পোল্ট্রির বর্জ্যে অপার সম্ভাবনা
দেশের সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে নিজেদের স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে পোল্ট্রি শিল্প। বর্তমানে এ শিল্পে বিনিয়োগ প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। অর্ধকোটি লোকের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মসংস্থান এ শিল্পে। সস্তায় প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণের উৎস। সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এই শিল্পের বড় চ্যালেঞ্জ। তবে পোল্ট্রির বর্জ্য সমস্যা নয়, বরং সম্ভাবনা হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, সারাদেশে পোল্ট্রি খামারের সংখ্যা দুই লাখ পাঁচ হাজার ২৩১টি। এর মধ্যে নিবন্ধিত পোল্ট্রি খামারের সংখ্যা ৮৫ হাজার ২২৭টি ও অনিবন্ধিত খামারের সংখ্যা এক লাখ ২০ হাজার চারটি।
২০১৯-২০২০ সালের হিসাব অনুযায়ী, দেশে ১৬টি পোল্ট্রি গ্র্যান্ড প্যারেন্ট ফার্ম, ২০৬টি লেয়ার ও ব্রয়লার ব্রিডার ফার্ম ও ৮ হাজার ৮০০টি লেয়ার এবং ব্রয়লার খামার রয়েছে। কার্যক্রম পরিচালনা করছে ২১৭টি ফিড মিল, ১৫টি মিট প্রসেসিং প্ল্যান্ট, ২ হাজার ১৫টি সোনালি মুরগির ব্রিডার খামার এবং ৫৩৪টি প্রাণিস্বাস্থ্য সম্পর্কিত কোম্পানি। বর্তমানে দেশে মোট জিডিপির ১ থেকে ৩০ শতাংশ আসছে পোল্ট্রি শিল্প থেকে। তাই পোশাকশিল্পের পরই সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে পোল্ট্রি শিল্প এরই মধ্যে একটি স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরি করে নিতে সক্ষম হয়েছে।
বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএলআরআই) সাবেক মহাপরিচালক ড. নাথু রাম সরকার পোল্ট্রির বর্জ্য নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন। তার মতে, একটা সময় ছিল যখন পোল্ট্রি শিল্পের বিকাশ শুরু হয়নি। তখন হয়তো এতসব ভাবারও সময় ছিল না। সে সময় জায়গাও ছিল। তবে সরকারি নীতিকাঠামো ছিল অনেকটা দুর্বল। এখন দিন যত যাচ্ছে, জমি কমছে, কঠিন হচ্ছে সরকারি নীতিকাঠামো। সামনের দিনগুলোতে যত্রতত্র পোল্ট্রি বর্জ্য ও আবর্জনা ফেলার সুযোগ একেবারে কমে যাবে। বিষয়টি নিয়ে এরই মধ্যে দেশের বড় পোল্ট্রি জায়ান্ট কোম্পানিগুলো ভাবছে এবং সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নিচ্ছে। পোল্ট্রি বর্জ্যকে তারা এখন আর সমস্যা ভাবছে না, দেখছে সম্ভাবনা হিসেবে।
বিশ্বের বড় বড় দেশের কৃষিজমির পরিমাণ অনেক বেশি। যেমন- যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল প্রভৃতি দেশে জমির উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য কম্পোস্ট সার হিসেবে ব্যবহার করা হয় পোল্ট্রি লিটার (বিষ্ঠা)। খুবই সহজ পদ্ধতিতে সাধারণ কিছু প্রযুক্তি ব্যবহার করে পোল্ট্রি লিটার রিসাইক্লিংয়ের মাধ্যমে জৈব সার উৎপাদন করে সেগুলো প্যাকেটজাত অবস্থায় বাজারজাত করা হচ্ছে। বাংলাদেশেও এ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। পোল্ট্রি লিটার থেকে জৈব সার উৎপাদনই শুধু নয়, লিটার দিয়ে তৈরি হচ্ছে বায়োগ্যাস ও বিদ্যুৎ।
