারের মাধ্যমে ক্রয়াদেশ দেওয়া হয়েছে। ম্যানুয়াল আল্ট্রাসনিক মেশিনের মাধ্যমে ব্যাগ বানানোর কাজ চলমান।
সোনালি ব্যাগ তৈরির কাঁচামাল দিয়ে যেন অন্য কোম্পানি সোনালি ব্যাগ বানাতে পারে, তাই সোনালি ব্যাগের প্রধান কাঁচামাল পাউডারসদৃশ করার জন্য গবেষণা চলছে। এছাড়া বাই-প্রোডাক্ট হিসেবে ল্যাব স্কেলে লিগনিন তৈরি করা সম্ভব হয়েছে, যা দিয়ে সোনালি ব্যাগ বানানোর পরিবেশবান্ধব ও পচনশীল গ্লু বানানোর কাজ চলছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিজেএমসির চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত সচিব) মুহাম্মদ সালেহউদ্দীন জাগো নিউজকে বলেন, ‘এটি নিয়ে আমাদের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও প্রকল্প পরিচালক বলতে পারবেন। তাদের বাইরে আমার নতুন করে বলার কিছু নেই।’
মন্ত্রণালয়ে সোনালি ব্যাগ সংক্রান্ত কোনো প্রস্তাবনা গেছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সে বিষয়েও কিছু জানি না।’
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বস্ত্র ও পাট সচিব মো. আব্দুর রউফ জাগো নিউজকে বলেন, ‘উনি (ড. মোবারক আহমদ) বিজ্ঞানি মানুষ, উনি ওনার ভাষায় কথা বলেন। আমি সরকারি কর্মচারী, আমি বলি আমার ভাষায়। দুটি তো মিলবে না। এরকম কোনো সুনির্দিষ্ট প্রপোজাল আমার কাছে নেই। আমি এর সঙ্গে লেগে আছি। যেহেতু গবেষণার কাজটা শেষ হয়েছে, এখন ছোটখাটো পর্যায়ে পাইলটিং হয়েছে বলা যাবে। সেমি কমার্শিয়াল প্রোডাকশনে যেতে ইনভেস্টর লাগবে।
‘বিজেএমসির ১০ কোটি টাকা খরচ করে এটি করে ফেললাম, পরবর্তীসময়ে জলবায়ু ফান্ড থেকে ৯ কোটি টাকা পেয়ে গবেষণার কাজটা এগোলো। আমি প্রোডাকশনে যেতে চাইলে এরকম পাঁচ কোটি বা ১০ কোটি টাকা দিয়ে হবে না, সেখানে তো টাকার প্রশ্ন। কিছুদিনের মধ্যে একটি শেয়ারিং ওয়ার্কশপ করবো, টপ লেভেল থেকে ইনভলব করে। যাতে টপ লেভেল পর্যন্ত সব মেসেজ পৌঁছাতে পারি। এটাকেই তিনি বলছেন মন্ত্রণালয়ে প্রপোজাল পাঠিয়েছেন।’
কবে নাগাদ সোনালি ব্যাগ মানুষের হাতের নাগালে আসবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘গবেষণার বিষয়টি হুট করে করা যায় না, অনেক কিছু এটার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকে। ফাইন্যান্সার পেলেও হবে না। ব্যাগটা ধরলে পাটের যে পচা গন্ধ সেই গন্ধটা এখনো আছে। সেটা রিমুভ করার প্ল্যান্ট তো মাত্র স্থাপন করা হয়েছে। এতদিন ফিলিং হতো না, সেলাই করে ব্যাগ দেওয়া হতো।
‘সেলাই করে দিলে তো লিকড হবে, সেটি তো কেউ নেবে না। সেটিও কিন্তু তিনি নিজেই আবিষ্কার করেছেন। বাইরে থেকে বলা সম্ভব। কাজ চলমান, হতাশ হওয়ার মতো কিছু দেখি না, ধৈর্য ধরে এগোতে হবে। শিগগির আমরা বড় ধরনের শেয়ারিং করতে যাচ্ছি, সেজন্য অনেক প্রস্তুতি আছে।’
আইএইচআর/এএসএ/এএসএম