‘কালো টাকা বৈধ করার সুযোগ সমর্থন করি না, আমিও দেইনি’

সাঈদ শিপন
সাঈদ শিপন সাঈদ শিপন , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১০:০১ পিএম, ৩০ মে ২০২১
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম

আগামী অর্থবছরের (২০২১-২২) বাজেটে কালো টাকা বৈধ করার সুযোগ না দেয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। তিনি বলেছেন, ‘আমি কালো টাকা বৈধ করার সুযোগ দেয়া সমর্থন করি না। অনেকে বলে, আমি কালো টাকা বৈধ করার সুযোগ দিয়েছিলাম। এটা সত্য না। কালো টাকা বৈধ করার সুযোগ দেয়া হলে এ ধরনের উপার্জনের প্রবণতা বেড়ে যায়।’

আসন্ন নতুন (২০২১-২২) অর্থবছরের বাজেট নিয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে আলাপকালে এসব কথা বলেন বিশিষ্ট এই অর্থনীতিবিদ। নতুন বাজেট কেমন হওয়া উচিত এবং বাজেটে কোন বিষয়গুলোকে বেশি গুরুত্ব দেয়া উচিত তা নিয়েও কথা বলেন ২০০৭-০৮ সালের নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করা মির্জ্জা আজিজুল।

তিনি বলেন, ‘কালো টাকা বৈধ করার বিষয়টি আমি সমর্থন করি না। অনেকে বলে আমিও নাকি দিয়েছিলাম। আমি দেইনি। আমি যেটা করেছিলাম সেটা হলো—কেউ বৈধ আয় ঘোষণা না দিলে, সেক্ষেত্রে তাদের ১০ শতাংশ জরিমানা দিয়ে ঘোষণা দেয়ার সুযোগ দেয়া হয়েছিল। যে বছর তারা ঘোষণা দেয়নি, সেই বছরের ট্যাক্সের সঙ্গে অতিরিক্ত ১০ শতাংশ জরিমানা দিয়ে ঘোষণা করতে পারতো। আর কেউ ঘোষণা দিলে সেই টাকা বৈধ না অবৈধভাবে উপার্জন করা হয়েছিল, তা পরীক্ষা করার অধিকার ছিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর)।’

মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘এখন যেটা হয়, এনবিআর কোনো প্রশ্ন করবে না এবং ১০ শতাংশ ট্যাক্স দিয়েই টাকা বৈধ করে ফেলা যাবে। অপরদিকে যারা আইন মেনে ট্যাক্স দেয় তাদের ২৫ শতাংশ ট্যাক্স দিতে হয়। কাজেই এটা বৈষম্য। এতে করে কালো টাকা উপার্জনের প্রবণতা বেড়ে যায় এবং দুর্নীতি বাড়ে। প্রতিবছর কালো টাকা বৈধ করার সুযোগ দেয়া হচ্ছে। সুতরাং কালো টাকা উপার্জনকারীদের আশা থাকে পরের বছরও তা বৈধ করার সুযোগ থাকবে। কাজেই এটা বন্ধ করা উচিত।’

আগামী অর্থবছরের বাজেটে কোন বিষয়গুলোর ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়া উচিত? জানতে চাইলে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘আগামী অর্থবছরের বাজেটে স্বাস্থ্য এবং সামাজিক সুরক্ষা খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। চলতি অর্থবছরে স্বাস্থ্যখাতে যে বরাদ্দ ছিল, তার বড় একটা অংশ অব্যয়িত রয়ে গেছে। অর্থবছর শেষ হতে এখনো এক মাস বাকি আছে, তারপরও স্বাস্থ্যখাতে যে ব্যয় হয়েছে, তা মোটেও সন্তোষজনক নয়।’

তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্যখাতের মতো সামাজিক নিরাপত্তাখাতে বরাদ্দের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বরাদ্দের চেয়ে ব্যয়ের পরিমাণ আশঙ্কাজনক কম। এ ক্ষেত্রে দেখা যায়, যাদের সামাজিক নিরাপত্তা ব্যয়ের আওতায় আসার কথা, তারা না এসে যারা তালিকা করে তাদের আত্মীয়-স্বজন বা মনোনীত ব্যক্তিরা সামাজিক নিরাপত্তার সুবিধা ভোগ করে। এমনও দেখা গেছে, মৃত ব্যক্তির নামেও সামাজিক নিরাপত্তায় বরাদ্দের টাকা ব্যয় হয়েছে।’

