যে কারণে প্রয়োজন বিদেশি বিনিয়োগ

মেসবাহুল হক
মেসবাহুল হক মেসবাহুল হক , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৮:৫৬ এএম, ২৩ জুলাই ২০২০

অডিও শুনুন

বেশ কয়েক বছর ধরেই বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের তেমন চাঞ্চল্য নেই। এর মধ্যে মহামারি আকারে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব। ফলে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের খরা যেন আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। বিনিয়োগ নেই, আসছে না নতুন কোনো প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠান নেই, নেই কোনো কর্মসংস্থানও। করোনা মহামারিকালে নতুন করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি তো দূরের কথা, ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা আসায় ইতোমধ্যে হাজার হাজার মানুষ কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েছেন।

এমন পরিস্থিতিতে নতুন করে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বিনিয়োগের কোনো বিকল্প নেই। সেটি দেশীয় পর্যায়ে হোক বা বিদেশি বিনিয়োগ। এছাড়া প্রতি বছর দেশের শ্রমবাজারে যুক্ত হওয়ার অপেক্ষায় থাকেন ২০ লাখ তরুণ। এসব তরুণের জন্য মানসম্মত কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সরকারি ও বেসরকারিভাবে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ প্রয়োজন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বৈশ্বিক কোভিড-১৯ সৃষ্ট অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে দেশকে বহুমুখী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। আগামী বছর গোটা বিশ্বসহ বাংলাদেশের প্রধান প্রধান রফতানি বাজার যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পড়তে পারে। এতে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধিও তিন শতাংশের নিচে নেমে আসতে পারে। ইতোমধ্যে দেশে প্রবৃদ্ধির চালিকাশক্তি হিসেবে পরিচিত কর্মসংস্থান, রফতানি ও রেমিট্যান্সের ওপর স্বল্প মেয়াদের জন্য হলেও নিম্নগামিতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থা- আঙ্কটাডের হিসাব অনুযায়ী, আগামী বছর বিশ্বব্যাপী প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের পরিমাণ ৪০ শতাংশে নেমে আসতে পারে, যা হবে গত কয়েক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ পতন।

busness

পতনের এই ভয়াবহতায় দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল রাখতে, একইসঙ্গে লাখ লাখ তরুণের জন্য মানসম্মত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পূর্বের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন বেশি-বিদেশি পর্যাপ্ত বিনিয়োগ প্রয়োজন— বলছেন অর্থনীতিবিদরা। কারণ বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়লে নতুন নতুন কারখানা বাড়বে, কারখানা বাড়লে কাজের নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরি হবে। মানুষের আয় বাড়বে, সেইসঙ্গে বাড়বে জীবনযাত্রার মানও।

করোনা-পরবর্তী বিশ্ব অর্থনীতিতে বিদেশি বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ কেন প্রয়োজন, বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিতে বাংলাদেশের অবস্থান কোথায়— তা নিয়ে চার পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে দ্বিতীয়টি।

বিনিয়োগ কেন প্রয়োজন— জানতে চাইলে ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্ট্যাডিজের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ও অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘যেকোনো দেশে যত বেশি বিনিয়োগ হবে তত বেশি রিটার্ন আসবে। এক্ষেত্রে দেশি-বিদেশি যে বিনিয়োগই হোক না কেন। আমাদের দেশে যদি বিদেশিরা বিনিয়োগ করে তাহলে তারা ভিন্ন ধরনের পণ্য উৎপাদন করবে। তারা সরকারকে ট্যাক্স দেবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, আমাদের দেশে নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে।’

busness

‘তাই দেশীয় বিনিয়োগের পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগও প্রয়োজন। তবে হ্যাঁ, আমরা সবকিছু বেদেশিদের হাতে ছেড়ে দিতে পারি না। কোন কোন খাতে আমরা বিনিয়োগ চাই, সেসব ক্ষেত্রে পলিসি ঠিক করতে হবে সরকারকে। বিদেশিরা আমাদের দেশে এসে অস্ত্র উৎপাদন করতে চাইলে তো আমরা দেব না। সরকার দেশের প্রয়োজন বুঝে কোথায় এবং কোন ধরনের বিনিয়োগে উৎসাহিত করা হবে, সেগুলো ঠিক করে দেবে। তবে, যেকোনো বিনিয়োগই কর্মসংস্থান, সরকারের রাজস্ব আদায়সহ দেশের উৎপাদন বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে।’

