অর্থনৈতিক অঞ্চলের কার্যক্রম দ্রুত বাস্তবায়নের তাগিদ ব্যবসায়ীদের
স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়ার পথে বাংলাদেশ। এ পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক অঞ্চলের কার্যক্রম দ্রুত বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
শনিবার ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত ‘স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বাংলাদেশের উত্তোরণ : অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অগ্রযাত্রা’ শীর্ষক ওয়েবিনারে তারা এ তাগিদ দেন।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নেগোশিয়েশনের দক্ষতা বৃদ্ধি, রফতানিমুখী পণ্যের বহুমুখীকরণ, মানবসম্পদ ও প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা উন্নয়ন, কার্যকর নীতিমালা প্রণয়ন ও প্রয়োজনীয় সংসাকারের পাশাপাশি এর যথাযথ বাস্তবায়ন, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সুবিধা গ্রহণ, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিশেষজ্ঞদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা এবং সর্বোপরি সরকারি ও বেসরকারি খাতের একযোগে কাজ করা বাংলাদেশের এলডিসি উত্তোরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে ওয়েবিনারের আলোচনার উঠে আসে।
এতে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব ড. আহমদ কায়কাউস প্রধান অতিথি হিসেবে যুক্ত ছিলেন। এছাড়া অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব ফাতিমা ইয়াসমিন এবং দি ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বিশেষ অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ করেন।
ড. আহমদ কায়কাউস বলেন, আমাদের উদ্যোগী জনগণের উদ্যোমের কারণে বাংলাদেশ আজ এলডিসি হতে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়ার পথে রয়েছে এবং এলডিসি উত্তোরণের বিষয়টি নিয়ে ভীত হওয়ার কোনো কারণ নেই।
তিনি জানান, চীন একটি উন্নয়নশীল দেশ হওয়া সত্ত্বেও সারাবিশ্বে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনায় নিজেদের আধিপত্য বজায় রেখেছে। আমাদের নিজস্ব একটি বৃহৎ বাজার রয়েছে এবং দেশের নাগরিকদের আরও ভালো সেবা প্রদানের লক্ষ্যে সবাইকে কাজ করতে হবে এবং এলডিসি হতে উত্তরণের পরবর্তী সময়ে আমাদের পণ্য উৎপাদন ব্যয় খুব বেশি বৃদ্ধির সম্ভাবনা নেই। তবে আমাদেরকে প্রতিযোগী সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। এশিয়া ও আঞ্চলিক দেশেগুলোর বাজারের প্রতি আরও বেশি হারে মনোনিবেশ করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব বলেন, পরিবেশ সুরক্ষা ও শিল্পায়নে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে দারুণ সাফল্য দেখিয়েছে, যার ফলে বিশ্বের ১০টি সেরা সবুজ কারখানার মধ্যে ৭টিই আমাদের দেশে রয়েছে। এলডিসি পরবর্তী সময়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সবার সহযোগিতা নিশ্চিতকল্পে ইতোমধ্যে একটি উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন স্টিয়ারিং কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় উক্ত কমিটি সঠিক দিক-নির্দেশনা প্রদানে সক্ষম হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব ফাতিমা ইয়াসমিন আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, ৮ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় বেসরকারিখাতের অবদান থাকবে প্রায় ৮১ শতাংশ এবং এ অবস্থার আলোকে তিনি দেশীয় উদ্যোক্তাদের আত্মবিশাস বাড়ানোর ওপর জোরারোপ করেন।
তিনি বলেন, এলডিসি উত্তরণের পরবর্তী সময়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদেরকে এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে, যদিও এজন্য বাংলাদেশের আরও পাঁচ বছর সময় রয়েছে। তিনি দেশের মানবসম্পদ ও প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বৃদ্ধি এবং চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সুবিধা গ্রহণের জন্য সবাইকে প্রস্তুতি গ্রহণের আহ্বান জানান। সেই সঙ্গে রফতানি পণ্যের বাজার সম্প্রসারণের প্রতি আরও বেশি হারে মনোনিবেশ করার জন্য উদ্যোক্তাদের প্রতি আহ্বান জানান।
ফাতিমা ইয়াসমিন জানান, ২০২৬ সালের পর আরও ১২ বছর বাণিজ্য সুবিধা অব্যাহত রাখার জন্য সরকার বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) সাথে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে এবং ১১টি দেশের সাথে পিটিএ ও এফটিএ চুক্তির জন্য সরকার কাজ করে যাচ্ছে।
