করোনাকালের অর্থনীতি : বিনিয়োগ আকৃষ্টে ১৪ সুপারিশ

মেসবাহুল হক
মেসবাহুল হক মেসবাহুল হক , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১০:১৪ পিএম, ১০ মে ২০২০

>> সব সেক্টরের জন্য বিদেশি ঋণের ব্যবস্থা করা
>> ব্যবসাবান্ধব ভ্যাট-ট্যাক্স ব্যবস্থা প্রবর্তনের সুপারিশ
>> সুপারিশমালা পর্যবক্ষেণ করছে অর্থ মন্ত্রণালয়

বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে স্থবির হয়ে পড়েছে গোটা বিশ্ব। দেশেও প্রায় দেড় মাস ধরে চলছে সাধারণ ছুটি। এই ছুটিকে কার্যত লকডাউনই বলা চলে। এতে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের উৎপাদন বন্ধ, ধস নেমেছে ব্যবসা-বাণিজ্যে। ফলে বর্তমানে ও আগামী দিনে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ ব্যাপক আকারে কমার আশঙ্কা রয়েছে। তাই করোনাকালীন ও পরবর্তী সময়ে দেশে উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগে আকৃষ্ট করতে ব্যবসাবান্ধব ভ্যাট-ট্যাক্স প্রণয়নের পাশাপাশি শিল্পকারখানায় ব্যবহৃত বিদ্যুৎ-গ্যাস-পানির দাম কমানোসহ ১৪ দফা সুপারিশ অর্থ মন্ত্রণালয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)।

সম্প্রতি বিডা’র পরিচালক মো. আরিফুল হক স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত একটি সুপারিশমালা অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থসচিব আব্দুর রউফ তালুকদারের নিকট পাঠানো হয়েছে। বিডার এসব সুপারিশ অর্থ মন্ত্রণালয় পর্যালোচনা করেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ২০১৯ সালে বিশ্বে করোনাভাইরাসের কোনো প্রভাব ছিল না। তারপরও দেশে বিদেশিদের বিনিয়োগ কমেছে। গত বছর দেশে মোট বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে ৩৪০ কোটি মার্কিন ডলার, যা আগের বছরের চেয়ে ৬ শতাংশের মতো কম। একইসঙ্গে দেশে স্থানীয় বিনিয়োগও ভালো নয়। এর ওপর এসেছে করোনাভাইরাসের মরণ কামড়। ফলে আগামীতে বিনিয়োগ ভয়াবহ আকারে কমার আশঙ্কা রয়েছে। বিনিয়োগ না হলে কমবে কর্মসংস্থান, বাড়বে বেকারত্ব। তাই আগামীতে দেশে বিনিয়োগ খরা কিছুটা কাটাতে এসব সুপারিশ করেছে বিড়া।

বিডার সুপারিশমালায় বলা হয়, করোনাকালে ও পরবর্তীতে ব্যবসাকে টিকিয়ে রাখতে এবং উদ্যোক্তাদের মনোবল ধরে রাখার জন্য ইতিমধ্যে বিডা ব্যবসায়ীসহ সরকারের বিভিন্ন অংশীদারদের সঙ্গে কয়েকদফা বৈঠক করেছে। এসব বৈঠকে আগামীতে ব্যবসা-বাণিজ্য টিকিয়ে রাখতে ১৪ দফা সুপারিশ করা হয়েছে।

সুপারিশগুলো হলো-

>> করোনাকালে ও পরবর্তী সময়ে ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি ফেরাতে সরকারকে একটি উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে। এ টাস্কফোর্স সঙ্কট নিরসনে কি কি পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়, সে বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করবে।

>> সব সেক্টর বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরের জন্য বিদেশি ঋণ গ্রহণের পথ সহজ করা যেতে পারে।

>> বহির্বিশ্বের ঋণদাতাদের কাছ থেকে ঋণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

>> আমদানি কমানোর জন্য অতি প্রয়োজনীয় পণ্য উৎপাদনে দরকারি কাঁচামাল দেশে উৎপাদনের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

>> মাসিক ভ্যাট প্রদানের সময়সীমা বাড়ানো যেতে পারে।

>> ইনকাম ট্যাক্স অর্ডিন্যান্স ১৯৮৪ অনুযায়ী ৬০ দিনের মধ্যে ট্যাক্স প্রদানের যে বিধিমালা রয়েছে সেটা শিথিল করা যেতে পারে।

>> ওয়ার্কার্স প্রফিট পার্টিসিপেশন ফান্ড (ডব্লিউপিপিএফ) এবং প্রভিডেন্ট ফান্ড (পিএফ) স্থগিত রাখা যেতে পারে।

