করোনায় আর্থিক প্রতিষ্ঠানের করুণ দশা
অডিও শুনুন
আমানত, তারল্য, মুনাফা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে সংকটের মধ্যে রয়েছে দেশের অব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। দিন যত যাচ্ছে অব্যাংকিং আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর সংকট তত বাড়ছে। মহামারি করোনাভাইরাসের প্রকোপের মধ্যে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা আরও করুণ হয়ে পড়েছে।
অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, মুনাফায় প্রবৃদ্ধি করা কঠিন হয়ে পড়েছে প্রায় সবক’টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের। এমনকি বেশিরভাগ আর্থিক প্রতিষ্ঠান তাদের সম্পদ ধরে রাখতে পারছে না। এর সঙ্গে তারল্য সংকট তো আছেই। চলতি বছরের জানুয়ারি-জুন সময়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রকাশিত আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া মহামারি করোনাভাইরাস বাংলাদেশে প্রথম শনাক্ত হয় গত ৮ মার্চ। করোনার প্রকোপ ঠেকাতে ২৬ মার্চ থেকে ৩০ মে পর্যন্ত টানা ৬৬ দিন সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। ফলে চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) সব ধরনের প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটে।
সেই হিসাবে চলতি বছরের প্রথমার্ধ (জানুয়ারি-জুন) সংকটের মধ্য দিয়ে পার করেছে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান। অবশ্য এর মধ্যেও কিছু প্রতিষ্ঠান ভালো ব্যবসা করেছে। কিন্তু অব্যাংকিং আর্থিক খাতে সে সংখ্যা খুবই কম।
নিয়ম অনুযায়ী, শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোকে প্রতি তিন মাস পরপর আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করতে হয়। এরই আলোকে তালিকাভুক্ত ২৩ অব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৪টি চলতি বছরের জানুয়ারি-জুন সময়ের প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রকাশিত ওই আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি-জুন সময়ে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত মাত্র দুটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মুনাফা আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে। বাকি প্রতিষ্ঠানগুলোর মুনাফা আগের বছরের তুলনায় কমে গেছে। এর মধ্যে তিনটি প্রতিষ্ঠান লোকসানের তালিকায় নাম লিখিয়েছে।
আগের বছরের তুলনায় মুনাফা বাড়া দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিডি ফাইন্যান্স চলতি বছরের জানুয়ারি-জুন সময়ে শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে ৪৬ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ২৩ পয়সা। মুনাফার পাশাপাশি কোম্পানিটির সম্পদও বেড়েছে। চলতি বছরের জুন শেষে শেয়ারপ্রতি সম্পদ দাঁড়িয়েছে ১৬ টাকা ৮৩ পয়সা, ২০১৯ সালের ডিসেম্বর শেষে ছিল ১৬ টাকা ৩৭ পয়সা।
