‘উচ্চবিত্ত ছাড়া সবাই নিদারুণ কষ্টে আছে’
অডিও শুনুন
দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। মাথাপিছু আয় বাড়ছে। বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা নিয়ে প্রশংসাও মিলছে বিশ্ববিমহলে। উন্নয়নের নানা ফিরিস্তি তুলে আলোচনা করছেন সরকারের মন্ত্রী-আমলারা।
তবে উন্নয়নের এমন যুগে অন্য আলোচনাও গুরুত্ব পাচ্ছে। সমাজ পর্যবেক্ষকদের মতে, বৈষম্য বাড়ছে অনবরত। গরিব মানুষের সংখ্যা বাড়ছে হু হু করে। স্বল্পমূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য বিতরণের (টিসিবি) গাড়ির কাছে মানুষের লাইন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। এক বোতল ভোজ্যতেলের জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ছে মানুষ।
দ্রব্যমূল্যের এমন ঊর্ধ্বগতি, মানুষের বেঁচে থাকা, রাষ্ট্র-সরকারের দায় প্রভৃতি প্রসঙ্গে জাগো নিউজ মতামত চেয়েছে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অনারারি ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এবং সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের চেয়ারপারসন ড. হোসেন জিল্লুর রহমানের কাছে।
সরকার সব কিছুর গড় হিসাব দেখাচ্ছে উল্লেখ করে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, মানুষের মাথাপিছু আয় বাড়ছে বটে। কিন্তু গরিব মানুষের আয় সরকার দেখাচ্ছে না। সরকারের দেওয়া হিসাবটা আমাদের সত্য তথ্য দেয় না।
নিত্যপণ্যের বাজারে আগুন, টিসিবির পণ্যই এখন দরিদ্রদের ভরসা
‘সবচেয়ে খারাপ অবস্থা হচ্ছে, সরকার মূল্যস্ফীতির যে তথ্য দিচ্ছে, তা অপতথ্যে পরিণত হয়েছে। যে তথ্যের সঙ্গে বাস্তবতার কোনো সম্পর্কই নেই।’
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, সরকারের দেওয়া তথ্যে নিম্ম, নিম্ন-মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য কোনো সুরক্ষার কথা নেই। এই মানুষদের ক্রয়ক্ষমতাকে সুরক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে রাষ্ট্রকেই।
‘ক্রয়ক্ষমতা সুরক্ষা দেওয়ার দুটি পদ্ধতি। প্রথমত, এই মানুষেরা কোন কোন পণ্য ব্যবহার করে থাকেন, তা নির্ধারণ করে তার ওপর থেকে কর বা আমদানি শুল্ক কমিয়ে আনা। আমদানিকারকদের সঙ্গে আলোচনা করে এলসি মার্জিনটাও কমানো দরকার। দ্বিতীয়ত, এসব মানুষের আয় বাড়াতে এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির জন্য কর সুবিধা (রেয়াত) দেওয়া উচিত। গত বাজেটের আগেও আমরা বলেছি, সরকার যেসব জায়গায় কর রেয়াত দিচ্ছে, তা প্রকৃত কর্মসংস্থানের সঙ্গে যুক্ত কি না, তা ভেবে দেখতে হবে। কর সুবিধা প্রকৃত কর্মসংস্থানের সঙ্গে যুক্ত না করলে সাধারণ মানুষের কোনো উপকারে আসবে না।’
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, পুষ্টি চাহিদা পূরণে আমরা স্কুলে বাচ্চাদের খাবার খাওয়ানোর ওপর আরও জোর দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছি। সরকারি-বেসরকারি সব স্কুলে এই ব্যবস্থা করতে হবে। গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবার মান বাড়ানো, টাকার মূল্যমান স্থিতিশীল রাখা, গরিব মানুষের ঋণ মওকুফ করার মতো বিভিন্ন প্যাকেজ নিয়ে আসতে হবে। সরকার হয়তো বিচ্ছিন্নভাবে নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে, কিন্তু বেশ বিলম্বে এবং অপ্রতুল বলে মনে করি। রমজানকে সামনে রেখে এটি আরও বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। ক্ষমতায় থাকলে অন্যের ক্রয়ক্ষমতাটা অনুধাবন করার মানসিকতা আর থাকে না। এই মানসিকতার পরিবর্তন জরুরি।
