শেয়ারবাজারে ‘আলাদিনের চেরাগ’ বিএসসি

সাঈদ শিপন
সাঈদ শিপন সাঈদ শিপন , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৫:১৩ পিএম, ০৮ জানুয়ারি ২০২২

শেয়ারবাজারের কিছু বিনিয়োগকারীর কাছে অনেকটাই রূপকথার ‘আলাদিনের চেরাগ’ হিসেবে দেখা দিয়েছে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন (বিএসসি)। মাত্র ১০ কার্যদিবসেই কোম্পানিটির শেয়ার দাম বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে।

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত ২৩ ডিসেম্বর কোম্পানিটির শেয়ার দাম ছিল ৪৯ টাকা ৪০ পয়সা, যা টানা বেড়ে ৬ জানুয়ারি লেনদেন শেষে দাঁড়িয়েছে ১০৪ টাকা ৬০ পয়সায়। অর্থাৎ মাত্র ১০ কার্যদিবসে প্রতিষ্ঠানটির প্রতিটি শেয়ারের দাম বেড়েছে ৫৫ টাকা ২০ পয়সা বা ১১১ দশমিক ৭৪ শতাংশ।

অন্যভাবে বললে অর্ধ-মাসের কম সময়ের মধ্যে কোম্পানিটির শেয়ার দাম বেড়ে দ্বিগুণের বেশি হয়েছে। এ হিসাবে ২৩ ডিসেম্বর যে বিনিয়োগকারীর কাছে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের ১০ লাখ টাকার শেয়ার ছিল, তিনি যদি ওই শেয়ার ধরে রাখেন তাহলে সেই শেয়ারের দাম এখন ২১ লাখ ১৩ হাজার টাকা। অর্থাৎ ১০ লাখ টাকা ১৪ দিন খাটিয়েই লাভ পাওয়া যাচ্ছে ১১ লাখ ১৩ হাজার টাকা। এ যেন আলাদিনের চেরাগই।

কোম্পানিটির শেয়ারের এ দাম বাড়ার প্রবণতা শুরু হয় ২০২১ সালের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিন মাসের আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশের পর থেকে। গত ২৬ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠানটি আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এর পর থেকেই কোম্পানিটির শেয়ার দাম পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটতে থাকে। ১৯৭৭ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া কোম্পানিটির শেয়ার দাম এর আগে কখনো এমন উচ্চতায় পৌঁছায়নি।

কোম্পানিটি ২০২১ সালের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিন মাসের ব্যবসায় শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে ৪ টাকা ৩৪ পয়সা। আগের হিসাব বছরের একই সময়ে শেয়ারপ্রতি মুনাফা হয় মাত্র ৫৮ পয়সা। অর্থাৎ আগের বছরের তুলনায় কোম্পানিটির মুনাফা বেড়েছে ৬৪৮ শতাংশ। এটাকেই হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে একটি চক্র কোম্পানিটির শেয়ারে এমন অস্বাভাবিক দাম বাড়িয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

অন্যদিকে, কোম্পানিটির শেয়ার দাম বাড়ার চিত্র দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেছে পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) দায়িত্বশীলরা। এজন্য কোম্পানিটির শেয়ারের দাম বাড়ার বিষয়টি তদন্ত করা হবে বলে জাগো নিউজকে জানিয়েছেন বিএসইসির কমিশনার অধ্যাপক ড. শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ।

তিনি জাগো নিউজকে বলেন, বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের শেয়ার দাম বাড়ার বিষয়টি আমাদের নজরেও এসেছে। যেভাবে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম বেড়েছে এবং যেহারে লেনদেন হচ্ছে তাতে আমরাও বিস্মিত। দাম বাড়ার বিষয়টি আমরা তদন্ত করে দেখবো।

বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের লভ্যাংশের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদ সর্বশেষ ২০২০ সালে বিনিয়োগকারীদের ১০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে। তার আগে ২০১৯ সালে ১০ শতাংশ, ২০১৮ সালে ৬ শতাংশ এবং ২০১৭ সাল ও ২০১৫ সালে ১০ শতাংশ করে নগদ লভ্যাংশ দেয়। ২০১৬ সালে ১২ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ দেয়।

রাষ্ট্রায়ত্ত এ প্রতিষ্ঠানটির পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ ১৫২ কোটি ৫৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা। অনুমোদিত মূলধন ১ হাজার কোটি টাকা। কোম্পানিটির মোট শেয়ারের সংখ্যা ১৫ কোটি ২৫ লাখ ৩৫ হাজার ৪০টি। প্রতিটি শেয়ারের ফেস ভ্যালু ১০ টাকা।

এ শেয়ারের মধ্যে বর্তমানে ৫২ দশমিক ১০ শতাংশ শেয়ার রয়েছে সরকারের কাছে। বাকি শেয়ারের মধ্যে ২৩ দশমিক ৬০ শতাংশ শেয়ার রয়েছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে আছে ২৪ দশমিক ৩০ শতাংশ।

অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানটির মোট শেয়ারের চার ভাগের এক ভাগেরও কম রয়েছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের আয় বাড়াকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে কোনো চক্র শেয়ার দাম বাড়াচ্ছে কি না তা ক্ষতিয়ে দেখা উচিত। বিএসইসির উচিত দ্রুত বিষয়টি খতিয়ে দেখা।

এ বিষয়ে ডিএসইর এক সদস্য বলেন, বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের শেয়ার দাম যেভাবে বেড়েছে তাকে স্বাভাবিক বলা যায় না। এর পেছনে নিশ্চয়ই কোনো চক্র আছে। মাত্র ১০ কার্যদিবসেই শেয়ারের দাম বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। এর মধ্যে সাতদিনইর দাম বাড়ার সর্বোচ্চ সীমা স্পর্শ করেছে। পেছনে কোন সিন্ডিকেট না থাকলে এভাবে শেয়ারের দাম বাড়তে পারে না।

বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী জাগো নিউজকে বলেন, মাত্র ১০ দিনে শেয়ারের দাম বেড়ে দ্বিগুণ হওয়াটা কিছুতেই স্বাভাবিক নয়। বোঝাই যাচ্ছে ম্যানিপুলেট (কারসাজি) করেই এ দাম বাড়ানো হয়েছে। একটি ভালো সংবাদ পুঁজি করে এ দাম বাড়ানো হয়েছে। এজন্য বিনিয়োগকারীরাও দায়ী। তারা কেন এ দামে শেয়ার কিনছেন। ভালো সংবাদের ওপর ভিত্তি করে শেয়ারের দাম ১০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে। কিন্তু একশ শতাংশ দাম বাড়তে পারে না। এটাকে (আয় বাড়া) ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে প্রচার করে দাম বাড়ানো হচ্ছে।

তিনি বলেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থা ম্যানিপুলেশন বন্ধ করতে পারছে না। এজন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা দায়ী। তেমনি বিনিয়োগকারীরাও দায়ী। তারা কেন এ দামে কিনছেন। আমি মনে করি, নিয়ন্ত্রক সংস্থা ইন-অ্যাকটিভ (নিষ্ক্রিয়)। ম্যানিপুলেশন বন্ধে তারা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়নি। শেয়ারের দাম কেন এমন বাড়ছে তা নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি এবং স্টক এক্সচেঞ্জ কর্তৃপক্ষের ক্ষতিয়ে দেখা উচিত।

এমএএস/এমএএইচ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।