পুঁজিবাজারে ২৩ হাজার কোটিপতি বিনিয়োগকারী

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৯:১৩ এএম, ২৬ মে ২০২১

২০১০ সালের মহাধসের পর ধুঁকতে থাকা শেয়ারবাজার সম্প্রতি বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। প্রতিনিয়ত মূল্য সূচক বাড়ার পাশাপাশি বাড়ছে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম। এতে বাড়ছে বিনিয়োগকারীদের অর্থের পরিমাণ।

এ পরিস্থিতিতে শেয়ারবাজারের কোটিপতি বিনিয়োগকারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৩ হাজারের ওপরে। এর মধ্যে ১০ কোটি টাকার ওপরে বিনিয়োগ রয়েছে এমন বিনিয়োগকারীর সংখ্যা হাজারের ওপরে।

সম্প্রতি বেনেফিসিয়ারি ওনার (বিও) হিসাবের তথ্য পর্যালোচনা করে এমন তথ্য পেয়েছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।

বিও হিসাব রক্ষণাবেক্ষণ করা প্রতিষ্ঠান সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিডিবিএল) তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীর সংখ্যা ২৬ লাখ ৫৯ হাজার ৬৩০ জন।

বিএসইসির পর্যালোচনায় বেরিয়ে এসেছে এর মধ্যে কোটি টাকার ওপরে বিনিয়োগ রয়েছে এমন বিনিয়োগকারীর সংখ্যা ২৩ হাজার ২১০ জন। তাদের মধ্যে ১০ কোটি টাকার ওপরে বিনিয়োগ রয়েছে ১ হাজার ২৫০ জন বিনিয়োগকারীর।

এছাড়া ১০ কোটি টাকার নিচে এবং ৫ কোটি টাকার ওপরে বিনিয়োগ আছে ২ হাজার ২৫০ জনের। ৪ থেকে ৫ কোটি টাকার মধ্যে বিনিয়োগ রয়েছে এমন বিনিয়োগকারীর সংখ্যা ২ হাজার ৭০০ জন। ৩ থেকে ৪ কোটি টাকা বিনিয়োগ আছে ৩ হাজার ৪১০ জনের। ২ থেকে ৩ কোটি টাকা বিনিয়োগ থাকা বিনিয়োগকারীর সংখ্যা ৪ হাজার ৮০০ জন। আর ১ কোটি টাকার ওপরে ও ২ কোটি টাকার কম বিনিয়োগ আছে ৮ হাজার ৮০০ জনের।

এদিকে বাজার পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রায় দেড় মাস ধরে শেয়ারবাজার ঊর্ধ্বমুখী ধারায় রয়েছে। এ সময়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান মূল্য সূচক বেড়েছে প্রায় আটশ পয়েন্ট। লেনদেনের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে তিনগুণ। তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ার ও ইউনিটের দাম বেড়েছে ৫০ হাজার কোটি টাকার ওপরে।

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, বিএসইসির নতুন চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলামের নেতৃত্বে বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেয়ার পর গত বছরের আগস্ট-সেপ্টেম্বরে শেয়ারবাজার বেশ চাঙ্গা হয়ে ওঠে।

তার আগে মহামারি করোনাভাইরাস আতঙ্কে ২০২০ সালের মার্চে বড় ধরনের ধস নামে। পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারায় টানা ৬৬ দিন বন্ধ রাখা হয় শেয়ারবাজারের লেনদেন। এর মধ্যেই বিএসইসির নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দেন শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম। তার সঙ্গে কমিশনার হিসেব যোগ দেন আরও তিনজন। নতুন কমিশন দায়িত্ব নেয়ার পর শেয়ারবাজারে লেনদেন চালু করার উদ্যোগ নেন তারা। ফলে টানা ৬৬ দিন বন্ধ থাকার পর গত বছরের ৩১ মে থেকে শেয়ারবাজারে আবার লেনদেন চালু হয়।

নতুন নেতৃত্বের অধীনে শেয়ারবাজারে লেনদেন চালু হলেও অব্যাহত থাকে লেনদেন খরা। তবে জুলাই মাসে এসে অনিয়মকারীদের বিরুদ্ধে কড়া বার্তা দেয় নতুন কমিশন। অনিয়মে জড়িত থাকায় একাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে বড় অঙ্কের জরিমানা করা হয়। সতর্ক করা হয় সরকারি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশকে (আইসিবি)।

সেই সঙ্গে বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউসকে জরিমানার পাশাপাশি সতর্ক করা হয়। পরবর্তী সময়ে আইসিবিকে পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়। বাতিল করা হয় এক ডজন দুর্বল কোম্পানির আইপিও। নিয়ন্ত্রক সংস্থার এ ধরনের একের পর এক পদক্ষেপের ফলে ঘুরে দাঁড়ায় শেয়ারবাজার। ৫০ কোটি টাকার নিচে নেমে যাওয়া লেনদেন হাজার কোটি টাকার ওপরে হওয়া অনেকটাই নিয়মে পরিণত হয়।

তবে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে এসে কিছুটা ছন্দপতন ঘটে বাজারে। আবারও করোনার সংক্রমণ উদ্বেগজনক হারে বেড়ে গেলে মার্চের শেষ ও এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ এক প্রকার ধস নামে শেয়ারবাজারে। অবশ্য কয়েকদিন পরে করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সরকার ‘লকডাউন’ দিলেও শেয়ারবাজার বেশ তেজী হয়ে ওঠে। আতঙ্ক কাটিয়ে লকডাউনের মধ্যে হু হু করে বাড়ে লেনদেন, সূচক ও বাজার মূলধন। এতে বিনিয়োগকারীদের মুখেও হাসি ফুটেছে।