বাংলাদেশে প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণে আশির দশক থেকে বাণিজ্যিকভাবে মুরগি পালন শুরু হয়। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে বিনিয়োগকারীদের উদ্যোগে পোল্ট্রি শিল্প গতি পায় এবং সস্তায় উন্নত আমিষের উৎস হিসেবে এ খাত জনপ্রিয়তা লাভ করে। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি পোল্ট্রি একটি সম্ভাবনাময় শিল্পের রূপ ধারণ করে এবং বছরে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ হারে বাড়তে থাকে।
পোল্ট্রি শিল্পকে কেন্দ্র করে সারাদেশে গড়ে উঠেছে ছোট-বড় অনেক খামার, ফিড মিল ও ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। বিদেশি বিনিয়োগও এসেছে এ শিল্পে। গত কয়েক বছরে রেড মিটের দাম বেড়ে যাওয়ায় সস্তায় প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণে পোল্ট্রি শিল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।
পোল্ট্রি শিল্পের বর্জ্য
পোল্ট্রি শিল্পের পোল্ট্রি বর্জ্যের মধ্যে রয়েছে বিষ্ঠা, খাদ্যের উচ্ছিষ্টাংশ, পালক, হ্যাচারির বর্জ্য ও মৃত মুরগি। বর্তমানে দেশে বছরে ৪ দশমিক ৫২ মিলিয়ন টন পোল্ট্রি বর্জ্য উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে ৩ দশমিক ১ মিলিয়ন টন উৎপাদিত হয় বাণিজ্যিক খামার থেকে। এসব খামার দেশের মধ্য, উত্তর ও পূর্বাঞ্চলীয় কিছু অঞ্চলে অবস্থিত। প্রচলিত ব্যবস্থায় পোল্ট্রির বিষ্ঠা খামারের পাশে স্তূপ করে রাখা হয়। পরবর্তীসময়ে ফারমেন্টেশন হয়ে বিভিন্ন গ্যাস উৎপন্ন ও দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পরিবেশ দূষণ করে। এতে বাতাস, পানি ও মাটিদূষণ হয়, যা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
খামারিদের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০ শতাংশ খামারি পোল্ট্রির লিটার ব্যবহার করেন না, ৪০ শতাংশ খামারি বিক্রি করেন, ৩০ শতাংশ শস্যক্ষেতে এবং ১০ শতাংশ মাছ উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। সাধারণত একটি ব্রয়লার মুরগি এক কেজি খাবার খেলে এক কেজি ফ্রেশ লিটার পাওয়া যায়। অন্যদিকে একটি লেয়ার মুরগি থেকে বছরে ২০ কেজি বিষ্ঠা পাওয়া যায়।
ড. নাথু রাম সরকার জাগো নিউজকে বলেন, বর্জ্য যে একটি সম্পদ আমাদের দেশের খামারিদের মধ্যে অনেকের সে বিষয়ে ধারণাই নেই। আমাদের ছোট ছোট খামারির সংখ্যা কমে যাচ্ছে, ধীরে ধীরে হয়তো সেটি থাকবে না। যারা বড় খামারি তারা একটি কমপ্লিট ম্যাকানিজম করে তাদের বর্জ্যগুলো রিসাইকেল করে যে বিদ্যুৎ হয় সেটি নিজেরাই ব্যবহার করতে পারবে। এছাড়া ফার্টিলাইজার হিসেবেও কিন্তু ব্যবহার করা যাবে।
‘একটি খামার করে যে পরিমাণ আয় হয়, সে অনুযায়ী বর্জ্য থেকেও তার ২৫ শতাংশ আয় করা সম্ভব। পোল্ট্রির বর্জ্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হলেও আমরা সেটির যথাযথ ব্যবহার করতে পারি না। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে না করলে কিন্তু পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে, একই সঙ্গে রিসোর্স থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। বর্জ্য থেকে তৈরি সার জমিতে ব্যবহার করলে আমাদের দেশের ইউরিয়াসহ অন্যান্য সারের ব্যবহার কমিয়ে আনতে পারবো। একই সঙ্গে মাটির যে গুণাগুণ থাকে সেটি কমে যাচ্ছে, কিন্তু সার ব্যবহারের ফলে সেটি থেকে আমরা রক্ষা পেতে পারি। তাই পোল্ট্রির বর্জ্যের ব্যবস্থাপনা খুব জরুরি।’