মুনাফায় প্রবৃদ্ধি হওয়া আরেক প্রতিষ্ঠান ইসলামী ফাইন্যান্স চলতি বছরের জানুয়ারি-জুন সময়ে শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে ৭০ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৬৬ পয়সা। গত বছরের জুনে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি সম্পদ মূল্য ছিল ১৩ টাকা ৭২ পয়সা, চলতি বছরের জুন শেষে বেড়ে তা দাঁড়িয়েছে ১৫ টাকা ১৬ পয়সায়। মুনাফা ও সম্পদের মূল্য বাড়লেও কোম্পানিটির ক্যাশ ফ্লো ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি-জুন সময়ে শেয়ারপ্রতি অপারেটিং ক্যাশ ফ্লো দাঁড়িয়েছে ঋণাত্মক ১৭ পয়সা।
ক্যাশ ফ্লো বা পরিচালন নগদ প্রবাহ ঋণাত্মক হয়ে পড়ার অর্থ হলো নগদ অর্থের সংকট তৈরি হওয়া। শেয়ারপ্রতি ক্যাশ ফ্লো যত বেশি ঋণাত্মক হবে নগদ অর্থের সংকটও তত বাড়বে। এ অবস্থা তৈরি হলে চাহিদা মেটাতে চড়া সুদে টাকা ধার করা লাগতে পারে। তাতে খরচ বেড়ে যায় এবং আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
এদিকে মুনাফা, সম্পদের মূল্য এবং ক্যাশ ফ্লো— এই তিন সূচকেই নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে ছয়টি প্রতিষ্ঠানের। এগুলো হলো- ডেল্টা ব্র্যাক হাউজিং, আইসিবি, আইডিএলসি, মাইডাস ফাইন্যান্স, প্রিমিয়ার লিজিং ও ইউনিয়ন ক্যাপিটাল।
এর মধ্যে মাইডাস ফাইন্যান্স, ইউনিয়ন ক্যাপিটাল ও আইসিবি লোকসানের খাতায় নাম লিখিয়েছে। ইউনিয়ন ক্যাপিটাল চলতি বছরের জানুয়ারি-জুন সময়ের ব্যবসায় শেয়ারপ্রতি লোকসান করেছে ১ টাকা ৪০ পয়সা, আগের বছরের একই সময়ে কোম্পানিটি শেয়ারপ্রতি ৬ পয়সা মুনাফা করে। গত বছরের ডিসেম্বর শেষে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি সম্পদ ছিল ৭ টাকা ২১ পয়সা, যা কমে ৫ টাকা ৮১ পয়সায় দাঁড়িয়েছে। আর শেয়ারপ্রতি অপারেটিং ক্যাশ ফ্লো দাঁড়িয়েছে ঋণাত্মক ২ টাকা ৪ পয়সা।
মাইডাস ফাইন্যান্স শেয়ারপ্রতি লোকসান করেছে ৭ পয়সা। আগের বছরেও কোম্পানিটি শেয়ারপ্রতি ৮৩ পয়সা লোকসান করে। লোকসানের মধ্যে নিমজ্জিত হওয়া কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি সম্পদ গত ডিসেম্বর শেষে ছিল ১১ টাকা ৩৮ পয়সা, যা কমে এখন ১১ টাকা ৩২ পয়সায় দাঁড়িয়েছে। আর অপারেটিং ক্যাশ ফ্লো দাঁড়িয়েছে ঋণাত্মক ৩০ পয়সা।
সরকারি প্রতিষ্ঠান আইসিবি ২০১৯ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ব্যবসা করে শেয়ারপ্রতি লোকসান করেছে ৬২ পয়সা, আগের হিসাব বছরের একই সময়ে কোম্পানিটি শেয়ারপ্রতি ৯০ পয়সা মুনাফা করেছে। গত বছরের জুনে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারপ্রতি সম্পদ ছিল ৪০ টাকা ৫২ পয়সা, যা চলতি বছরের মার্চ শেষে দাঁড়িয়েছে মাত্র ২ টাকা ৬১ পয়সায়। অপরদিকে শেয়ারপ্রতি অপারেটিং ক্যাশ ফ্লো দাঁড়িয়েছে ঋণাত্মক ৩ টাকা ৪২ পয়সা।
এছাড়া ডেল্টা ব্র্যাক হাউজিংয়ের মুনাফা ৩ টাকা ৭৯ পয়সা থেকে কমে ১ টাকা ৭৭ পয়সা হয়েছে। গত ডিসেম্বরে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি সম্পদ ছিল ৩৯ টাকা ৬৯ পয়সা, তা কমে ৩৭ টাকা ৭৩ পয়সায় দাঁড়িয়েছে। আর শেয়ারপ্রতি অপারেটিং ক্যাশ ফ্লো দাঁড়িয়েছে ১২ টাকা ৭৭ পয়সা।
