টানা ঝড়-বৃষ্টিতে উত্তরাঞ্চলের ধান চাষিদের স্বপ্নভঙ্গ
সুপার সাইক্লোন আম্ফানের পর দফায় দফায় ঝড় ও টানা বৃষ্টিতে উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এ অঞ্চলে অনেকে লেট ভ্যারাইটির ধান আবাদ করায় ধান পাকতে দেরি হয়েছে। এ অঞ্চলে ধান কাটার পুরো মৌসুম শুরু হতেই চার দফা ঝড় বয়ে যায়। এতে খেতের পাকা ধান ঝরে মাটিতে পড়ে যায়। এর ওপর টানা বৃষ্টিতে হাজার হাজার একর জমির ধান পানির নিচে ডুবে গেছে। ফলে বোরো ধান নিয়ে উত্তরের কৃষক যে স্বপ্ন দেখেছিল তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। রাজশাহী, নাটোর, বগুড়া, জয়পুরহাট, গাইবান্ধা, রংপুর ও দিনাজপুরে ধানের যে ক্ষতি হয়েছে তার ছায়া জাতীয় উৎপাদনেও পড়বে বলে চাষিদের শঙ্কা।
বগুড়ার ধুনট উপজেলার চরপাড়া গ্রামের আদর্শ কৃষক আকিমুদ্দিন শেখ জাগো নিউজকে বলেন, ‘বোরো ধান আবাদে খরচ বেশি, দাম কম, মজুর সংকট ইত্যাদি কারণে বেশি জমিতে ধান আবাদ করা বাদ দিয়েছি। এবার তিন বিঘা জমিতে ধান করেছি শুধু খাওয়ার জন্য। এই তিন বিঘা জমির ধান কেটে বাড়িতে আনতে হাঁপিয়ে উঠেছি। দফায় দফায় ঝড়, বৃষ্টিতে ধান পানিতে পড়াসহ নানা কারণে ধানের ক্ষতি হয়েছে। এসব কারণে এবার ষোলআনা ধান ঘরে উঠবে না।’
তিনি বলেন, ধান পানিতে পড়ার কারণে ধান গাছের অর্ধেক কাটতে হয়েছে। এর ওপর টানা বৃষ্টিতে বাকি খড়ও পচে গেছে। ফলে এবার গো-খাদ্যেরও সংকট দেখা দেবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলছেন, আম্ফানের আগে বগুড়ায় ৬০ শতাংশ ধান কাটা হলেও ৪০ শতাংশ ধান কাটা সম্ভব হয়নি। দেরিতে ধান রোপণ করার কারণে ধান পাকতে দেরি হয়ে যায়। তারা বলছেন, উত্তরাঞ্চলে যখন মৌসুম শুরু তখনই ঝড়-বৃষ্টি হানা দেয়।
বগুড়ার কাহালু উপজেলার পালপাড়া গ্রামের রামচন্দ্র মোহন্ত জানান, জলাবদ্ধতার কারণে তার দেড় বিঘা জমির পুরোটাই এখনও পানির নিচে ডুবে আছে। তিনি বলেন, আমি ধান পেতাম ২৪ মণ, কিন্তু এখন চাষ খরচের ১৫ হাজার টাকার একটিও ফেরত আসবে না জমি থেকে।
একই উপজেলার জামতলা গ্রামের আব্দুল কাদের জানান, তার দুই বিঘা জমির পুরোটাই পানিতে ডুবে আছে। তিনি বলেন, আমি দুই বিঘা জমিতে ৪৫ মণ ধান আশা করেছিলাম, কিন্তু একটুও ধান পাব না এবার। খরচ বাবদ ২০ হাজার টাকার পুরোটাই পানিতে গেছে।
জয়পুরহাটের চাষিদের দাবি, প্রাকৃতিক দুর্যোগে এবার তাদের ধানের ফলন কমেছে প্রায় সাড়ে ১২ লাখ মণ। এতে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে কমপক্ষে ৫০ কোটি টাকা। আম্ফানসহ কয়েক দফা ঝড়, শিলাবৃষ্টি আর জলাবদ্ধতায় জয়পুরহাটে বিপুল পরিমাণ বোরো ধান নষ্ট হয়ে গেছে। কৃষি বিভাগ এ খবরের সত্যতা নিশ্চিত করে বলেছে, ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরির কাজ শুরু হয়েছে, যেন সরকার সুযোগ দিলে তাদের সহযোগিতা করা যায়।
জয়পুরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক এস এম মেফতাহুল বারি বলেন, কৃষি বিভাগে প্রাথমিক যে তথ্য এসেছে, তাতে বলা হয়েছে এলাকাভেদে ধানের ক্ষতি হয়েছে ১০ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত। তিনি আরও জানান, চার দফা ঝড়-বৃষ্টির পাশাপাশি জলাবদ্ধতা এবং ধান কাটার শ্রমিক না থাকায় ক্ষতি কিছুটা বেশি হয়েছে।
