বিপাকে বায়িং হাউজ, সহায়তা চান ব্যবসায়ীরা
>> বিদ্যমান উৎসে কর কমানোর দাবি
>> সরকার ঘোষিত প্রণোদনার সুবিধা দাবি
>> বন্ধ হয়েছে ১৫টির মতো প্রতিষ্ঠান
>>উচ্চশিক্ষিতদের বেকার হওয়ার আশংকা
দেশের রফতানি আয়ের ৮৫ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার এ পোশাক রফতানিতে বড় ভূমিকা রাখছে বায়িং হাউজগুলো। তারা বিদেশি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দেশের পোশাক প্রস্তুতকারকদের যোগসূত্র স্থাপন করেন। নিশ্চিত করেন রফতানি ক্রয়াদেশ। কিন্তু চলমান করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে বিশ্বব্যাপী ব্যবসা-বাণিজ্য কমে যাওয়ায় দুরবস্থায় পড়েছে বাইং হাউজগুলো।
ব্যবসা না থাকায় অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এ মহামারির সংকটে সরকারের নগদ প্রণোদনাসহ নীতিসহায়তা জরুরি বলে মনে করছেন এ খাতের উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীরা। তা না হলে বন্ধ হবে বায়িং হাউজ, বিপাকে পড়বে পোশাক কারখানা, বেকার হবেন উচ্চশিক্ষিতরা।
সাধারণত বায়িং হাউজ তৃতীয় পক্ষ হিসেবে কাজ করে। বিদেশি ক্রেতা বা বায়ারদের কাছ থেকে অর্ডার নিয়ে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে দেয়। দুই পক্ষের যোগসূত্র করিয়ে দিয়ে রফতানি আদেশ নিশ্চিত করে। এর বিনিময়ে তারা কিছু কমিশন পায়। বায়িং হাউজগুলোতে মূলত উচ্চশিক্ষিত তরুণ-যুবকরা কাজ করেন। যারা কর্মদক্ষতায় বিদেশি বড় বড় ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠানের মন জয় করে দেশের পোশাক কারখানার জন্য কাজ এনে দেন। ফলে লাখ লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থান নিশ্চিত হয়। দেশও পায় হাজার হাজার কোটি ডলারে রফতানি আয়। কিন্তু সময় এখন খারাপ। করোনা পরিস্থিতির কারণে বেকার অনেক শিক্ষিত যুবক। দেশে প্রায় সাড়ে আটশর মতো বায়িং হাউজ আছে। যেখানে প্রায় চার থেকে পাঁচ লাখ উচ্চশিক্ষিতের কর্মসংস্থান ছিল। দিন দিন এ সংখ্যা বাড়লেও এখন অধিকাংশই বেকার।
ব্যবসায়ী ও খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, রফতানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্পে বায়িং হাউজের ভূমিকা ব্যাপক। দেশের পোশাক কারখানার বড় অংশই বায়িং হাউজের ওপর নির্ভরশীল। গার্মেন্ট পণ্য রফতানির জন্য বিদেশি ক্রেতার কাছ থেকে ক্রয়াদেশ নিয়ে স্থানীয় উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কাজ করে বায়িং হাউজগুলো। দেশের পোশাক রফতানির ৮৫ শতাংশই তাদের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। কিন্তু করোনাভাইরাসের চলমান সংকটের কারণে নাজুক অবস্থায় পড়েছে দেশের সবচেয়ে বড় রফতানি আয়ের সহায়তাকারী এ প্রতিষ্ঠানগুলো। ব্যবসা কমে যাওয়ায় বন্ধ হচ্ছে অনেক প্রতিষ্ঠান। বেকার হচ্ছেন অনেক শিক্ষিত যুবক। মহামারির এ সময়ে লোকসানের মুখে থাকা দেশের গুরুত্বপূর্ণ খাতটি বাঁচাতে নগদ সহায়তা, উৎসে আয়কর কমানোসহ সরকারের নীতিসহায়তা দরকার।
করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে লোকসানের মুখে এ খাতের উদ্যোক্তাদের জন্য সহযোগিতা চেয়েছে বাংলাদেশ গার্মেন্টস বায়িং হাউজ অ্যাসোসিয়েশন (বিজিবিএ)। সংগঠনটি বলছে, করোনায় আর্থিক ক্ষতি মোকাবিলায় সেবাসহ বেশ কয়েকটি খাতের জন্য প্রধানমন্ত্রী প্রণোদনা প্রদানের ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা না থাকায় শতভাগ রফতানি সেবা দেয়া সত্ত্বেও বায়িং হাউজগুলো প্রণোদনার সহায়তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এজন্য ব্যাংক খাতকে উদ্যোগী ভূমিকা নিতে হবে। অন্যথায় এ প্রণোদনা ঘোষণার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে।