আইডিএলসি চলতি বছরের জানুয়ারি-জুন সময়ে শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে ১ টাকা ৭৭ পয়সা, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ২ টাকা ৬৭ পয়সা। গত বছরের ডিসেম্বরে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি সম্পদ ছিল ৩৭ টাকা ১৮ পয়সা, যা কমে ৩৫ টাকা ৪৪ পয়সায় দাঁড়িয়েছে। আর শেয়ারপ্রতি অপারেটিং ক্যাশ ফ্লো দাঁড়িয়েছে ঋণাত্মক ৩ টাকা ৪২ পয়সা।
তিন সূচকেই নেতিবাচক প্রভাব পড়ায় আরেক প্রতিষ্ঠান প্রিমিয়ার লিজিং চলতি বছরের জানুয়ারি-জুন সময়ে শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে মাত্র ২ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৭ পয়সা। কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি সম্পদের মূল্য ১৯ টাকা ৩৬ পয়সা থেকে কমে ১৮ টাকা ৯৭ পয়সায় দাঁড়িয়েছে। আর শেয়ারপ্রতি অপারেটিং ক্যাশ ফ্লো দাঁড়িয়েছে ঋণাত্মক ১ টাকা ১৯ পয়সা।
বাকি ছয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বে-লিজিংয়ের শেয়ারপ্রতি মুনাফা ২৪ পয়সা থেকে কমে ১১ পয়সায়, লংকাবাংলা ফাইন্যান্সের ৫০ পয়সা থেকে কমে ১৫ পয়সায়, ফিনিক্স ফাইন্যান্সের ৬৩ পয়সা থেকে ৫৬ পয়সায়, উত্তরা ফাইন্যান্সের ৬ টাকা ৫ পয়সা থেকে কমে ২ টাকা ৮৭ পয়সায়, আইপিডিসির ১ টাকা ৪ পয়সা থেকে কমে ৮৫ পয়সায় এবং ইউনাইটেড ফাইন্যান্সের ৭১ পয়সা থেকে কমে ২৭ পয়সায় দাঁড়িয়েছে।
এর মধ্যে মুনাফার পাশাপাশি আইপিডিসির সম্পদের মূল্য কমেছে। গত ডিসেম্বর শেষে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি সম্পদ ছিল ১৫ টাকা ৩ পয়সা, তা কমে ১৪ টাকা ৯৮ পয়সায় দাঁড়িয়েছে। আর ইউনাইটেড ফাইন্যান্সের মুনাফার পাশাপাশি ক্যাশ ফ্লোতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি অপারেটিং ক্যাশ ফ্লো দাঁড়িয়েছে ঋণাত্মক ৪ টাকা ৬২ পয়সা।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলামের মতে, লিজিং কোম্পানিগুলোর আমানতের পাশাপাশি ঋণের প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। আমানত না পাওয়ায় লিজিং কোম্পানিকে অতিরিক্ত সুদে আমানত সংগ্রহ করতে হচ্ছে। কিন্তু অতিরিক্ত এই সুদ বহন করার মতো ব্যবসা কোম্পানিগুলো করতে পারছে না। অনেকে গ্রাহকের টাকা পরিশোধ করতে পারছে না। আর্থিক খাতের এই সংকট দূর করতে হলে আগে ব্যাংকিং খাত ঠিক করতে হবে।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মো. বখতিয়ার হাসান বলেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসার পারফরম্যান্স নির্ভর করে আমানত ও ঋণ (লিজ) বিতরণের ওপর। করোনা মহামারির কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য কমে গেছে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ বিতরণে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই কোম্পানিগুলোর মুনাফা কমেছে। এছাড়া বিতরণ করা ঋণের বড় অংশ খেলাপি হয়ে যাচ্ছে, তা রিকভারি (আদায়) হচ্ছে না। সবমিলিয়ে আর্থিক খাত দুরবস্থার মধ্যে পড়েছে।
এমএএস/এইচএ/এমএআর/পিআর