ট্রান্সশিপমেন্টে কমবে রফতানি বাণিজ্য, শঙ্কা ব্যবসায়ীদের
অডিও শুনুন
দেশের অন্যতম বৃহৎ ও রফতানিমুখী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দর রফতানি বাণিজ্যে বারবার হোঁচট খাচ্ছে। ভারত থেকে পণ্য আমদানি না হওয়ায় এই স্থলবন্দর দিয়ে সরকারের রাজস্ব আদায় নেই বললেই চলে। তবে রফতানি করা পণ্যের বিপরীতে বৈদেশিক মুদ্রার রেমিট্যান্স পায় সরকার।
প্রাণঘাতী করোনা মহামারির প্রভাবে বর্তমানে এই বন্দর দিয়ে রফতানি কার্যক্রম প্রায় বন্ধ। এছাড়া ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর মধ্যকার যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হওয়ায় গত তিন-চার বছর ধরে বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানির পরিমাণও কমেছে দেশটি। নতুন করে তাদের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা দেয়ায় বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের কপালে চিন্তার ভাঁজ দেখা দিয়েছে।
তাদের শঙ্কা, ভারতকে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা দেয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হবেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। এই বন্দর দিয়ে রফতানি বাণিজ্যে নতুন করে সংকট দেখা দেবে। কারণ ব্যাখা করে তারা বলেন, বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহার করে নিজেদের উচ্চ চাহিদাসম্পন্ন পণ্য সহজে নিজ দেশে পরিবহন করতে পারবেন ভারতীয় ব্যবসায়ীরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নব্বইয়ের দশকে প্রথম আখাউড়া স্থল শুল্ক স্টেশন দিয়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলায় পণ্য রফতানি শুরু করেন বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা। এরপর ২০১০ সালের ১৩ আগস্ট পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দর হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর প্রতিদিন কয়েক কোটি টাকার রড, সিমেন্ট, পাথর, কয়লা, প্লাস্টিক, মাছ, শুঁটকি, তুলা ও ভোজ্যতেলসহ অর্ধশতাধিক পণ্য রফতানি হয় ভারতে। তখন প্রতিদিন প্রায় ৩০০ পণ্যবোঝাই ট্রাক প্রবেশ করতো আগরতলা দিয়ে। এসব পণ্য আগরতলা থেকে দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে সরবরাহ করা হতো।
তবে গত তিন-চার বছর ধরে আখাউড়া স্থলবন্দরের রফতানি বাণিজ্যে ধস নেমেছে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে সড়ক ও রেলপথে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে ধীরে ধীরে পণ্য আমদানি কমিয়ে দেয় সেখানকার ব্যবসায়ীরা। বড় ব্যবসায়ীরা এখন বাংলাদেশ থেকে পাথর আমদানি করেন না। শিলং থেকে ট্রেনে পাথর সরবরাহ করছেন তারা। শুধুমাত্র ছোট ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশ থেকে পাথর আমদানি করেন।
এছাড়া করোনাভাইরাসের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে স্থলবন্দরের রফতানি বাণিজ্যে। করোনার প্রাদুর্ভাব শুরুর আগে প্রতিদিন গড়ে এক-দেড়শ পণ্যবোঝাই ট্রাক আগরতলায় প্রবেশ করলেও করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরু হওয়ার পর দুই দফায় কয়েকদিন করে আমদানি কার্যক্রম বন্ধ রেখে গড়ে ৪০টি পণ্যবোঝাই ট্রাক প্রবেশের অনুমতি দেয় আগরতলা স্থলবন্দর ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। তবে এখন বর্ষা মৌসুম হওয়ায় এবং করোনাভাইরাসের প্রভাবে ভারতে কন্সট্রাকশন কাজ বন্ধ থাকায় পণ্যের চাহিদা কমেছে। এখন গড়ে প্রতিদিন ২০-২৫ ট্রাক পণ্য যাচ্ছে আগরতলায়।
রড, পাথর ও মাছ রফতানি কার্যক্রম একেবারে বন্ধ রয়েছে এখন। সিমেন্টসহ অন্যান্য পণ্য রফতানিও কমে গেছে। এখন ভোজ্যতেল, খাদ্যসামগ্রী, প্লাস্টিক ও তুলাসহ কিছু পণ্য স্বল্প পরিমাণে রফতানি হচ্ছে।
