করোনায় রেস্টুরেন্ট : অনলাইন অর্ডারে টিকে থাকার সংগ্রাম
মুখরোচক খাবার ও সুন্দর পরিবেশে নিরিবিলি আড্ডার ব্যবস্থা করায় রেস্তোরাঁগুলো শুধু খাবারের দোকান ছাপিয়ে বিনোদন কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। গত এক দশকে ঢাকাসহ সারাদেশে গড়ে উঠেছে কয়েক হাজার রেস্তোরাঁ। ঢাকায়ই আছে প্রায় ১০-১২টির মতো ফুড কোর্ট বা একসঙ্গে একাধিক খাবারের দোকান।
অল্প পুঁজি, অধিক লাভ ও সহজে ব্যবসায় পরিচালনা এই তিনটি কারণে দেশে রেস্টুরেন্ট ব্যবসার প্রসার ঘটেছে। তবে গত বছর করোনা শুরু হলে ধুঁকতে শুরু করে রেস্তোরাঁ ব্যবসা। ক্ষতি পোষাতে অনেকেই কর্মী ছাঁটাই শুরু করে। আবার অনেক রেস্তোরাঁ এসময় বন্ধ হয়ে যায়।
এ খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত বছর করোনা উপলক্ষে সরকারের দেয়া সাধারণ ছুটির পরে জুলাইয়ের পর রেস্তোরাঁগুলো খুলে যায়। জিনিসপত্রের বাড়তি দামে তারা নতুর চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েন।
চলতি বছর পহেলা বৈশাখ, রমজান কেন্দ্র করে নতুন স্বপ্নের বীজ বুনতে থাকেন। নতুন করে করোনার সংক্রমণ বাড়লে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ থেকে লকডাউন হয়ে যায় রাজধানীসহ সারাদেশ।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাইরে ইফতারি বিক্রি ও রেস্টুরেন্টে বিভিন্ন ইফতার পার্টি, ইফতার-পরবর্তী বেচাকেনা করে সারা বছরের ক্ষতি পোষায় রেস্টুরেন্টগুলো। কিন্তু গত বছরের মতো এবারও করোনা সব কিছু শেষ করে দেবে তারা ভাবতে পারেননি। দুই বছর ধরে লোকসান টানতে টানতে অনেক ব্যবসায়ী এখন নিঃস্ব।
রেস্টুরেন্ট মালিক সমিতির তথ্য বলছে, রাজধানীতে প্রায় আট হাজার রেস্তোরাঁ রয়েছে। যার মধ্যে ঢাকার দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় সাড়ে চার হাজার। উত্তর সিটিতে প্রায় সাড়ে তিন হাজার। রেস্তোরাঁগুলোতে সব মিলিয়ে প্রায় আড়াই লাখ শ্রমিক কাজ করেন।
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে খাবার পার্সেল বা অনলাইন অর্ডারে ডেলিভারি করে কোনো রকমে চলছে রেস্তোরাঁগুলো। আগামী ঈদে স্টাফদের বেতন বোনাস কীভাবে দেবেন তা নিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।
রেস্টুরেন্ট মালিক সমিতির সভাপতি ওসমান গনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের ফুডের ব্যবসায় দৌড়াইয়া লাভ হয়, আবার দৌইড়ায়া লস হয়। বিক্রি যেখানে বেশি লাভের সংখ্যা সেখানে অনেক বেশি। যদি বেচাকেনা কম হয় তাহলে অনেক লস। এখানে দোকানের ভাড়া অন্য দোকানের চেয়ে বেশি। একটা ছোট রেস্টুরেন্টেও ১০-১৫ জন স্টাফ থাকে। এদের মধ্যে চার-পাচঁজন শেফ থাকে। সবার থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হয়।’
তিনি বলেন, একেকজন শেফের পেছনে মাসে বেতনসহ ২০- ২৫ হাজার টাকা খরচ আছে। স্টাফের পেছনে ১৪-১৫ হাজার টাকা খরচ আছে। জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। আবার গত ৫ বছরে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি সব কিছুর দাম বেড়েছে। কিন্তু আমরা হুট করে খাবারের দাম বাড়াতে পারি না। এই ব্যবসা নিয়ে আমরা বহু বিপদে আছি।