টিসিবি পণ্য কিনতে এসে ক্ষোভ ঝাড়ছেন অনেকে
বাজার পরিস্থিতি এবং মানুষের ক্রয়ক্ষমতা নিয়ে সরকারের দেওয়া তথ্যকে বিভ্রান্তিকর মনে করেন ড. হোসেন জিল্লুর রহমান। এই বিশ্লেষক বলেন, সরকার ক্রয়ক্ষমতা বাড়ার যে তথ্য দিচ্ছে, তা আংশিক অথবা অসত্য। মনে রাখতে হবে—আয় আর ক্রয়ক্ষমতা এক বিষয় নয়। আমরা আয় এবং ক্রয়ক্ষমতাকে সমার্থক শব্দ হিসেবে চিনতে অভ্যস্ত ছিলাম। আয় এবং ক্রয়ক্ষমতা যে এক জিনিস নয়, তা এখন ভালো করে বোঝা যাচ্ছে।
এই অর্থনীতি বলেন, দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক বৃদ্ধিতে উচ্চবিত্ত ছাড়া সবাই নিদারুণ কষ্টে আছে। অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির জন্য বৈশ্বিক পরিস্থিতি—যেমন করোনা মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যকার যুদ্ধ কিছুটা দায়ী। কিন্তু এর জন্য প্রধানত রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনাকেই দায়ী করা যায়। অধিক মুনাফা লাভের সুযোগ রাষ্ট্রই তৈরি করে দিচ্ছে এবং ব্যবস্থা নিতে একেবারে নির্বিকার। বাণিজ্যমন্ত্রী (টিপু মুনশি) তো বলেই দিলেন ‘আমার কিছু করার নেই’। তাহলে আর কার কী করার আছে!
‘মানুষের এখন কষ্ট দুটি জায়গায়। একটি হচ্ছে সরাসরি কষ্ট। যেমন, পুষ্টিমান খাদ্য তালিকা থেকে বাদ দিতে হচ্ছে। কম খেতে হচ্ছে। ইচ্ছা হলেও মানুষ পরিমাণ মতো খেতে পারছে না। খাবার সীমিত করার কষ্ট মারাত্মক। আরেকটি কষ্ট হচ্ছে, সরকারের মন্ত্রীদের উপহাসমূলক কথাবার্তা। মানুষের কষ্ট কিছুটা লাঘব হয় যদি সে বুঝতে পারে যে, সরকার পরিস্থিতি সামলে আনতে চেষ্টা করছে। এটি মানসিক শান্তির ব্যাপার। কিন্তু সরকারের মধ্যে কষ্টটা স্বীকার করার কোনো মানসিকতা নেই। অর্থাৎ অনেকটা ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’। এই পরিস্থিতি জনমনে অবশ্যই মনস্তাত্বিক পরিবর্তন আনে এবং সেটা নেতিবাচক।’
বাজারদর ক্রয়ক্ষমতার বাইরে, সেজন্য দীর্ঘ হচ্ছে টিসিবির লাইন
ড. হোসেন জিল্লুর আক্ষেপ করে বলেন, সরকারের দায়িত্বশীল তথ্যমন্ত্রী বললেন, ‘একজন শ্রমিক দৈনিক ২০ কেজি চাল ক্রয় করার ক্ষমতা রাখেন’। অন্যজন বললেন, ‘অজান্তেই আমরা বড়লোক হয়ে যাচ্ছি।’ তার মানে এই তথ্যগুলো ধোঁয়াশা তৈরি করে। কারণ বাস্তবের সঙ্গে তো মিল নেই। মন্ত্রীদের কথা সত্য হলে মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকছে কেন পাঁচ কেজি চালের জন্য? বাজারে গিয়ে চোখের জল ফেলছে কেন? ভোজ্যতেলের জন্য এই হাহাকার কেন? মিল মালিকরা দুষছেন পাইকারি ব্যবসায়ীদের। ব্যবসায়ীরা দুষছেন মিল মালিকদের। তাহলে দোষ তো কারও না কারও আছেই। সরকার ব্যবস্থা নিচ্ছে না কেন? মনিটরিং করা তো সরকারের দায়িত্ব।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এই উপদেষ্টা বলেন, মানুষ কষ্টের মধ্যে আছে এটি একেবারেই পরিষ্কার। কিন্তু এই কষ্ট নিয়ন্ত্রণ করে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর পরিবর্তে আরও উপহাসমূলক কথা বলছেন সরকারের লোকেরা। এতে মানুষের মধ্যে কষ্ট আর ক্ষোভ বেড়ে যাচ্ছে। হোটেলে ফোঁটায় ফোঁটায় সয়াবিন তেলে পরোটা ভাজা হচ্ছে, এই চিত্র তো এখন অবাস্তব নয়। এটি স্বীকার করে নিলে মানুষের কষ্ট কিছুটা কমতেও পারে।
এএসএস/এইচএ/এএসএম