এফবিসিসিআই’র সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন সরকার ঘোষিত বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের কার্যক্রম দ্রুত বাস্তবায়নের ওপর জোরারোপ করেন। তিনি নিটওয়্যার ও ওভেন শিল্পের ভ্যালু অ্যাডিশনের মাধ্যমে বিনিয়োগ আকর্ষণের প্রস্তাব করেন। এছাড়া এলডিসি পরবর্তী সময়ে টিকে থাকার জন্য ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্পের আরো বিকাশ একান্ত অপরিহার্য বলে মত প্রকাশ করেন। পাশাপাশি সব বিষয়ে বেসরকারিখাতের অংশগ্রহণের উপর জোরারোপ করেন।
আলোচনায় এমসিসিআই সভাপতি ব্যারিস্টার নিহাদ কবীর, ডব্লিউটিওর এলডিসি ইউনিট অব দ্য ডেভেলপমেন্ট ডিভিশনের প্রধান তৌফিকুর রহমান, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমিতির সাবেক সভাপতি ড. মইনুল ইসলাম অংশগ্রহণ করেন।
তৌফিকুর রহমান বলেন, গত এক দশকে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে, তবে এলডিসি উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে সম্পর্ক আরও জোরদারের পাশাপাশি নতুন নতুন বাজার খুঁজে বের করার ওপর জোরারোপ করতে হবে। এছাড়া গবেষণা কার্যক্রম সম্প্রসারণ, রফতানিমুখী পণ্যকে সহায়তা প্রদানের আহ্বান জানান তিনি।
এমসিসিআই সভাপতি নিহাদ কবীর বলেন, এলডিসি উত্তরণের পরবর্তী সময়ে বেসরকারি খাতের উন্নয়নের সরকারের দিক-নির্দেশনা খুবই জরুরি। সেই সঙ্গে সরকারি এবং বেসরকারিখাতের মধ্যে ডায়ালগ আরও বৃদ্ধি করতে হবে।
তিনি বলেন, এলডিসি উত্তরণ আমাদের জন্য একটি সুবর্ণ সুযোগ। তবে এর জন্য আমাদেরকে প্রস্তুতি নিতে হবে। মানবসম্পদের দক্ষতা উন্নয়নের পাশাপাশি স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিশেষজ্ঞদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করার আহ্বান জানান তিনি।
ডাটাবেজ তৈরি, ডাটা বিশ্লেষণে সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় সক্ষমতা উন্নয়ন এবং সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধিতে এখনই প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে বলে মত প্রকশ করেন এমসিসিআই সভাপতি। তিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অধীনে বাণিজ্যবিষয়ক আন্তর্জাতিক যোগাযোগের জন্য চিফ নেগোশিয়েটর নিয়োগ করারও প্রস্তাব করেন।
ড. মইনুল ইসলাম বলেন, বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণে আমাদেরকে দুর্নীতি কমানো এবং বিদেশে পুঁজি পাচার রোধ করতে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। তিনি রফতানিমুখী পণ্যের জন্য সহায়ক নীতিমালা প্রদানের পাশাপাশি বাংলাদেশের নতুন সমুদ্রসীমায় গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম বাড়ানোর প্রস্তাব করেন। তিনি কৃষিখাতের আধুনিকায়ন ও বহুমুখীকরণের ওপর আরও বেশি জোরারোপ করেন।
স্বাগত বক্তব্যে ঢাকা চেম্বারের সভাপতি রিজওয়ান রাহমান বলেন, স্বল্পন্নোত দেশ হতে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের উত্তরণের ফলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আমাদের অবস্থান আরও দৃঢ়কল্পে ব্যবসা-বাণিজ্য সক্ষমতা বৃদ্ধি, বিনিয়োগ সম্প্রসারণ এবং সে অনুযায়ী পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি।
ঢাকা চেম্বার সভাপতি বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্টকরণ, বিনিয়োগ-ডিজিপি হার বৃদ্ধি, করহার-জিডিপি অনুপাত বৃদ্ধিও জন্য একটি রূপরেখা প্রণয়নের ওপর জোরারোপ করেন। পাশাপাশি তিনি বাংলাদেশের রফতানি বাণিজ্যের ঘাটতি কমাতে রিজিওনাল কানেক্টিভিটিসহ কৌশলগত পিটিএ এবং এফটিএ স্বাক্ষরের ওপর জোরারোপ করেন।
ডিসিসিআই সভাপতি করেন, এলডিসি হতে বাংলাদেশের উত্তরণের পরও সিএমএসএমই খাতের গুরুত্বের বিষয়টি নিরূপনকল্পে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, বিডা, এসএমই ফাউন্ডেশন এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় ঢাকা চেম্বার এলডিসি হতে বাংলাদেশের উত্তরণের পরবর্তী সময়ে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সিএমএসএমইদের চ্যালেঞ্জ চিহ্নিতকরণ ও করণীয় নির্ধারণ’ শীর্ষক একটি জরিপ পরিচালনায় আগ্রহী এবং এ বিষয়ে তিনি সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার সহযোগিতা কামনা করেন।
এমএএস/এমএসএইচ/এমকেএইচ