বিজিবিএ বলছে, সম্প্রতি বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) বিদেশি বায়িং হাউজ ও টেক্সটাইল লিয়াজোঁ অফিসকে বাংলাদেশে ব্যবসা করার অনুমতি দিয়েছে। যারা ৭০-৮০ জন কর্মী নিয়ে এ দেশের প্রচলিত শ্রম আইনসহ অন্যান্য আইন উপেক্ষা করে ব্যবসা করছে। দেশে বস্ত্র আইন ২০১৮ প্রণয়ন করার পরও টেক্সটাইল খাতে এ ধরনের লাইসেন্স দেয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে সংগঠনটি। পাশাপাশি এটি বন্ধে সংশ্লিষ্টদের প্রতি দাবি জানিয়েছে।
এছাড়া রেডিমেড গার্মেন্ট শিল্পে সময়ের তাগিদে ডাইভারসিফিকেশন প্রয়োজন জানিয়ে পিপিই, মাস্কসহ সংক্রমণ নিরোধক বস্ত্রশিল্প প্রস্তুত করে রফতানি/দেশি বাজার সম্প্রসারিত করা জরুরি- বলছে সংস্থাটি। তাদের পক্ষ থেকে বাজেটে বায়িং হাউজগুলোর অগ্রীম আয়কর ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা এবং নতুন বায়িং হাউজকে তিন বছরের জন্য কর রেয়াতের দাবি করা হয়।
চলমান সংকট ও প্রস্তাবিত বাজেট প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ গার্মেন্টস বায়িং হাউজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কাজী ইফতেখার হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, বায়িং হাউজ সাধারণত বিপণনের (মার্কেটিং) কাজটি করে। চলমান করোনা পরিস্থিতিতে আমাদের ব্যবসার অবস্থা খুব খারাপ। বিদেশি বায়াররা পণ্য নিচ্ছে না। আগের পেমেন্টও দিচ্ছে না। তারা বলছে, বৈশ্বিক সমস্যা, ধৈর্য ধরতে হবে। এমন অবস্থায় চলমান সংকট থেকে উত্তরণে আমরা বাজেটে উৎসে আয়কর কমানোর কথা বলেছিলাম। এখন আমরা ১০ শতাংশ কর দেই। এটি কমিয়ে ৫ শতাংশ করার দাবি ছিল। এছাড়া যারা নতুন ব্যবসায় আসছে তাদের ট্যাক্স হলিডে প্রস্তাব করেছিলাম। কারণ নতুনরা এসেই যদি লোকসানে পড়ে তাহলে তারা আর সামনে এগোতে পারবে না। অন্যরাও নিরুৎসাহিত হবে। কিন্তু বাজেটে আমাদের কোনো প্রস্তাবই রাখা হয়নি।
তিনি আরও বলেন, বেশিরভাগ কারখানা কাজের জন্য বায়িং হাউজের ওপর নির্ভরশীল। তাই গার্মেন্ট সচল রাখতে হলে বায়িং হাউজগুলোকে বাঁচাতে হবে। এজন্য আগামী চার থেকে ছয় মাস তাদের সাপোর্ট দিতে হবে। আমরা নিজের টাকায় ব্যবসা করি। আমাদের ঋণ নেই; আমরা খেলাপিও নই। আমরা সবসময় সরকারকে ট্যাক্স দেই। এখন আমরা সমস্যায় পড়েছি, আমাদের সহযোগিতা প্রয়োজন। যদি এখন সাপোর্ট না পাই তাহলে অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবে। প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়া মানে কর্মী বেকার হওয়া। আর বায়িং হাউজের কর্মী বেকার মানে শিক্ষিত বেকার। এটি সমাজে বড় প্রভাব ফেলবে বলে মনে করি।
বিজিবিএ'র সেক্রেটারি জেনারেল আমিনুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, করোনায় আমাদের ব্যবসা প্রায় স্থবির। চলমান সংকটে ইতোমধ্যে ১৫ থেকে ১৬টি হাউজ বন্ধ হয়েছে। আগামীতে এ অবস্থা চলতে থাকলে ২০০ থেকে ২৫০টি প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবে। এমন পরিস্থিতিতে সরকারের সহায়তা ছাড়া এ খাত টিকিয়ে রাখা অসম্ভব।
তিনি আরও বলেন, করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত সেবা খাতের জন্য প্রধানমন্ত্রী প্রণোদনার ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকায় এ সুবিধা থেকে আমরা বঞ্চিত হচ্ছি। ব্যাংকগুলো আমাদের সহযোগিতা করছে না। তৈরি পোশাক খাতের সহায়ক হিসেবে কাজ করে বায়িং হাউজ। আমরা শতভাগ রফতানির সেবা দিয়ে থাকি। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা প্রয়োজন।
এছাড়া বিমানবন্দরে রফতানি পণ্যের স্যাম্পল ক্লিয়ারিং করতে এখন সাতদিন থেকে কোনো কোনো সময় ৩০ দিনও লেগে যায়। এগুলো দ্রুত ছাড় এবং খরচ কমানোর ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি বলেও মত দেন বায়িং হাউজের এ উদ্যোক্তা।
এসআই/এমএআর/জেআইএম