করোনামন্দা মোকাবিলায় সফল হলেও থাকছে চ্যালেঞ্জ
অডিও শুনুন
করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) কারণে সৃষ্ট বৈশ্বিক মন্দা মোকাবিলায় বিশ্বের অনেক দেশকেই হিমশিম খেতে হয়েছে। সে তুলনায় বাংলাদেশ ভালো করেছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের পর্যবেক্ষণ, অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশ এখনো করোনা-পূর্ব সময়ের অবস্থায় ফিরে যেতে পারেনি। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প খাত করোনার সময় চাঙ্গা করার সুযোগ থাকলেও তা করা সম্ভব হয়নি।
অন্যদিকে ফের দেশে বাড়তে শুরু করেছে করোনা সংক্রমণ। গত বছরের মার্চে দেশে করোনা শনাক্তের পর এর সংক্রমণ চূড়ায় (পিক) ওঠে জুন-জুলাইয়ে। ওই সময় বিশেষ করে জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে জুলাই মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রতিদিন গড়ে তিন-চার হাজার রোগী শনাক্ত হচ্ছিল। পরে কয়েক মাস পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে থাকার পর গত কয়েক সপ্তাহ ধরে সংক্রমণ আবার ঊর্ধ্বমুখী। এর মধ্যে গত পাঁচ দিনের প্রতিদিনই সাড়ে তিন হাজারের বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, আরেকটি চূড়ার (পিক) দিকে যাচ্ছে সংক্রমণ পরিস্থিতি। সবশেষ গতকাল শনিবারও (২৭ মার্চ) স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে আরও ৩৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ সংখ্যা গত সাড়ে তিন মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর ৪০ জনের মৃত্যুর খবর জানিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদফতর।
বিশ্লেষকরা বলছেন, করোনার প্রথম ধাক্কায় সৃষ্ট বৈশ্বিক মন্দা মোকাবিলায় বাংলাদেশ ভালো করলেও কিছু চ্যালেঞ্জ থেকেই যাচ্ছে, যা এবারের ধাক্কায় সামলাতে সংগ্রাম করতে হতে পারে।
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ও ড. জাহিদ হোসেন
এদিকে চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (আরএডিপি) আকার কমেছে। চলতি অর্থবছর মূল এডিপিতে বরাদ্দ ছিল দুই লাখ ৫ হাজার ১৪৪ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। আরএডিপিতে তা কমিয়ে ধরা হয়েছে এক লাখ ৯৭ হাজার ৬৪৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ মূল এডিপির তুলনায় আরএডিপির বরাদ্দ কমেছে সাত হাজার ৫০১ কোটি ৭৯ লাখ টাকা বা ৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ।
চলতি বছর বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) কেমন হতে পারে, সে বিষয়ে আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পূর্বাভাস দেখে বোঝা কঠিন। কারণ গত এপ্রিলে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলেছে, চলতি অর্থবছর দেশের প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৯ দশমিক ৫ শতাংশ; অক্টোবরে বিশ্বব্যাংক বলেছে, প্রবৃদ্ধি হতে পারে ১ দশমিক ৬ এবং সেপ্টেম্বরে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বলেছে, প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ।
বাংলাদেশ সরকার চলতি অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরেছে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরের জিডিপির আকারই এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত করতে পারেনি সরকার। ফলে বর্তমান অর্থবছর প্রবৃদ্ধি কোন দিকে মোড় নিচ্ছে তা আঁচ করাও কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
অন্যান্য দেশের চেয়ে ভালো করলেও আগের অবস্থায় বাংলাদেশ এখনো যে যেতে পারেনি, তা স্পষ্ট করেই বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘সফল এখানে কেউ হয়নি। বাংলাদেশ কেন, চীন বাদে তেমন কেউ প্রবৃদ্ধি আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনতে পারেনি। বাংলাদেশের অর্থনীতি মার্চ-এপ্রিলে যে ধরনের গভীর সঙ্কটের মধ্যে পড়েছিল, মানুষ ট্রাক থেকে চাল লুট করে নিয়ে যাচ্ছিল, সেই ধরনের পরিস্থিতি থেকে আমরা বেরিয়ে এসেছি। এটা মোটামুটি রিকোভারির দিকে যাচ্ছি। এখন তো আবার সমস্যা একটু জটিল হচ্ছে। এখানে যদি ব্যর্থতার কথা বলা হয়, তাহলে সেটা হলো ক্ষুদ্র-কুটির শিল্পের সহায়তা প্রদানে আমরা সফল হইনি। শহরের যে অনানুষ্ঠানিক খাতে নির্ভরশীল পরিবারগুলো তাদের সহায়তার ক্ষেত্রেও আমাদের ঘাটতি রয়েছে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও অর্থনীতিবিদ ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের কণ্ঠেও প্রায় একই সুর। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘করোনায় সৃষ্ট বৈশ্বিক মহামারি মোকাবিলায় এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ অন্যান্য দেশের তুলনায় ভালো করছে। একটা জিনিস হলো, বাংলাদেশে ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্পে যে উদ্দীপনা বা প্যাকেজ ছিল তা বাস্তবায়ন করা হয়নি। এখানে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার বড় একটা সুযোগ ছিল, এখনো আছে। অতএব এ কর্মসংস্থান যদি আমরা সৃষ্টি না করতে পারি, যদি আয়ের সংস্থান করতে না পারি, তাহলে মন্দা থেকে আমাদের ঘুরে দাঁড়ানোর যে চেষ্টা, সেটা হয়েছে; যথেষ্ট ফলপ্রসূ হবে না। এদিকে যথেষ্ট নজর দিতে হবে। সেই সঙ্গে বড় শিল্প, রফতানিতেও নজর দিতে হবে।
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘মোটামুটি আমাদের যে প্রবৃদ্ধি বা চালিকাশক্তি আছে, কৃষি, গার্মেন্টস, রেমিট্যান্স, ছোট শিল্পগুলো একেবারে অবহেলিত– এগুলোয় যথেষ্ট নজর দিতে হবে। তবেই আমরা যুদ্ধে জয়লাভ করব।’
পিডি/জেডএইচ/এসএইচএস/এইচএ/জেআইএম