বিশেষ সুবিধায় ঋণ নিয়মিত করতে মরিয়া খেলাপিরা
খেলাপি ঋণের লাগাম টানতে বিশেষ সুবিধা দিচ্ছে সরকার। মাত্র ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ৯ শতাংশ সুদহারে ঋণ পুনঃতফসিলের (রিশিডিউলিং) সুবিধা নিতে পারছেন খেলাপিরা। এ সুবিধা নিতে যেন মরিয়া তারা। অন্যদিকে মন্দ ঋণ কমাতে ব্যাংকগুলোও ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
অর্থনীতি বিশ্লেষকদের সমালোচনা সত্ত্বেও সরকারের চাপে বিশেষ সুবিধার সুযোগ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অর্থমন্ত্রীর সুপারিশে গত ১৬ মে ঋণ পুনঃতফসিল ও এককালীন এক্সিট-সংক্রান্ত বিশেষ নীতিমালা জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত মন্দমানে খেলাপি ঋণ মাত্র ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টের বিপরীতে ১০ বছরের জন্য পুনঃতফসিলের সুবিধা দেয়া হয়। এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সুদহারের সীমা ঠিক করে দেয়া হয় ৯ শতাংশ। পুনঃতফসিলের আগে গ্রাহককে সুদ মওকুফ সুবিধাও দেয়া যাবে।
সার্কুলার জারির তারিখ থেকে ৯০ দিনের মধ্যে এ সুবিধার জন্য আবেদন করতে বলা হয়। কিন্তু সার্কুলারের ওপর উচ্চ আদালতের দু'দফা স্থগিতাদেশের কারণে আবেদন কার্যক্রম অনেক দিন বন্ধ ছিল। পরবর্তীতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আপিলের পরিপ্রেক্ষিতে সময় বাড়িয়ে আবেদনের শেষদিন নির্ধারণ করা হয় ২০ অক্টোবর।
বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য রোববার (২০ অক্টোবর) শুনানি শেষে হাইকোর্টের আদেশের মেয়াদ আবারও বাড়িয়ে এক মাস অথবা এ বিষয়ে জারি করা রুল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত এ মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। অর্থাৎ খেলাপিরা বিশেষ সুবিধায় ঋণ পুনঃতফসিলে আরও এক মাস সময় পাবেন। ২০ নভেম্বর পর্যন্ত তারা সময় পাবেন। তবে এ সময় সুবিধাভোগীরা নতুন কোনো ঋণ নিতে পারবেন না।
বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত এক-দেড় মাস ধরে ঋণ খেলাপিরা বিশেষ সুবিধা নিতে ব্যাংকে বেশি ভিড় করছেন। নির্দেশনার বাইরে আরও বেশি সুযোগ নিতে প্রভাবশালীদের দিয়ে অনেকে লবিংও করছেন। বারবার রিশিডিউলিং করে খেলাপি হয়েছেন এমন গ্রাহকরাও ঋণ নিয়মিত করতে ব্যাংকে ধরণা দিচ্ছেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, প্রতিদিনই বিভিন্ন জায়গা থেকে ফোন আসে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার সুবিধার পেতে। তিনবার রিশিডিউলিং করে খেলাপি হয়েছেন এমন গ্রাহকও লবিং করছেন। কোনো গ্রাহককে সুবিধা দেয়া হবে- এটা তো স্ব স্ব ব্যাংকের বিষয়। এখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক হস্তক্ষেপ করতে পারে না। এটা বলার পরও লবিং করছে।
বর্ধিত সময় সম্পর্কে তিনি বলেন, বিশেষ সুবিধার বিষয়টি এখন উচ্চ আদালতে বিচারাধীন। ২০ অক্টোবর পর্যন্ত সময় ছিল। আজ যেহেতু আদালত সময় বাড়িয়েছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকও সময় বাড়াবে।