নাটোরের সিংড়া উপজেলার চলনবিল এলাকার প্রায় ৩০ কোটি টাকার বোরো ধান শিলাবৃষ্টিতে নষ্ট হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। তিনি বলেন, ফসল নষ্ট হওয়ায় এ অঞ্চলের অন্তত দুই হাজার কৃষক সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছেন। সম্প্রতি ত্রাণ বিতরণকালে তিনি সাংবাদিকদের এ কথা বলেন।
নাটোরের কৃষকদের দাবি, সুপার সাইক্লোন আম্ফান পরবর্তী ঝড়-বৃষ্টিতে চলনবিল অধ্যুষিত নাটোরের সিংড়া ও বড়াইগ্রাম উপজেলায় ধানখেত পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। কৃষি বিভাগের হিসাব মতে, সিংড়ায় ৫০০ থেকে ৬০০ হেক্টর ও বড়াইগ্রামে ৬ হেক্টর জমির পাকা ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। এছাড়া সিংড়ায় প্রায় ৪৫ হেক্টর জমির ভুট্টা খেত চলে গেছে পানির নিচে। কৃষকদের দাবি, ক্ষতির পরিমাণ আরও বেশি।
সিংড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাজ্জাদ হোসেন বলেন, বৃষ্টির পানি বিল থেকে বের হওয়ার জায়গা বন্ধ করে পুকুর খনন করায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। অন্যদিকে বড়াইগ্রাম উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ইকবাল হোসেন জানান, উপজেলায় এ বছরে চার হাজার ৩০ হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষ হয়েছে। এর মধ্যে ৬ হেক্টর জমির ধান অতিরিক্ত বর্ষণের কারণে পানির নিচে তলিয়ে গেছে।
কুড়িগ্রাম উজান থেকে আসা পাহাড়ি ঢল ও প্রবল বর্ষণে চরাঞ্চলের অধিকাংশ নিচু জমির পাকা বোরো ধান ও উঠতি পাটসহ অন্যান্য ফসল ডুবে গেছে। কৃষকরা কোমড় পানিতে নেমে বাধ্য হয়ে আধাপাকা ধান কাটছেন। এ দৃশ্য জেলার অধিকাংশ চরের।
সদর উপজেলার দুধকুমার নদের পূর্ব পারের চরের কৃষক সামছুল হক বলেন, অনেক কষ্ট করে টাকা জমিয়ে এক বিঘা জমিতে ধান আবাদ করেছিলাম। পুরো ধান বৃষ্টি ও নদীর পানিতে ডুবে গেছে। এবার এক ছটাক ধানও ঘরে উঠবে না। একই অবস্থা সদরসহ জেলার বিভিন্ন চর এলাকার কৃষকের।
এ সপ্তাহের টানা বৃষ্টিতে দিনাজপুর ফুলবাড়ী উপজেলার কয়েকশ বিঘা ধানের জমি তলিয়ে গেছে। আম্ফান ও গত কয়েকদিনের বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হওয়ায় উপজেলার খয়েরবাড়ী ও দৌলতপুর ইউপির ১০ গ্রামের কৃষকের নিম্নাঞ্চলের জমির ধান পানির নিচে চলে যায়।
বিরামপুর উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, এবার উপজেলার পৌর এলাকা ও সাতটি ইউনিয়নে ১৫ হাজার ৭০০ হেক্টর জমিতে উচ্চ ফলনশীল বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হলেও অর্জিত হয়েছে ১৬ হাজার ৯৫ হেক্টর জমিতে। ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১৩ হাজার মেট্রিক টন। এর মধ্যে নিচু স্থান হওয়ায় এবং ভারতীয় স্লুইসগেট বন্ধ থাকায় ২০ হেক্টর ধান পানিতে তলিয়ে গেছে এবং ১৫০০ হেক্টর জমির ধান ঝড়ো হাওয়ার কারণে মাটিতে শুয়ে গেছে।
ফুলবাড়ী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এটিএম হামিম আশরাফ বলেন, ওই এলাকার ৮০ হেক্টর জমির ধান তলিয়ে গেছে। এর মধ্যে দুই দশমিক পাঁচ হেক্টর জমির ধান ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে জানান তিনি।
এফএইচএস/এসআর/এমএস