আখাউড়া স্থলবন্দরের কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, ভারতের বাজারে বাংলাদেশি রড-সিমেন্টের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। রফতানি বাণিজ্যে ধস নামার পরও প্রতি মাসে ৩০০ টন রড ও এক লাখ বস্তা সিমেন্ট রফতানি হতো ভারতে। প্রতি মাসে গড়ে ১৫ লাখ ডলার মূল্যের ভোজ্যতেল, ১০ লাখ ডলারের মাছ, ৫০-৬০ হাজার ডলারের প্লাস্টিক যেত আগরতলায়। এখন রড, কয়লা ও মাছ রফতানি বন্ধ। সিমেন্টও যাচ্ছে আগের চেয়ে অর্ধেক।
আখাউড়া স্থল শুল্ক স্টেশনের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে দুই লাখ ১১ হাজার ৫১৭ টন পণ্য রফতানি হয়। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রফতানি হয় দুই লাখ নয় হাজার ৯৬২ টন পণ্য আর ২০১৯-২০ অর্থবছরে ভারতে গেছে এক লাখ ৪১ হাজার ৬৪৭ টন পণ্য।
এদিকে, বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহার করে গত ২৩ জুলাই ট্রান্সশিপমেন্টের প্রথম চালান গেছে আগরতলায়। আসামের গৌহাটি ও আগরতলার দুটি প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রথম চালানে ৫৩.২৫ মেট্রিক টন রড ও ৪৯.৮৩ মেট্রিক টন ডাল পরিবহন করা হয়।
বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের মতে, ট্রান্সশিপমেন্টের মাধ্যমে ভারতকে যদি রড ও সিমেন্টের মতো উচ্চ চাহিদাসম্পন্ন পণ্য সরবরাহের সুযোগ দেয়া হয় তাহলে আখাউড়া স্থলবন্দরের রফতানি বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। স্থলবন্দরকে আগের মতো চাঙা করতে ভারত থেকে নিষিদ্ধ পণ্য ব্যতীত সবধরনের পণ্য আমদানির অনুমতি দেয়ার দাবি জানিয়েছেন ব্যবসায়ী নেতারা।
আখাউড়া স্থলবন্দরের কাস্টমস ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং (সিঅ্যান্ডএফ) এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ফোরকান আহমেদ খলিফা বলেন, আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে সরাসরি পণ্য রফতানি হতো। এখন কলকাতা থেকে ট্রান্সশিপমেন্টের মাধ্যমে নেয়া হচ্ছে। সেদিক বিবেচনা করলে বন্দরের রফতানি বাণিজ্যে কিছুটা প্রভাব পড়ে। রফতানি করলে আমাদের রেমিট্যান্স আসে। এখন সরাসরি নিজেরা নিয়ে যাচ্ছে। এতে আমাদের ক্ষতি হলো।
আখাউড়া স্থলবন্দরের আমদানি-রফতানিকারক অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম বলেন, যদি ট্রান্সশিপমেন্টের মাধ্যমে রড ও সিমেন্ট পরিবহন কার্যক্রম অব্যাহত থাকে তাহলে স্থলবন্দরের রফতানি বাণিজ্যে ব্যাঘাত ঘটবে। যেহেতু পরীক্ষামূলক চালান, তাই আমরা পর্যবেক্ষণ করছি বিষয়টি।
তিনি আরও বলেন, করোনাভাইরাস এবং বর্ষা মৌসুমের কারণে পণ্যের চাহিদা অর্ধেকের কম। এখন গড়ে ৬০-৭০ হাজার ডলার মূল্যের পণ্য রফতানি হচ্ছে। বন্দর টিকিয়ে রাখতে আমরা নিষিদ্ধ পণ্য ব্যতীত সবধরনের পণ্য আমদানির অনুমতি চাই।
এ ব্যাপারে আখাউড়া স্থল শুল্ক স্টেশনের উপ-কমিশনার কাজী ইরাজ ইশতিয়াক বলেন, এখন ভারত থেকে ৩০টির মতো পণ্য আমদানির সুযোগ আছে। ব্যবসায়ীরা আরও কিছু পণ্য আমদানির অনুমতি চান। চাহিদা অনুযায়ী পণ্য আমদানির অনুমতি চেয়ে ব্যবসায়ীরা সরকারের উচ্চপর্যায়ে যোগাযোগ করেছেন। আমাদের কাছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে এখানকার সামগ্রিক বিষয়ে মতামত জানতে চাওয়া হয়েছে। বর্তমানে বন্দরের যে অবকাঠামো আছে, সেটি দিয়ে আমরা কতটুকু কাভার করতে পারব বা আমাদের কোনো সমস্যা হবে কি-না, আমরা সেই মতামত জানিয়েছি। পণ্য আমদানির অনুমতি সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে আসবে। তবে আগের চেয়ে আরও কিছু পণ্য আমদানির অনুমতি দেয়া হয়েছে।
আজিজুল সঞ্চয়/এএম/এমএআর/পিআর