এই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, শতকরা ৮০ ভাগ ব্যবসায়ী চরম বিপদে আছে। কেউ মুদি দোকানে টাকা বাকি রেখেছে তো কেউ মাংস ব্যবসায়ীর টাকা বাকি রেখেছে। এভাবে ধুঁকে ধুঁকে চলছে আমাদের ব্যবসা।
ওসমান গনি বলেন, বর্ধিত লকডাউন আমরা মেনে নিয়েছি। কিন্তু রেস্তোরাঁয় বসে যে ইফতার করা যাচ্ছে না, এতে বিশাল ক্ষতি হচ্ছে। কোনো রেস্টুরেন্টে এই মাস পুরোটাই ইফতার পার্টি থাকতো। তারপরে আরও কিছু বেচাকেনা হতো। এখন কোনো দোকানে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বেচাকেনা হচ্ছে। তাও আবার অনলাইন অর্ডারে। কোথাও সারাদিনে কোনো বিক্রি নেই।
তিনি বলেন,‘আমাদের সরকার প্রণোদনা দেবে বলেছে। আমরা বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগও করেছি। ব্যাংকেও গিয়েছি। সেখান থেকে আমাদের বলা হয়েছে, আপনারা পচনশীল দ্রব্য আপনাদের প্রণোদনা দেয়া হবে না। এটা অনেক দুঃখজনক কথা।’
মাটিকাটা এলাকায় শখের বসে বেশ মি. গোস্ত নামের একটি রেস্টুরেন্ট খোলেন চার বন্ধু। ভালো সাড়া পাওয়ায় ধীরে ধীরে এর কলেবর বাড়তে থাকে। তবে গত বছরের করোনার পর ধুঁকে ধুঁকে চলছে রেস্তোরাঁটি।
মালিকদের একজন মোহাম্মদ ইমরান জাগো নিউজকে বলেন, গত বারের মতোই এবারও কয়েকজন স্টাফকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি। অবস্থা ভালো হলে তাদের আসতে বলেছি। তাদের কিছু টাকা-পয়সা দিয়ে দেয়ার চেষ্ট করি। কিন্তু তাদের যদি রাখি তাহলে বেতন, খাবার খরচ মিলিয়ে অনেক টাকা আসে। ১৪ জন স্টাফ মিনিমাম ২ হাজার টাকা করে খাবার খরচ ধরলেও মাসে ৩০ হাজার টাকার বেশি আসে। এখন কিচেনে তিনজন, সামনে দু’জন রাখছি। বাকিদের পাঠিয়ে দিয়েছি।
তিনি বলেন, ‘এখন খাবার পার্সেল, ডেলিভারিতেই চলছে। তাতে করে আসলে ইউটিলিটির খরচ উঠানোই কষ্টকর। দোকানের ভাড়া, কর্মচারীদের বেতন কীভাবে দেব, কোনো কিছুই মাথায় আসছে না।’
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ফয়সাল আহমেদ। পড়াশোনার পাশাপাশি পাচঁ বছর আগে মিরপুরে ছোট পরিসরে খুলেছেন ফুড পয়েন্ট নামের রেস্টুরেন্ট। তিনি বলেন, দোকান ভাড়া, কর্মচারীদের বেতন, বিদ্যুৎ, পানির বিল সব মিলিয়ে মাসে ১ লাখ টাকার মতো খরচ আছে। তার উপরে ঈদে দিতে হবে বোনাস। কিন্তু এপ্রিল থেকে রেস্টুরেন্ট বন্ধ।
জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘অনলাইনে কিছু পার্সেলের অর্ডার আসলেও রাইডারের অভাবে সেগুলো দেয়া যাচ্ছে না। আবার অনেক জায়গায় বাইরে থেকে রাইডার বা অন্য কাউকে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না। সব মিলিয়ে পার্সেল সার্ভিস খুব ভালো করে দিতে পারছি না। রেস্টুরেন্টগুলো চলে বিকেল থেকে সন্ধ্যার পরে। আর এখন তো সব বন্ধ। সব মিলিয়ে অনেক বিপদে আছি।’
এই ব্যবসায়ী বলেন, আমরা তো কোথাও পালাতে পারছি না। বিগত কয়েক মাসের দোকান ভাড়া দিতে পারিনি। লোকসানের উপর দিয়ে যাচ্ছে, এভাবে কতদিন টিকে থাকতে পারবো জানা নেই।
এসএম/এসএইচএস/এএসএম