পরিচালকদের এককভাবে ২, সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণ করতেই হবে

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৪:২৩ পিএম, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির পরিচালকদের এককভাবে দুই শতাংশ এবং সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণ করতেই হবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম।

রোববার রাজধানীর একটি হোটেলে ‘শেয়ারবাজারে ভালো কোম্পানির তালিকাভুক্তির প্রতিবন্ধকতা ও সমাধানের উপায়’ শীর্ষক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন। বিজনেস আওয়ার টোয়েন্টিফোর ডটকম এই সেমিনারের আয়োজন করে।

বিএসইসি চেয়ারম্যান বলেন, শেয়ার ধারণের ক্ষেত্রে দুই শতাংশ ও ৩০ শতাংশের ক্ষেত্রে আমরা অটল। এটা ঠিক রাখতেই হবে। আপনি একটি কোম্পানির পরিচালক হবেন, কোম্পানি চালাবেন কিন্তু দুই শতাংশ শেয়ার রাখবেন না, এটা কেমন কথা? তাহলে আপনার ইন্টারেস্ট কি? খালি বেতন-ভাতা নেওয়া, সুবিধা নেওয়া? আপনি যদি সেটার পার্ট না হন, তাহলে অন্যদের স্বার্থ রক্ষা করবেন কীভাবে? দুই শতাংশ শেয়ার ধারণ, সেটা করতেই হবে।

তিনি বলেন, কোম্পানির পরিচালকদের সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণের বিষয়টি অনেকে বলে ঠিক না। কিন্তু আমরা সেটার বিষয়ে একমত না। ৩০ শতাংশ থাকতেই হবে, না থাকলে ৭০ শতাংশ যারা আছে তারা তো জড়িত না। তাদের স্বার্থ রক্ষা কীভাবে হবে? আমাদের সবার স্বার্থ দেখতে হবে। একদিক দেখলে তো হয় না।

শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম বলেন, পুঁজিবাজারের ৬০ বছর হয়ে গেছে। এই ৬০ বছরে কিছু হয়নি কেন? ৬০ বছরে আমরা মানুষের মাইন্ডসেট চেঞ্জ করে পারিনি কেন? ৬০ বছরে কেন সবাই মানি-মার্কেটমুখী ছিল? তাই হঠাৎ করে অনেক কিছু চেঞ্জ করতে গিয়ে আমাদের আনেক রকমের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। কিন্তু সেই চ্যালেঞ্জগুলো আমরা খুবই সহজভাবে নিয়েছি এবং ভালো রেজাল্ট পাচ্ছি।

তিনি বলেন, আমাদের দেশে বর্তমানে যে জনসংখ্যা, এখানে কর্মসংস্থান হচ্ছে আমাদের একমাত্র অগ্রাধিকার। ব্যবসা-বাণিজ্যে কিন্তু ভালোও হবে লসও হবে। লাভ-লস যাই হোক, সেটা আমাদের দেশেই থাকে। কারো লাভ, কারো লস। কিন্তু কর্মসংস্থান সবচেয়ে বেশি জরুরি। এটার জন্য আমাদের এখন সিএমএসএমই-কে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হচ্ছে। আমরা আমাদের এসএমই খাতকে গুরুত্ব দেইনি। এসএমই খাতকে ৫০ বছর আগে গুরুত্ব দিলে এই প্রতিষ্ঠানগুলো আজকে মিডিয়াম থেকে লার্জ হতো।

এ সময় ব্যাংক খাতের ঋণ পদ্ধতি নিয়েও কথা বলেন বিএসইসি চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, দেশের নন-পারফর্মিং লোন কেন এত? লোন প্রভিশনিং সিস্টেম যদি ব্যাংকিং সিস্টেমে না রাখতাম বা লোন প্রভিশনিং যদি বলতাম একবারের বেশি করা যাবে না, আজকে বাংলাদেশে কতগুলো ব্যাংক বন্ধ হয়ে যেত? সেদিন একটা ব্যাংকের দেখলাম ৫০-৯০ শতাংশ পর্যন্ত ক্লাসিফাইড। যদি সত্যিই রিসিডিউল করার সুযোগ না থাকতো, তাহলে আরও কতগুলো ব্যাংকের এ অবস্থা হতো।

তিনি বলেন, ক্লাসিফিকেশন লোনটা আমাদের দেশের জন্য ব্যবসাবান্ধব না। ব্যবসা করতে সবাই তো আর নিয়ত খারাপ করে আসে না। ব্যবসায় লাভ-ক্ষতি আছে। কিন্তু সে আর পারে না। তখন সে নিজেও বিপদে পড়ে, ব্যাংককেও বিপদে ফেলে। আলটিমেটলি ক্লাসিফিকেশন লোনের কারণে তার জেল, জরিমানা, ব্যবসা বন্ধ, সবাইকে নিয়ে সমস্যায় পড়া এগুলোই হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, হয়তো আমি একটা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত আছি, যেটার সঙ্গে আমার ম্যানেজমেন্টের কোনো সম্পর্ক নেই, আমি হয়তো একজন পরিচালক। সেই প্রতিষ্ঠান ক্লাসিফাইড হলে আমার ভালো ১০টা প্রতিষ্ঠান লাভজনক, সেগুলোও কিন্তু ক্লাসিফাইড। এসব কারণে দেশের মানিমার্কেটে বড় ধরনের একটা অরাজকাত হয়ে... নিজেরাও বিপদে পড়েছে, ব্যাংকিং সিস্টেমকেও বিপদে ফেলেছে। আমাদের অনেক আগেই উচিত ছিল বিনিয়োগকারীদের শিক্ষা দেওয়া।