তিনি বলেন, যেসব ছোট খামারির সক্ষমতা নেই তারা অন্তত এটিকে কম্পোস্ট করতে পারেন। পোল্ট্রির বর্জ্যকে অন্যান্য আবর্জনার সঙ্গে মিশিয়ে একটি কম্পোস্ট করা যায়। কিন্তু সেটিও অনেকে করছেন না। তারা অন্যের জমিতে রাখছেন, সেখান থেকে পরিবেশ দূষণ হচ্ছে। এ বিষয়টিতে তাদের সচেতন করতে হবে।
পোল্ট্রির বর্জ্য ব্যবহার
যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের বেশ কিছু বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্রে প্রাথমিক জ্বালানি হিসেবে পোল্ট্রি ও টার্কির লিটার ব্যবহার করা হচ্ছে। আয়ারল্যান্ডে বায়োগ্যাস এনার্জির উৎস হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে পোল্ট্রি লিটার। ব্রয়লার হাউজের তাপ বা উষ্ণতা বাড়াতে আগে যেখানে ফসিল ফুয়েল বা এলপিজি গ্যাস ব্যবহার করা হতো, এখন সেখানে পোল্ট্রি লিটার ব্যবহার করা হচ্ছে। অ্যাডভান্স ফাইবারস অ্যান্ড পাউডারসের মতো বড় বড় কোম্পানি তাদের ইলেকট্রিক্যাল ও হিটিং অ্যাপ্লিকেশনে জ্বালানি হিসেবে পোল্ট্রি লিটার ব্যবহার করছে। পাশাপাশি তারা তৈরি করছে অ্যাক্টিভেটেড কার্বন ও সার। পোল্ট্রি শিল্পের কোনো কিছুই এখন ফেলে দেওয়া হয় না। চিকেন ফেদার মিল থেকে প্রোটিন মিল ও সার তৈরি ছাড়াও নতুন ধরনের বায়োডিজেল ফুয়েল উৎপাদন করা হচ্ছে।
গবেষণা তথ্য থেকে জানা যায়, খামারে প্রতি বছর এক হাজার টন বর্জ্য উৎপাদিত হলে সেখান থেকে ৩৮ থেকে ৭০ কিলোওয়াট, ১০ হাজার টন বর্জ্য থেকে ৩৪০ থেকে ৭০০ কিলোওয়াট ও ৫০ হাজার টন বর্জ্য থেকে ১ দশমিক ৭০ থেকে ৩ দশমিক ৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব।
বাংলাদেশের প্যারাগন পোল্ট্রি, কাজী ফার্মস প্রভৃতি দেশি কোম্পানি নিজস্ব খামারে বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে অভিনব এ পদ্ধতি কাজে লাগাচ্ছে। এক হিসাব মতে, ১০ হাজার মুরগির একটি খামার থেকে প্রতিদিন এক টনের বেশি বর্জ্য পাওয়া যায়। বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিইসিসি) হিসাব মতে দেশে বর্তমানে দৈনিক প্রায় চার হাজার মেট্রিক টন মুরগির মাংস ও দুই কোটি ৮০ লাখ ডিম উৎপাদিত হয়। ফলে দেশে প্রতিদিন অনেক বর্জ্য উৎপাদিত হচ্ছে। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে এ সম্পদকে কাজে লাগাতে পারলে সার, জ্বালানি উৎপাদনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসা সম্ভব।