এদিকে বিশেষ সুবিধায় ঋণ পুনঃতফসিলের জন্য বেশি ভিড় দেখা যাচ্ছে সরকারি ব্যাংকগুলোতে। ইতোমধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকে পুনঃতফসিলের জন্য আবেদন করেছে সাত শতাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যাংকটির পাওনা ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি। এছাড়া বিশেষ সুবিধার জন্য সোনালী ব্যাংকে আবেদন করেছে এক হাজার, বেসিক ব্যাংকে ৫২০, অগ্রণীতে ৩০০ এবং রূপালী ব্যাংকে আবেদন পড়েছে প্রায় আড়াইশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৮ সালে ২৩ হাজার ২১০ কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিল করেছিল ব্যাংকগুলো। ২০১৯ সালের প্রথম ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন) ঋণ পুনঃতফসিল করেছে ২১ হাজার ৩০৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ গেল বছরের তুলনায় চলতি বছরের জুন পর্যন্ত এটি বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিক (জানুয়ারি-মার্চ) সময়ে ব্যাংকগুলো পাঁচ হাজার ৮৩৯ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করেছে। দ্বিতীয় প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) পুনঃতফসিল করেছে ১৫ হাজার ৪৬৯ কোটি টাকা। প্রথম প্রান্তিকের তুলনায় দ্বিতীয় প্রান্তিকে পুনঃতফসিলের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করেছে তিনগুণেরও বেশি। বিশেষ সুবিধার সময় ছিল অক্টোবরের ২০ তারিখ পর্যন্ত।
পরিসংখ্যান বলছে, দ্বিতীয় প্রান্তিকে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করেছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক। ব্যাংকটি তিন মাসে পাঁচ হাজার ৩৯৪ কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিল করেছে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ তিন হাজার ৩৯৭ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করেছে ইসলামী ব্যাংক। মার্কেন্টাইল ব্যাংক করেছে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। এবি ব্যাংক পুনঃতফসিলের মাধ্যমে ঋণ নিয়মিত করেছে এক হাজার ২০৬ কোটি টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংক পুনঃতফসিল করেছে ৯০৭ কোটি টাকা। ওয়ান ব্যাংক পুনঃতফসিল করেছে ২৯৮ কোটি, ব্র্যাক ব্যাংক ২৭৪ কোটি, প্রিমিয়ার ব্যাংক ২২০ কোটি ও পদ্মা ব্যাংক ঋণ পুনঃতফসিল করেছে ২১৮ কোটি টাকা।
এদিকে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বিভিন্ন ব্যাংকের অনুষ্ঠানে বলেছেন, খেলাপি ঋণ কমাতে সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ সুবিধা দেয়া হয়েছে। খেলাপিরা এ সুযোগ নিয়ে ঋণ নিয়মিত করবেন। কেউ যদি এ সুযোগও গ্রহণ না করেন বা ইচ্ছাকৃতভাবে ঋণ খেলাপি হয়ে বসেন, তাহলে তাদের ছাড় দেয়া হবে না। ব্যাংকের টাকা নিয়ে ফেরত দেবে না আবার সেই কাটা দিয়ে আরাম-আয়েস করবে, এটা তো হতে দেয়া যাবে না।
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ জাগো নিউজকে বলেন, ঋণখেলাপিদের ধরা কঠিন। কারণ সমাজ ও রাষ্ট্রে তারা শক্ত অবস্থান করে নিয়েছে। বিশেষ সুবিধা দিয়ে সরকার তাদের ঋণখেলাপিবান্ধব হিসেবে পরিচয় দিয়েছে। এ সুযোগ আগেও দিয়েছিল, কোনো লাভ হয়নি। এটা ব্যাংক খাতের জন্য ভালো হবে না বরং খারাপ হবে।
তিনি আরও বলেন, খেলাপি ঋণ কমাতে হলে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। খেলাপিদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। তা না হলে এ ধরনের সুযোগ আগামীতে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পদ্মা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও সিইও মো. এহসান খসরু জাগো নিউজকে বলেন, দুই শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে অনেক খেলাপি ঋণ নিয়মিত করতে আমাদের কাছে আবেদন করছেন। এখন পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৫০০ কোটি টাকার মতো ঋণ রিশিডিউলিংয়ের জন্য আমরা বোর্ডে পাঠিয়েছি। পর্ষদ যাচাই-বাছাই করে এটা অনুমোদন দেবে। আরও অনেকে আবেদন করছেন। পরিমাণ আরও বাড়বে।