বিএসইসি চেয়ারম্যান বলেন, আইপিও বাণিজ্য, প্লেসমেন্ট বাণিজ্য এগুলো বহু হয়েছে দেশে। এখন আমরা এটাকে মোটামুটি একটা অবস্থানে নিয়ে আসছি। কেউ আইপিও বাণিজ্য করে বিনিয়োগকারীদের ঠকিয়ে টাকা নিয়ে চলে যাবে, এটা মোটামুটি আমরা বন্ধ করতে পেরেছি। সেই সঙ্গে কোনো অডিটর এখন সাহস পাবে না ভ্রান্ত-ভুল রিপোর্ট দিয়ে আইপিওতে বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করে টাকা নিয়ে চলে যেতে। যেসব চাটার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট এসব অপকর্মে লিপ্ত তাদের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি।

শিগগির পুঁজিবাজারে ভালো ভালো কোম্পানির আইপিও আসবে জানিয়ে তিনি বলেন, তিনটা ভালো কোম্পানি আইপিওতে আসার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। নেক্সট কোয়ার্টার থেকেই আপনারা দেখতে শুরু করবেন যাদের আপনারা চাচ্ছে, তারা আস্তে আস্তে আসতে শুরু করেছে। ভালো, সুস্থ একটা পরিবেশ যখন পাওয়া যাবে, তখন অন্যরাও উৎসাহিত হবে। চেকলিস্ট অনুযায়ী কাগজপত্র ঠিকমতো জমা দিলে আমরা ভালো কোম্পানির আইপিও সাতদিন থেকে সর্বোচ্চ চার সপ্তাহের মধ্যে অনুমোদন দিয়ে দেবো। অনেকগুলো কোম্পানির আইপিও আমরা দুই থেকে চার সপ্তাহের মধ্যে অনুমোদন দিয়েছি।

বিজনেস আওয়ার টোয়েন্টিফোর ডটকমের উপদেষ্টা আকতার হোসেন সান্নামাতের সভাপতিত্বে এবং সম্পাদক ও প্রকাশক আমিরুল ইসলাম নয়নের সঞ্চলনায় অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী এবং বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) সভাপতি মুহাম্মদ ছায়েদুর রহমান।

ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, আমাদের অর্থনীতির সঙ্গে পুঁজিবাজারের কোনো মিল খুঁজে পাই না। ১৯৯৬ বা ২০১০ সালে যখন পুঁজিবাজারে ধস হয় তখন আমাদের অর্থনীতি কিন্তু খারাপ ছিল না। শুধু অর্থনৈতিক কারণে ধস হয়নি। আবার অর্থনীতি ভালো হলে পুঁজিবাজার চাঙা হয়েছে, নতুন নতুন কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়েছে, তা কিন্তু নয়।

তিনি বলেন, আমরা অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছি কিন্তু পুঁজিবাজারে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি বললেই চলে। গত কয়েক বছর যেসব কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে সেগুলোর মধ্যে ভালো কোম্পানি কম। অথচ পুঁজিবাজারের বর্তমান যে অবস্থা, বাজারের মূল সমস্যাই হলো আপনি কোথায় ইনভেস্ট করবেন। ইনভেস্ট করার মতো কোম্পানিতো সামান্য কিছু। ভালো ইন্ডাস্ট্রিগুলো ভালো ব্যবসাগুলো লিস্টিং থেকে দূরে আছে।

ভালো কোম্পানি পুঁজিবাজারে না আসার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ব্যাংক থকে এখনো পর্যন্ত ঋণ পাওয়া খুবই সহজ। একটা ভালো কোম্পানিকে ঋণ দেওয়ার জন্য অনেক ব্যাংক দ্বারে দ্বারে ঘুরছে। যতদিন ব্যাংকের অতিরিক্ত তারল্য থাকবে এবং ব্যাংক থেকে সহজে ঋণ পাওয়া যাবে, ততদিন ভালো কোম্পানি পুঁজিবাজারে আসবে না।

সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন দ্য ইনস্টিটিউট অব কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্টেন্টস অব বাংলাদেশের (আইসিএমএবি) প্রেসিডেন্ট মো. মামুনুর রশীদ।

তিনি বলেন, গত ১০ বছর দেশের অর্থনীতি ৬ শতাংশের বেশি হারে বেড়েছে এবং নিয়মিত মাথাপিছু আয় বেড়েছে। এতে আমাদের জিডিপি পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অবস্থানে উঠে এসেছে। এই উন্নতির মধ্যেও আমরা শেয়ারবাজারে পিছিয়ে রয়েছি। এর পেছনে শেয়ারবাজারে আসার থেকে না আসা কোম্পানির প্রকৃত অর্থে রাজস্ব সুবিধা বেশি হওয়া অন্যতম কারণ। এই সমস্যা কাটিয়ে তুলতে অতালিকাভুক্ত কোম্পানির রাজস্ব ফাঁকির রাস্তা বন্ধ করতে হবে।

তিনি আরও বলেন, দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের প্রধান উৎস শেয়ারবাজার হলেও বাংলাদেশ এক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে। যা ২০২০ সালে বাংলাদেশে মোট অর্থায়নের মাত্র দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ শেয়ারবাজার থেকে অর্থায়নের তথ্যে খুব ভালো করেই উপলব্ধি করা যায়। যেখানে ৯৯ দশমিক ৯৩ অর্থায়ন করা হয়েছে ব্যাংক থেকে। ওই বছরে মোট অর্থায়নের মধ্যে ব্যাংক থেকে ১০ লাখ ৯৪ হাজার ৭ কোটি টাকা ও শেয়ারবাজার থেকে ৭৬৮ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছিল।

এমএএস/এমএইচআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।