কাজী ফার্মসের হেড অব সেলস কৃষিবিদ আবু তাহের জাগো নিউজকে বলেন, ২০১৬ সালে লাইসেন্স পেয়ে আমরা পুরোপুরি জৈব সার তৈরিতে চলে গেছি। আমাদের মুরগির বিষ্ঠার সঙ্গে কাঠের গুঁড়া, ভুট্টার গুঁড়া, ১৫টি অণুজীব যেগুলো পচনশীল সেগুলো ব্যাকটেরিয়া দিয়ে পচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমরা জৈব সার হিসেবে বিক্রি করছি। পুরো প্রক্রিয়াটি আমরা করছি অটোমেটিক মেশিনে। ফলে আমাদের কোনো সানলাইটের সংস্পর্শে যেতে হচ্ছে না। এতে মিথেন গ্যাসও উৎপাদন হয় প্রচুর পরিমাণে। মিথেন গ্যাস যদি কেউ সানলাইট দিয়ে শুকায় সে কিন্তু গ্রিন হাউজ গ্যাস তৈরি করতে পারে। যেটি পরিবেশের জন্য খুবই ক্ষতিকর। অস্বাভাবিক বন্যা, ঝড়-বৃষ্টির জন্য গ্রিন হাউজ গ্যাসটি দায়ী, সেজন্য আমরা প্রযুক্তির মাধ্যমে ইন্টারনালভাবে প্ল্যান্টের মাধ্যমেই তৈরি করছি, যা পরিবেশের কোনো ক্ষতি করছে না।
তিনি বলেন, জৈব সার তৈরির ফলে লাভ-লোকসানের হিসাবে আমরা আগে যাইনি। পোল্ট্রির বর্জ্য যথাযথভাবে অপসারণ করা আমাদের চ্যালেঞ্জ ছিল। শুরুর দিকে কাঁচা যে লিটার হতো সেটি লোকালয়ে কিছু টাকা দিয়ে হলেও বলতাম নিয়ে যেতে। তারা যখন নিতো তখনও কিন্তু দুর্গন্ধ ছড়াতো। এটা আমাদের খুবই সমস্যার কারণ ছিল। এখন আমরা দুর্গন্ধহীনভাবেই তৈরি করতে পারছি। আমাদের ইনভেস্টমেন্ট অনেক হাই। দিনশেষে আমাদের লাভ হবে। এখন যেহেতু ইনভেস্টমেন্ট হাই তাই লাভ দেখাতে পারছি না।
পোল্ট্রি বর্জ্যের সম্ভাবনা
বাংলাদেশ বায়োগ্যাস উন্নয়ন ফাউন্ডেশন (বিবিডিপি) পোল্ট্রির বর্জ্য থেকে প্রতিবছর ৩ দশমিক ৬ মিলিয়ন ঘনমিটার বায়োগ্যাস, ৮০৫৮ দশমিক ৮ (মেগাওয়াট ঘণ্টা) ও ৩ দশমিক ৮১ মিলিয়ন টন বায়োস্লারি উৎপাদন করা সম্ভব। বর্তমানে দেশে পোল্ট্রিশিল্পে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার কোটি টাকার ওপর বিনিয়োগ রয়েছে এবং ২০৫০ সাল নাগাদ এ খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ দ্বিগুণ হবে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আশা ব্যক্ত করছেন। পোল্ট্রি শিল্প ব্রয়লার মুরগির মাংস ও ডিম উৎপাদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। মাংস ও ডিম দিয়ে প্রক্রিয়াজাত খাবার ভোক্তাদের টেবিলে পৌঁছে দেওয়ার জন্য গড়ে উঠেছে বিভিন্ন প্রসেসিং প্ল্যান্ট। পোল্ট্রিবর্জ্য এখন আর পোল্ট্রিলিটারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। বরং এর সঙ্গে যোগ হয়েছে হ্যাচারি, প্রসেসিং প্ল্যান্ট এবং ফার্মের অন্যান্য বর্জ্য। এসব জায়গা থেকে উৎপাদিত বর্জ্য কাজে লাগানো হচ্ছে কিংবা কাজে লাগানোর পরিবেশ তৈরি হচ্ছে।
যেমন
#আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে মুরগির বিষ্ঠা ও অন্যান্য বর্জ্যকে কম্পোজিট প্ল্যান্টের মাধ্যমে টানেল ভেন্টিলেশন বর্জ্যকে কম্পোজিট প্ল্যান্টের মাধ্যমে টানেল ভেন্টিলেশন এবং ড্রাইং পদ্ধতিতে প্রক্রিয়াজাত করে গুণগতমানসম্পন্ন গুঁড়া অথবা দানাদারজাতীয় অর্গ্যানিক জৈব সারে রূপান্তরিত করা।
#পোল্ট্রি ফার্মের অন্যান্য বর্জ্য ও মুরগির প্রক্রিয়াজাত খামারের বর্জ্য থেকেও রেন্ডারিং টেকনোলজি ব্যবহারের মাধ্যমে উচ্চমাত্রায় আমিষজাতীয় পোল্ট্রিমিল উৎপাদন করা যায়, যা গবাদিপশু ও মাছের খাবার তৈরিতে ব্যবহার করা হয়।
#বিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনা।
# বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বাস্তবায়ন করা গেলে আর সেখানে সংরক্ষণসহ মিথেন গ্যাস উৎপাদন কমিয়ে আনা সম্ভব।
# পোল্ট্রি খামার যদি ক্ষতিকর জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত থাকে, তাহলে এদের বর্জ্যের মাধ্যমে জীবাণুগুলো নিঃসৃত হয়। উক্ত বর্জ্য প্রক্রিয়াজাত না করলে তা থেকে মানুষের রোগ সৃষ্টির আশঙ্কা থেকে যায়। এমতাবস্থায় এসব বর্জ্য অ্যান অ্যারোটিক ডাইজেশন করা হলে এর মাধ্যমে রোগ জীবাণু ছড়ানোর আশঙ্কা কমে যায়।
গবেষণায় দেখা যায়, প্রাণীর বর্জ্য দিয়ে সৃষ্ট জৈব সার ব্যবহার করলে রাসায়নিক সার আমদানি ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ হ্রাস পাবে ও একই সঙ্গে মাটির গুণগত মানেও উন্নয়ন ঘটবে।
পোল্ট্রি গবেষণা ও উন্নয়ন জোরদারকরণ প্রকল্পের পরিচালক এবং বিএলআরআইয়ের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. সাজেদুল করিম সরকার জাগো নিউজকে বলেন, পোল্ট্রির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে আমাদের একটি কাজ চলছে। আমাদের একটি পিএইচডি ওয়ার্ক হচ্ছে এটার ওপর। পোল্ট্রি থেকে যে ওয়েস্টগুলো আসে, বিশেষ করে বিষ্ঠা সেটি থেকে আমরা বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট স্থাপনের পরিকল্পনা করেছি। সেই প্রক্রিয়ায় আমরা বিষ্ঠা ব্যবহার করবো। হ্যাচারির বর্জ্য, বাচ্চা ফোটানোর পর যে বর্জ্য থাকে কিংবা মুরগি জবাই করার পর যে বর্জ্য হয় সেগুলো থেকে কীভাবে ভ্যালু অ্যাডেড প্রোডাক্ট তৈরি করা যায় সেটি নিয়ে আমরা পরিকল্পনা করে এগোচ্ছি।
‘আমাদের বড় প্রকল্পের আওতায় ছোট কিছু কার্যক্রম আছে। আমাদের একজন শিক্ষার্থী কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে বিষয়টি নিয়ে আমার তত্ত্বাবধানে কাজ করছে। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। আমাদের ট্রায়াল দিয়ে দেখতে হবে কোন অপশনটা ভালো। কোন পর্যায়ে গেলে এটি খামারিদের রিকমান্ড করা যাবে সেটিও দেখতে হবে।’
তিনি বলেন, সাধারণত জৈব সার হিসেবে অনেকে ব্যবহার করলেও সেখানে জমিতে ব্যবহারের ক্ষেত্রে এখানে কোনো ক্ষতিকর ম্যাটেরিয়াল আছে কি না সেগুলো তাৎক্ষণিকভাবে বোঝা সম্ভব নয়। ধারাবাহিকভাবে কার্যক্রম চলবে। আমরা হয়তো একটি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করবো যেটি খামারিদের কাজে লাগবে।
সরকারের করণীয়
মিথেন গ্যাস নির্গমন হ্রাস, কার্বন উৎপাদনের মাত্রা কমানো এবং জলবায়ু পরিবর্তনে প্রাণিসম্পদের অভিযোজন বৃদ্ধি গুরুত্ব দিয়ে সরকার বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ স্ট্র্যাটেজি ও অ্যাকশন প্ল্যান (২০০৮) অনুমোদন করেছে। জাতিসংঘের জলবায়ু কর্মসূচির (United Nations Environment Programme; UNEP) আওতায় বায়ুর স্বল্পজীবী পরিবেশ দূষকগুলো (Short Lived Climate Pollutants; SLCPs) হ্রাসে জ্ঞান, উপাত্ত এবং প্রযুক্তি সহযোগিতা বাড়াতে Climate and Clean Air Coalition (CCAC) ২০১২ সালে সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশ CCAC–এর প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য এবং বাতাসের SLCPs হ্রাসের