গত ৫ এপ্রিল লকডাউন শুরু হওয়ার আগে ৪ এপ্রিল ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান মূল সূচক ছিল পাঁচ হাজার ৮৮ পয়েন্টে। ২৫ মে লেনদেন শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে পাঁচ হাজার ৮৮৪ পয়েন্ট। অর্থাৎ এই সময়ের মধ্যে ডিএসইর প্রধান মূল্য সূচক বেড়েছে ৭৯৬ পয়েন্ট। বাজার মূলধন বেড়েছে ৫৫ হাজার ২৩৫ কোটি টাকা। ৪ এপ্রিল ডিএসইর বাজার মূলধন ছিল চার লাখ ৪৩ হাজার ৩৪৫ কোটি টাকা, যা বেড়ে ২৫ মে দাঁড়িয়েছে চার লাখ ৯৮ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা।

সূচক ও বাজার মূলধনের সঙ্গে গতি বেড়েছে লেনদেনে। শেষ ১৭ কার্যদিবসের (২৯ এপ্রিল থেকে ২৫ মে পর্যন্ত) মধ্যে প্রতিটি কার্যদিবসে ডিএসইতে হাজার কোটি টাকার ওপরে লেনদেন হয়েছে। এতে ২০ মে পর্যন্ত ২০২১ সালে প্রতি কার্যদিবসে গড়ে লেনদেন হয়েছে এক হাজার ৫৪ কোটি টাকা। চলতি বছরে এখন পর্যন্ত শেয়ারবাজারে ৯৮ দিন লেনদেন হয়েছে। এই ৯৮ দিনে ডিএসইতে মোট লেনদেন হয়েছে ১ লাখ ৩ হাজার ৩৫৩ কোটি ৪৯ লাখ টাকা।

এর আগে ২০২০ সালজুড়ে ডিএসইতে মোট লেনদেন হয় এক লাখ ৩৪ হাজার ৯৮১ কোটি ২২ লাখ টাকা। এতে বছরটিতে প্রতি কার্যদিবসে গড়ে লেনদেন হয় ৬৪৮ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। তার আগে ২০১৯ সালে প্রতি কার্যদিবসে গড়ে লেনদেন হয় ৪৮০ কোটি ২৬ লাখ টাকা এবং মোট লেনদেন হয় এক লাখ ১৩ হাজার ৮২১ কোটি ৮৮ লাখ টাকা।

এছাড়া ২০১৮ সালে মোট লেনদেন হয় এক লাখ ৩৩ হাজার ৫৯১ কোটি ৩২ লাখ টাকা এবং প্রতি কার্যদিবসে গড়ে লেনদেন হয় ৫৫২ কোটি তিন লাখ টাকা। ২০১৭ সালে মোট লেনদেন হয় দুই লাখ ১৬ হাজার ৯৫৯ কোটি ৭১ লাখ টাকা এবং প্রতি কার্যদিবসে গড়ে লেনদেন হয় ৮৭৪ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। আর ২০১৬ সালজুড়ে মোট লেনদেনের পরিমাণ ছিল এক লাখ ১৯ হাজার ১৫৭ কোটি টাকা। সে বছর প্রতি কার্যদিবসে গড়ে লেনদেন হয় ৪৯৪ কোটি ৪২ লাখ টাকা। এ তথ্য থেকেই স্পষ্ট হয়—গত কয়েক বছরের মধ্যে বর্তমান শেয়ারবাজার সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে।

শেয়ারবাজারে বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালক মো. রকিবুর রহমান বলেন, আমাদের পুঁজিবাজার ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী নির্ভর। তবে এখন বিনিয়োগকারীরা আগের চেয়ে পরিণত। তারা অনেক চালাক। এটা ভালো লক্ষণ। তবে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সার্বিক তথ্য ভালো করে পর্যালোচনা করে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কোনো অবস্থাতেই গুজবের ওপর ভিত্তি করে বিনিয়োগ করা উচিত হবে না। সেই সঙ্গে ঋণ করে, ধার করে বা জমি বিক্রি অথবা বন্ধক রেখে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করা উচিত হবে না।

রকিবুর রহমান আরও বলেন, ব্যাংকে টাকা রাখলে ৫ শতাংশের মতো মুনাফা পাওয়া যায়। কিন্তু শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে কেউ কেউ রাতারাতি বড় লোক হতে চায়। এত লোভ ভালো না। আপনি পাঁচ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে ৫-১০ হাজার টাকা মুনাফা পেলে তাতেই সন্তুষ্ট থাকা উচিত। কিন্তু পাঁচ লাখ টাকা ১০ লাখ হয়ে যাবে, এমন লোভ করা ঠিক না।

শেয়ারবাজারের সাম্প্রতিক চিত্র সম্পর্কে ডিএসইর আরেক পরিচালক মো. শাকিল রিজভী বলেন, চলতি অর্থবছরে শেয়ারবাজারে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ দেয়া হয়েছে। অর্থবছরের শেষ সময়ে এসে অপ্রদর্শিত অর্থের একটি অংশও এখন শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ হচ্ছে। এছাড়া আইপিওকে কেন্দ্র করেও বাজারে নতুন টাকা এসেছে। এসব কারণেই লেনদেন ও সূচক বেড়েছে।

এমএএস/এমআরআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।