মন্দ ঋণে প্রভিশন রাখতে ব্যর্থ ১১ ব্যাংক
অডিও শুনুন
>> সরকারি চার ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ছয় হাজার ১৩ কোটি টাকা
>> বেসরকারি সাত ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি চার হাজার ১৬৪ কোটি টাকা
করোনাভাইরাস মহামারিতে বিশেষ ছাড়সহ নানা সুযোগ-সুবিধার দেয়ার পরও ব্যাংকিং খাতে বেড়েছে মন্দ বা খেলাপি ঋণের পরিমাণ। ঝুঁকিপূর্ণ এসব ঋণের বিপরীতে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে দেশের সরকারি ও বেসরকারি খাতের ১১টি ব্যাংক। এসব ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ১৭৭ কোটি টাকা। যার সিংহভাগই রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকের।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তৈরি করা জুন ’২০ প্রান্তিকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা গেছে।
ব্যাংক ব্যবস্থার ঋণের শ্রেণীমান অনুযায়ী, নির্ধারিত পরিমাণ নিরাপত্তা সঞ্চিতির অর্থ সংরক্ষণের বিধান রয়েছে। কিন্তু প্রয়োজনীয় প্রভিশন রাখতে ব্যর্থ হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, রূপালী, বেসিক ও অগ্রণী ব্যাংক এবং বেসরকারি খাতের এবি ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক ও ট্রাস্ট ব্যাংক।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খেলাপি ঋণ বাড়ার কারণেই ব্যংকিং খাতে প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ বাড়ছে। আর এ সময়ে যেসব ব্যাংক প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে, তাদের মূলধন ঘাটতিতে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ ৪৯ হাজার ৭২৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপির পরিমাণ ৯৬ হাজার ১১৬ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৯ দশমিক ১৬ শতাংশ। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ১০ লাখ ২৪ হাজার ৪৯৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপির পরিমাণ ৯২ হাজার ৫১০ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৯ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। এ হিসাবে মার্চ-জুন এ চার মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে তিন হাজার ৬০৬ কোটি টাকা।
আলোচিত সময়ে ১১ ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ১১৭ কোটি টাকা। সরকারি চার ব্যাংকের ঘাটতি ছয় হাজার ১৩ কোটি টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘাটতি সোনালী ব্যাংকের। জুন শেষে সোনালী ব্যাংকের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ৩১৪ কোটি ১৭ লাখ টাকা। এর পরই রূপালী ব্যাংকের ৯২০ কোটি ৫০ লাখ টাকা, বেসিক ব্যাংকের ৮৯২ কোটি ৬৫ লাখ টাকা এবং অগ্রণী ব্যাংকের ঘাটতি ৮৮৫ কোটি ৭১ লাখ টাকা।
অন্যদিকে বেসরকারি খাতের সাত ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি চার হাজার ১৬৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রভিশন ঘাটতি ন্যাশনাল ব্যাংকের। জুন শেষে ব্যাংকটির ঘাটতি দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৬৯৬ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। এছাড়া এবি ব্যাংকের এক হাজার ২১৪ কোটি ৮৩ লাখ টাকা, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ৫৬৫ কোটি ৬১ লাখ টাকা, ঢাকা ব্যাংকের ২০৩ কোটি ৩৬ লাখ টাকা, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ২৪৪ কোটি টাকা, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের ১৯৮ কোটি টাকা এবং ট্রাস্ট ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৪১ কোটি ৭৬ লাখ টাকা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোনো কোনো ব্যাংক প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত (উদ্বৃত্ত) অর্থ নিরাপত্তা সঞ্চিতি হিসাবে রাখায় সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতে ঘাটতির পরিমাণ কিছুটা কমেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন শেষে ব্যাংকিং খাতে প্রভিশন সংরক্ষণের প্রয়োজন ছিল ৬৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। এর বিপরীতে সংরক্ষণ করা হয়েছে ৬০ হাজার ৯০০ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। ফলে সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতে মোট নিরাপত্তা সঞ্চিতির ঘাটতি দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা।
জানা গেছে, ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের যে পরিমাণ ঋণ বিতরণ করে তার বেশিরভাগই আমানতকারীদের অর্থ। আমানতকারীদের অর্থ যেন কোনো প্রকার ঝুঁকির মধ্যে না পড়ে সেজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করা আছে। এর একটি হলো প্রভিশন সংরক্ষণ। নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকের অশ্রেণীকৃত বা নিয়মিত ঋণের বিপরীতে দশমিক ২৫ থেকে পাঁচ শতাংশ হারে প্রভিশন রাখতে হয়। নিম্নমান বা সাব স্ট্যান্ডার্ড ঋণের বিপরীতে রাখতে হয় ২০ শতাংশ, সন্দেহজনক ঋণের বিপরীতে ৫০ শতাংশ এবং মন্দ বা কুঋণের বিপরীতে ১০০ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। ব্যাংকের আয় খাত থেকে অর্থ এনে এ প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয়। খেলাপি ঋণ বাড়লে, আর সে অনুযায়ী ব্যাংকের আয় না হলে প্রভিশন ঘাটতি দেখা দেয়।
ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, প্রভিশন ঘাটতি থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক শেয়ারহোল্ডারদের জন্য কোনো লভ্যাংশ ঘোষণা করতে পারে না।
এসআই/এইচএ/এমএস