লক্ষ্যে সরকার National Action Plan for Reducing Short Lived Climate Pollutants (NAP 2013) অনুমোদন করে, বর্তমানে যেটি আরও হালনাগাদ করে NAP 2018 চূড়ান্ত করা হয়েছে। SLCP–এর একটি বড় উৎস হলো প্রাণিসম্পদ ম্যানিউর। SLCP হ্রাসে অজ্ঞানতা, অসচেতনতা, পারস্পরিক অসহযোগিতা এবং প্রয়োজনীয় নীতির অভাব ও দুর্বল সক্ষমতা CCAC চিহ্নিত করা হয়। সেই আলোকে শুধু পোল্ট্রিবর্জ্য ব্যবহারের জন্য নয়, প্রাণিসম্পদের সব বর্জ্যের সঠিক ব্যবহার, সংরক্ষণ, প্রযুক্তিগত সহযোগিতা দেওয়ার জন্য মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় প্রাণিসম্পদ ম্যানিউর ব্যবস্থাপনা নীতি-২০২০ প্রণয়ন করেছে, যা সংক্ষেপে ILMM নামে পরিচিত। এই নীতিমালার মিশন হচ্ছে, প্রথাগত ব্যবস্থাপনার পরিবর্তে বড়, মাঝারি, ক্ষুদ্র ও ভূমিহীন খামারিদের সংগঠিত করে বাজারমুখী মুখ্য সংযোজিত প্রাণী ম্যানিউর পণ্য উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি বাস্তবায়ন করা। ILMM নীতির ভিশন হচ্ছে— সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর উদ্যোগে দেশের প্রাণী ম্যানিউরের উন্নত ব্যবস্থাপনা বাস্তবায়ন, প্রাণিসম্পদ উৎপাদন আরও টেকসই ও বায়ুদূষণ হ্রাস করা।
নীতিমালাটি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট সংস্থা, দপ্তর ও অধিদপ্তর এবং সংগঠনগুলোর প্রচেষ্টায় অনুমোদিত সমন্বিত প্রাণিসম্পদ ম্যানিউর ব্যবস্থাপনানীতির বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। ওই নীতি বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয় ও সংস্থার সমন্বয়ে একটি জাতীয় পরামর্শক কমিটি (National Consultative Committee) গঠন করে বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএলআরআই)। ILMM কমিটির সার্বিক দায়িত্ব পালন করবে। কোনো বেসরকারি উদ্যোক্তা পোল্ট্রিবর্জ্য থেকে নতুন বায়োগ্যাস, বিদ্যুৎ, ঘনীভূত বায়োগ্যাস, জৈব সার বা মাঠ কম্পোস্ট সার, ভার্মিকম্পোস্ট এবং জৈব কীটনাশক উৎপাদন, সেক্টরে বিনিয়োগ করতে আগ্রহ প্রকাশ করলে সরকার উৎসাহিত করবে। সরকারি অন্যান্য প্রণোদনার মতো প্রয়োজনীয় সহযোগিতাও দেবে।
বগুড়ার এসডি পোল্ট্রি ফার্মের মালিক শফিউল আলম জাগো নিউজকে বলেন, আমার খামারে ব্রয়লার আছে তিন হাজার, আরেকটিতে পাঁচ হাজার। সবমিলে আমার আট হাজার ব্রয়লারের খামার। আমি ২০০৮ সাল থেকে এই ব্যবসায় এসেছি। আমরা পোল্ট্রির বর্জ্য জৈব সার হিসেবে ব্যবহার করছি। অনেক সময় কেউ কেউ মাছের খাবার হিসেবে নেয়। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জৈব সার হিসেবেই ব্যবহার হয়। বড় কোম্পানিগুলো বিদ্যুৎসহ অনেক কিছু করছে এই বর্জ্য দিয়ে। তবে আমাদের তো সেটি সম্ভব নয়। কারণ সেটি করতে আমাদের অনেক ইনভেস্ট করতে হবে। কিন্তু পোল্ট্রির বাজার এখন তেমন ভালো নয়। ফিডের দাম বাড়ছে, বছরের ব্যবধানে ফিডের দাম দুই হাজার ২৫০ টাকা থেকে এখন তিন হাজার ৭০ টাকা হয়েছে। ফিডের দাম নাকি আরও বাড়বে। এ অবস্থায় ব্যবসা করাই কঠিন হচ্ছে। বর্জ্য দিয়ে ভিন্ন কিছু করার জন্য টাকা ইনভেস্ট করবো কীভাবে যেখানে কোনো নিশ্চয়তা নেই।
বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রি সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) সভাপতি মশিউর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, আমি আমার প্রত্যেকটি কোম্পানির বর্জ্য রিসাইকেল করে আবার সেটি ব্যবহার করি। আমাদের যারা মেম্বার সবাইকেই এটি বলছি, এটি না করলে পরিবেশ তো দূষণ হবেই, নিজের কোম্পানিরও ক্ষতি হবে। কারণ আমার ময়লা থেকে নিজের ফার্মই অ্যাফেক্টেড হতে পারে।
‘আমি গত ১৭ বছর আগেই বর্জ্য থেকে পাওয়ার প্ল্যান্ট করেছি। সবারই এটি করা উচিত। গত ১৭ বছরে আমার কোম্পানির কোনো বর্জ্য কোথাও ফেলিনি। কোম্পানির বর্জ্য রিসাইকেল করে ফার্টিলাইজার বানাই ও পাওয়ার বানাই। এর মধ্যে ফার্টিলাইজার মার্কেটে বিক্রি করি আর ইলেক্ট্রিসিটি নিজে ব্যবহার করি। কাজেই পোল্ট্রি ফার্মের বর্জ্য বলতে কিছু নেই, শুধু চিন্তার ব্যাপার এবং ইনভেস্টমেন্ট করার ব্যাপার।’
তিনি আরও বলেন, যাদের ছোট ফার্ম তারা বায়োগ্যাস তৈরি করতে পারে। ছোট করেই করতে পারে। তার ফার্মের বর্জ্যের জন্য অন্যরা কেন সাফার করবে। আমি কোথায় বাথরুম করবো সেটার জন্য সরকারের উদ্যোগ দরকার নেই। আমি মনে করি খামারি যত ছোটই হোক তার স্কেলে সেই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না করলে সে ভালো ব্যবসায়ী হতে পারবে না। আগে তাকে ময়লা কী করবে, কীভাবে ব্যবস্থাপনা করবে সেটি ভেবে ব্যবসায় নামা উচিত। তা করা না হলে তিনি নিজের ফার্মেরই ক্ষতি করবে। এটি করলে তার অনেক খরচ কমে যাবে। এগুলো আমরা ভাবি না, তবে ভাবা উচিত।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. মনজুর মোহাম্মদ শাহজাদা জাগো নিউজকে বলেন, পোল্ট্রির বর্জ্য নিয়ে আমরা কাজ করতে চাচ্ছি। কারণ আমাদের সবকিছুই থাকবে। আমাদের হাঁস-মুরগিসহ সবকিছুই লালন-পালন করতে হবে। কিন্তু এটা যেন জনসাধারণের ভোগান্তির কারণ না হয়, সেই জিনিসটাই আমরা মাথায় রাখছি। এটি নিয়ে প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্প (এলডিডিপি) থেকে ভালো একটি কাজ আমরা শুরু করবো। বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট ছাড়াও আমরা নরমালি এই বর্জ্য থেকে জৈব সার তৈরি করতে পারি। কারণ জৈব সারে মাটির ফার্টিলিটি বাড়ে। জৈব সার হিসেবে ব্যবহারের জন্য কিছু প্রযুক্তি নিয়েছি। সরকারি ফার্মগুলোতে বর্জ্য ও পানি দুইভাবে কালেক্ট হয়। এটা সরাসরি আমরা মাঠে দিয়ে দিচ্ছি।
ছোট খামারগুলো বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তাদের আমরা কীভাবে শৃঙ্খলায় আনতে পারি সেজন্যই এলডিডিপি প্রকল্প থেকে কাজ করা হচ্ছে। পুরো বিষয়টি আমরা এর আয়ত্তে নিয়ে আসবো। মানুষের অসুবিধা সৃষ্টি হলে সেটি কিন্তু তারা করতে দেবে না। সেজন্য বর্জ্য ব্যবস্থাপনা যেন সুন্দর হয় সেজন্য আমরা কাজ করছি। আমাদের প্রান্তিক পর্যায়ে যেতে হবে, কারণ প্রান্তিক পর্যায়ের হেলথ কনসার্ন আছে। নিজেরাও ঠিক থাকতে হবে, পরিবেশও ঠিক রাখতে হবে। এসব বিষয় এনশিওর করতে পারলেই আমরা সুস্থ থাকবো। আমাদের সবার টার্গেট সেটাই।
আইএইচআর/আরএডি/এএসএ/এএসএম