তিনি বলেন, একদিকে খেলাপিদের কাছ থেকে বিভিন্ন কৌশলে ঋণ আদায় করা হচ্ছে। অন্যদিকে পুনঃতফসিলের মাধ্যমে ঋণ নিয়মিত করা হচ্ছে। আশা করছি, সব মিলিয়ে ডিসেম্বর শেষে আমাদের খেলাপি এখন যা আছে তার অর্ধেকে নেমে আসবে।
সরকারের নির্দেশনায় চলতি বছরের ১৬ মে বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ থেকে ঋণ পুনঃতফসিল ও এককালীন এক্সিট সংক্রান্ত বিশেষ নীতিমালা জারি করে। এতে মাত্র দুই শতাংশ ডাউন পেমেন্টে ৯ শতাংশ সরল সুদে এক বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ টানা ১০ বছর ঋণ পরিশোধের সুযোগ দেয়া হয়। যা নিয়ে বিভিন্ন মহলে নিন্দা ও তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এরপর ওই সার্কুলারের ওপর স্থগিতাদেশ চেয়ে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আদালতে একটি রিট দায়ের করা হয়।
এদিকে বিশেষ এ সুবিধা গ্রহণকারীরা ব্যাংক থেকে আবার নতুন করে ঋণ নিতে পারবেন। প্রচলিত নিয়ম মেনে সতর্কতার সঙ্গে ঋণ দিতে বলা হয়েছে। নতুন ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করলে পুনঃতফসিল সুবিধা বাতিল হবে। সুবিধাগ্রহণের পর নিয়মিত অর্থ পরিশোধ না করলেও তাদের খেলাপি করা যাবে না। এখানে ছাড় দেয়া হয়েছে। নয়টি মাসিক কিস্তির তিনটি এবং ত্রৈমাসিক তিন কিস্তির একটি পরিশোধ না করলেও নিয়মিত থাকা যাবে। তবে মাসিক কিস্তির মধ্যে ছয়টি ও ত্রৈমাসিক কিস্তির দুটি পরিশোধ না করলে পুনঃতফসিল সুবিধা বাতিল করা হবে।
স্বাধীনতার পর থেকে যারা ঋণখেলাপি তাদের এককালীন এক্সিট সুবিধা দেয়া হবে। এক্ষেত্রে তাদের খেলাপি ঋণের হিসাব হবে ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বরের এককালীন হিসাবায়ন ভিত্তিতে। অর্থাৎ ১৯৭১ সালের পর থেকে ২০১৮ সালের ৩১ ডিমেম্বর পর্যন্ত যত খেলাপি ঋণ আছে তার হিসাব করা হবে। কোনো ঋণখেলাপি যদি মনে করেন এককালীন ঋণ পরিশোধ করে খেলাপির তালিকা থেকে বেরিয়ে যাবেন, সে ব্যবস্থাও রাখা হয় সার্কুলারে।
এতে বলা হয়, ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টে ঋণখেলাপিরা ঋণ পরিশোধের জন্য এক বছর পর্যন্ত সময় পাবেন। আগের সব সুদবাবদ পাওনা মওকুফ করা হবে। এককালীন পরিশোধের জন্য সুদহার আরও কম- ব্যাংকের কস্ট অব ফান্ডের সমান। তবে এক বছরের মধ্যে টাকা পরিশোধ না করলে সুবিধা বাতিল হবে।
এই এককালীন এক্সিট সুবিধা ও পুনঃতফসিল সুবিধা কার্যকরের ৯০ দিনের মধ্যে ব্যাংক ও গ্রাহকের মামলা স্থগিত করতে হবে। পরবর্তীতে গ্রাহক কোনো শর্ত ভঙ্গ করলে সুবিধা বাতিল করে মামলা পুনরায় চালু হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের জুন শেষে ব্যাংক খাতে ঋণ বিতরণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে নয় লাখ ৬২ হাজার ৭৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ১২ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা। রাইট অফ বা অবলোপন করা ঋণের পরিমাণ যোগ করা হলে খেলাপি ঋণ দেড় লাখ কোটি টাকা ছাড়াবে।
এর আগে ২০১৮ সালের জুন শেষে অবলোপন বাদে খেলাপি ঋণ ছিল ৯০ হাজার ৩৭২ কোটি টাকা। এ হিসাবে বিগত এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা। আগের প্রান্তিক চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ- এ তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছিল প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা।
এসআই/এমএআর/এমএস