>> ব্যবসাবান্ধব ভ্যাট ও ট্যাক্স ব্যবস্থা প্রবর্তনের পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ বা ক্লোজিং বিষয়ে ছাড় দেয়া যেতে পারে।

>> অনাবাসিক বাসিন্দা বা ব্যক্তিদের কর অব্যাহতি দেয়া যেতে পারে।

>> কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নিবন্ধনে বিডা থেকে যেসব ফি আরোপ করা হয়, সেগুলো মহামারিকালীন সময়ে ছাড় দেয়া যেতে পারে।

>> করোনাকালীন সময়ে বন্দরের চার্জ দেয়ার সময় বাড়ানো যেতে পারে।

>> বিনিয়োগ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট জমাদানের সময় বাড়ানো যেতে পারে।

>> শিল্পকারখানায় ব্যবহৃত বিদ্যুৎ-গ্যাস-পানির দাম কমানো কিংবা অন্ততপক্ষে বিল পরিশোধে সময়সীমা বাড়ানো যেতে পারে।

>> নির্ধারিত কিছু কোম্পানির কাছ থেকে সংবিধিবদ্ধ ডকুমেন্ট জমাদানের সময়সীমা বাড়ানো যেতে পারে। কিন্তু দেরিতে জমা দিলে সেক্ষেত্রে কোনোরকম জরিমানা আদায় করা যাবে না।

সুপারিশমালায় আরও বলা হয়, বিডার এসব সুপারিশ প্রয়োজন অনুসারে এবং পরিস্থিতির ভিত্তিতে পরিবর্তন ও সংযোজন করা যেতে পারে। বিডা বিশ্বাস করে সবাইমিলে একযোগে কাজ করলে দেশে অগ্রগতি সম্ভব।

এ বিষয়ে বিডার পরিচালক মো. আরিফুল হক বলন, ‘কোভিড-১৯ এর কারণে চলমান অর্থনীতিতে যে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে, তা পূর্বে ধারণা করা যায়নি। এ ক্ষতি পুরো বিশ্বের ধারণাকে ছাড়িয়ে গেছে। এ ক্ষয়ক্ষতি থেকে বের হওয়ার জন্য এখন সচেতন এবং কার্যকরী পদক্ষেপে গ্রহণ করতে হবে। যার অংশ হিসেবে বিভিন্ন প্রণোদনা ঘোষণা করেছে সরকার।’

তিনি আরও বলেন, ‘এখন করোনার প্রভাবে দেশের বিনিয়োগে যে নাজুক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আগামীতে এটা আরও বাড়তে পারে। এ জন্য বিনিয়োগ সংক্রান্ত সকল সংস্থায় বিনিয়োগ পলিসি সহজ করাসহ তদারকি বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে আপদকালীন সময়ের জন্য হলেও কোম্পানি নিবন্ধনের ক্ষেত্রে কিছু কিছু শর্তে ছাড় দেয়া যেতে পারে।’

এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিডার এসব সুপরিশ পর্যালোচনা করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। প্রয়োজন হলে আগামীতে এর কিছু অংশ বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।’

এদিকে করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের জন্য কয়েক দফায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায় এক লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেন। এরমধ্যে শিল্প ঋণের জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকা, রফতানিমুখী শিল্পের শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধে পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়।

পাশাপাশি নিম্ন আয়ের মানুষ ও কৃষকের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকা, রফতানি উন্নয়ন ফান্ড গঠনে ১২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, প্রি-শিপমেন্ট ঋণে পাঁচ হাজার কোটি টাকা, গরিব মানুষের নগদ সহায়তা বাবদ ৭৬১ কোটি টাকা, অতিরিক্ত ৫০ লাখ পরিবারকে ১০ টাকা কেজিতে চাল দেয়ার জন্য ৮৭৫ কোটি টাকা। এছাড়া করোনা মোকাবিলায় স্বাস্থ্য খাতে বাজেটের অতিরিক্ত ৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়।

যদিও এক লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজের অধিকাংশই সংস্থান হবে দেশের ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে। এরপরও প্রণোদনা প্যাকেজের ঋণে সুদ ভর্তুকি বাবদ প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা এবং রফতানিমুখী শিল্পের শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধে পাঁচ হাজার কোটি টাকার সংস্থান বাজেট থেকে হবে। গরিব মানুষের নগদ সহায়তার ৭৬১ কোটি টাকা, অতিরিক্ত ৫০ লাখ পরিবারকে ১০ টাকা কেজিতে চাল দেয়ার জন্য ৮৭৫ কোটি এবং ৬১৮ কোটি টাকা, স্বাস্থ্য খাতের জন্য অতিরিক্ত ৪০০ কোটি টাকাসহ বেশকিছু অর্থ বাজেট থেকে সংস্থান হবে।

এমইউএইচ/এফআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।