স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তার পাশাপাশি কৃষিখাতেও গুরুত্ব দেয়া উচিত উল্লেখ করে বিশিষ্ট এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে সরকারের অনেক প্রকল্প আগে থেকেই চলমান আছে। কৃষকরা যেন কৃষি যন্ত্রপাতি কিনতে পারে সেজন্য কৃষকদের স্বল্প সুদে ঋণ দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘সরকার ব্যবসায়ীদের যে প্রণোদনা দিচ্ছে তার যথাযথ বাস্তবায়ন হওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে শ্রমঘন প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের শ্রমিকদের গুরুত্ব দেয়া উচিত। কিন্তু চলতি অর্থবছরে ব্যবসায়ীদের জন্য বরাদ্দের পুরো অর্থ ব্যয় হয়নি। এটা অবশ্যই দুঃখজনক।’

jagonews24

কালো টাকা বৈধ করার সুযোগ নিয়ে সবসময়ই আলোচনা হয়েছে

বাজেট কেমন হওয়া উচিত জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আগামী অর্থবছরের বাজেট অবশ্যই সম্প্রসারণমূলক হতে হবে। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই ঘাটতি বাজেট হবে। ঘাটতির মাত্রা জিডিপির ৬ শতাংশের বেশি হলেও অসুবিধা নেই। তবে ঘাটতির মাত্রা জিডিপির ৭ শতাংশের বেশি হওয়া উচিত হবে না। ঘাটতি অর্থ আসবে ঋণের মাধ্যমে। এ ঋণের সূত্র মোটা দাগে হবে তিনটি-

এক. বৈদেশিক ঋণ; যা আমরা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান থেকে পেয়ে থাকি। যেমন বিশ্ব ব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, জাপানের জাইকার দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা ইত্যাদি। বৈদেশিক সাহায্যের ক্ষেত্রে খুব একটা সমস্যা নেই। কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে বিদেশি অনেক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের প্রতি বেশ আগ্রহের সঙ্গেই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে বিদেশি উৎস থেকে ঋণ পেতে খুব একটা অসুবিধা হচ্ছে না আমাদের।

jagonews24

এবার স্বাস্থ্যখাতে বাড়তি বরাদ্দ রাখার কথা বলা হচ্ছে বিভিন্ন মহল থেকে

দুই. অভ্যন্তরীণ ব্যাংক থেকে ঋণ; এসব ঋণ মূলত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকেই নেয়া হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে খুব একটা ঋণ নিতে দেখা যায় না।

তিন. সরকারি সঞ্চয়পত্র; সরকারি সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে সাধারণ মানুষ থেকে ঋণ নেয়া হয়। সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। এর কারণ হলো, মানুষ ব্যাংকে অর্থ রাখতে খুব একটা আগ্রহী নয়। ফলে ব্যাংকগুলোতে আমানতের প্রবৃদ্ধির হার খুবই কম। এর কারণ হলো ব্যাংক আমানতের বিনিময়ে গ্রাহককে যে পরিমাণ সুদ দেয়, তা মূল্যস্ফীতির কাছাকাছি বা অনেক ক্ষেত্রেই কম। ফলে এমন পরিস্থিতিতে মানুষ ব্যাংকে আমানত রাখতে আগ্রহী নয়।’

এই অর্থনীতিবিদ মনে করেন, ঋণের ক্ষেত্রে বৈদেশিক উৎসকেই গুরুত্ব দেয়া উচিত সরকারের। বৈদেশিক প্রতিষ্ঠানগুলো দেশীয় ব্যাংকের চেয়ে অনেক কম সুদে সহজ শর্তে ঋণ দিয়ে থাকে। পাশাপাশি মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ এখনো স্বল্পোন্নত দেশের ক্যাটাগরি থেকে বের হয়নি। বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো নিম্ন আয় বা স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে কম সুদ ও সহজ শর্তের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। একইসঙ্গে ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রেও তারা অনেক লম্বা সময় দিয়ে থাকে। ২০, ২১, ২৫, কখনো কখনো ৩০ বছর পর্যন্ত সময় পাওয়া যায়। ফলে ঋণ পরিশোধের বোঝা অনেকটাই হালকা হয়ে যায়।’

এমএএস/এমআরআর/এইচএ/জেআইএম

আগামী অর্থবছরের বাজেটে স্বাস্থ্য এবং সামাজিক সুরক্ষা খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। চলতি অর্থবছরে স্বাস্থ্যখাতে যে বরাদ্দ ছিল, তার বড় একটা অংশ অব্যয়িত রয়ে গেছে। অর্থবছর শেষ হতে এখনো এক মাস বাকি আছে, তারপরও স্বাস্থ্যখাতে যে ব্যয় হয়েছে, তা মোটেও সন্তোষজনক নয়  

এখন যেটা হয়, এনবিআর কোনো প্রশ্ন করবে না এবং ১০ শতাংশ ট্যাক্স দিয়েই টাকা বৈধ করে ফেলা যাবে। অপরদিকে যারা আইন মেনে ট্যাক্স দেয় তাদের ২৫ শতাংশ ট্যাক্স দিতে হয়। কাজেই এটা বৈষম্য। এতে করে কালো টাকা উপার্জনের প্রবণতা বেড়ে যায় এবং দুর্নীতি বাড়ে। প্রতিবছর কালো টাকা বৈধ করার সুযোগ দেয়া হচ্ছে। সুতরাং কালো টাকা উপার্জনকারীদের আশা থাকে পরের বছরও তা বৈধ করার সুযোগ থাকবে। কাজেই এটা বন্ধ করা উচিত

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।