এ বিষয়ে পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান এবং সাবেক বিশ্বব্যাংক গ্রুপের প্রাইভেট সেক্টর স্পেশালিস্ট অর্থনীতিবিদ ড. এম. মাসরুর রিয়াজ জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিদেশি বিনিয়োগ কয়েকটা কারণে প্রয়োজন। ডেভেলপিং কান্ট্রিকে আরও উন্নতির দিকে এগোতে হলে যে পরিমাণ ক্যাপিটাল প্রয়োজন, সেটা সাধারণত কোনো উন্নয়শীল দেশে থাকে না। কিন্তু বিদেশি বিনিয়োগ হলে সেক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় কিছু ক্যাপিটাল পাওয়া যায়।’

তিনি বলেন, ‘বিদেশি বিনিয়োগের সঙ্গে সঙ্গে নতুন পণ্য বানানোর জন্য সেসব দেশ থেকে উন্নত কিছু টেকনোলজি আসে। ওইসব প্রতিষ্ঠানে যারা কাজ করে তাদের মাধ্যমে দেশে উন্নত টেকনোলজির ট্রান্সফার হয়। এছাড়া একেবারে নতুন ধরনের পণ্য উৎপাদন করে বিদেশে রফতানি করতে খুব বেগ পেতে হয়। অনেক সময় বিশ্ববাজার নতুন দেশকে বিশ্বাস করতে চায় না। তবে, ওই ধরনের পণ্য ইতোমধ্যে বিশ্ববাজারে রফাতনি করে এমন কোম্পানি যদি বাংলাদেশে এসে পণ্য উৎপাদন করে রফতানি করতে চায় তাহলে বিষয়টা সহজ হয়।’

busness

‘বিদেশি উদ্যোক্তাদের সঙ্গে যৌথভাবে বিনিয়োগের মাধ্যমে স্থানীয়ভাবেও উদ্যোক্তা তৈরি হয়। তাদের নলেজের মাধ্যমে স্থানীয় উদ্যোক্তারা উপকৃত হন। এছাড়া আমাদের দেশের ক্যাপিটাল কম, পণ্যের বৈচিত্র্যকরণও সেভাবে হয়নি। এসব কারণে আমাদের দেশে বেশি বেশি পরিমাণে বিদেশি বিনিয়োগ প্রয়োজন’— মনে করেন এ অর্থনীতিবিদ।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ইএবি) সভাপতি এবং বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সাবেক সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী বলেন, ‘প্রতি বছর একটা বড় সংখ্যক মানুষ শ্রম বাজারে আসে। এবার করোনার কারণে সেটা হচ্ছে না। দেশীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে কিছু কর্মচ্যুতের ঘটনাও ঘটছে। বিশ্ববাজার সংকুচিত হচ্ছে, চাহিদাও কমছে। তাই আগামীতে নতুন নতুন কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে আমাদের বেশ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে।’

‘নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে দেশীয় বিনিয়োগের পাশাপশি বিদেশি বিনিয়োগ খুব প্রয়োজন। আমরা মধ্যম আয়ের দেশের দিকে পা দিয়েছি। সেটাকে যদি আরও সামনের দিকে নিয়ে যেতে চাই তাহলে মাথাপিছু আয় বাড়াতে জিডিপির প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হবে। এসবের জন্যই দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানো প্রয়োজন।’

busness

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনা সংকটের আগে থেকেই দেশে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগে চলছে স্থবিরতা। যেটা বাড়ছে, সেটা সরকারি খাতের বিনিয়োগ। করোনা সংক্রমণের পর এ খাতে বিনিয়োগ আরও কমেছে। তারপরও সরকার চাচ্ছে, ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ যেন বাড়ে। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সরকার এবার বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ মোট জিডিপির ২৫.৩ শতাংশে উন্নীত করতে চায়। যা গত অর্থবছরে ছিল মাত্র ১২.৭২ শতাংশ।

গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে ব্যক্তি উদ্যোক্তা খাতে বিনিয়োগ হয়েছে তিন লাখ ৫৬ হাজার ৩৩০ কোটি টাকা। অথচ করোনা মহামারির মধ্যে সরকার চলতি অর্থবছরে আরও অতিরিক্ত চার লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ আশা করছে।

সবমিলিয়ে চলতি অর্থবছরে দেশে বেসরকারি বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে আট লাখ দুই হাজার ৩৩০ কোটি টাকা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশাল এই লক্ষ্যমাত্রা কিছুটা হলেও অর্জন সম্ভব যদি দেশীয় বিনিয়োগের পাশাপশি বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়ানো যায়।

এমইউএইচ/এমএআর/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।