‘অলস’ অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে গেলে কী হবে?

জাগো নিউজ ডেস্ক
জাগো নিউজ ডেস্ক জাগো নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৮:৪৩ এএম, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯

পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণসহ বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। এসব প্রকল্পের অর্থ জোগান দিতে রীতিমতো সরকারকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। সহজে অর্থ পেতে স্বায়ত্তশাসিত, আধা-স্বায়ত্তশাসিত, সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষ, পাবলিক নন-ফাইন্যান্সিয়াল কর্পোরেশনসহ স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের ‘উদ্বৃত্ত’ অর্থাৎ ‘অলস’ অর্থের দিকে নজর দেয়া হচ্ছে।

এখন থেকে এসব প্রতিষ্ঠানের বাড়তি অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা করতে হবে। এমন বিধান রেখে 'সরকারি কোষাগারে জমা প্রদান আইন, ২০১৯' প্রণয়ন করছে সরকার, যা গত ২ সেপ্টেম্বর অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা।

অর্থনীতি বিশ্লেষক, ব্যাংকার ও খাতসংশ্লিষ্টরা জানান, সরকারের এ উদ্যোগের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুই ধরনের প্রভাব রয়েছে। সংগৃহিত অর্থের সঠিক ব্যবহারের ওপর এর সফলতা নির্ভর করবে। কারণ ‘অলস’ অর্থ উন্নয়ন কাজে ব্যয় হলে অর্থনীতির জন্য ভালো।

তবে স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের উদ্বৃত্ত অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে চলে গেলে প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়ে পড়বে। তারা রুটিনকাজের বাইরে কিছু করতে পারবে না। কারণ নতুন উন্নয়নমূলক কাজের ব্যয় নির্বাহে তখন সরকারের দিকেই তাকিয়ে থাকতে হবে। অন্যদিকে, প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থ কোনো না কোনো ব্যাংকে আমানত হিসাবে জমা রেখেছে। বিশাল অঙ্কের এ অর্থ সরকারি কোষাগারে চলে গেলে ব্যাংক খাতে নগদ অর্থের সংকটে পড়বে। এমন অবস্থায় বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থ ভেবেচিন্তে স্থানান্তরের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চলতি বছরের মে মাসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের মোট ৬৮টি স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ব্যাংকে স্থায়ী আমানতের পরিমাণ দুই লাখ ১২ হাজার ১০০ কোটি টাকা। এ অর্থ চলতি (২০১৯-২০) অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির মোট বরাদ্দের চেয়ে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা বেশি।

চলতি বছর উন্নয়ন বরাদ্দ দুই লাখ দুই হাজার ৭২১ কোটি টাকা বরাদ্দ আছে। এদিকে এসব প্রতিষ্ঠানের উদ্বৃত্ত অর্থের পরিমাণ গত এক বছরে চার হাজার ৮৫০ কোটি টাকা বেড়েছে, বলছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। উদ্বৃত্ত এ আয় সরকারি খাতে জমা না দিয়ে নিজস্ব ব্যাংক হিসাবে রাখছে প্রতিষ্ঠানগুলো।

এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, যদি অলস অর্থ সরকার কাজে লাগায় তবে ভালো। এতে রাষ্ট্রের আয় বাড়বে। তবে খেয়াল রাখতে হবে, ওইসব প্রতিষ্ঠান আবার ক্ষতির সম্মুখীন না হয়। তাদের সক্ষমতা অনুযায়ী পর্যাপ্ত সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।
রাষ্ট্রীয় কোষাগারে অর্থ চলে গেলে ব্যাংক খাতে কোনো প্রভাব পড়বে কি-না, জানতে চাইলে সাবেক এ গভর্নর বলেন, ‘সরকার তো অর্থ নিয়ে ফেলে রাখবে না, খরচ করবে। এতে সাময়িক কিছু সমস্যা হতে পরে। সামগ্রিকভাবে তেমন কোনো সমস্যা হবে না। তবে ব্যাংকভেদে কিছুটা সমস্যা হবে। কারণ সংস্থাগুলো তাদের পছন্দ মতো অনেক ব্যাংকে উদ্বৃত্ত এ অর্থ আমানত হিসাবে রেখেছে। এখন টাকা তুলে নিলে ওইসব ব্যাংক সমস্যায় পড়তে পারে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, উদ্বৃত্ত অর্থ আছে এমন স্বায়ত্তশাসিত ও আধা-স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার সংখ্যা ৬৮টি। শীর্ষ ২৫ প্রতিষ্ঠানের কাছে উদ্বৃত্ত অর্থ জমা আছে এক লাখ দুই হাজার ৩৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের কাছে ২১ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা। এছাড়া পেট্রোবাংলার কাছে ১৮ হাজার ২০৪ কোটি, ডিপিডিসির ১৩ হাজার ৪৫৪ কোটি, চট্টগ্রাম বন্দরের নয় হাজার ৯১৩ কোটি, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের কাছে অলস অর্থ পড়ে আছে নয় হাজার ৫০ কোটি টাকা।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ‘অলস’ অর্থের পরিমাণ চার হাজার ৩০ কোটি টাকা। বিসিআইসির কাছে তিন হাজার ৩৯২ কোটি টাকা। সার, কেমিক্যাল ও ফার্মাসিউটিক্যালস ইন্ডাস্ট্রিজের কাছে আছে তিন হাজার ৪২ কোটি টাকা। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অব্যবহৃত অর্থের পরিমাণ দুই হাজার ২৩২ কোটি টাকা। বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ডে দুই হাজার ৮০ কোটি, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সংস্থায় এক হাজার ৯৩০ কোটি, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের কাছে আছে এক হাজার ৮৮৫ কোটি, ঢাকা ওয়াসার আছে এক হাজার ৫৬৪ কোটি, কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের কাছে উদ্বৃত্ত অর্থের পরিমাণ ৪২৫ কোটি টাকা।

মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম বলেন, ‘স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলো তাদের পরিচালন ব্যয়, নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্প বাস্তবায়নে বার্ষিক ব্যয় নির্বাহের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ জমা রাখবে। আপৎকালীন ব্যয় নির্বাহের জন্য পরিচালক ব্যয়ের ২৫ শতাংশ সমপরিমাণ অর্থ সংরক্ষণ করতে পারবে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানের বিধি মোতাবেক যদি পেনশন, প্রভিডেন্ড ফান্ড থাকে সেটাও রেখে দেবে। এরপরও যা থাকবে (উদ্বৃত্ত) সেটা সরকারের কোষাগারে জমা দেবে।

‘ওনাদের বিপদে ফেলা হবে না। প্রয়োজনীয় অর্থ রাখার পর বাকি অর্থ সরকারি কোষাগারে দেবেন’- বলেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব।

স্বায়ত্তশাসনের স্পিরিটের সঙ্গে এ বিষয়টি সামঞ্জস্যপূর্ণ কি-না, জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘না, স্বায়ত্তশাসনে কোনো সমস্যা হবে না। আর্থিক ডিসিপ্লিনেও কোনো সমস্যা নেই। এটা হচ্ছে, ওনাদের যে অলস অর্থ আছে তা সরকারি বিনিয়োগে কাজে লাগানো।’

‘তাদের যদি টাকা প্রয়োজন হয় সরকার তো টাকা দিচ্ছে’- বলেন শফিউল আলম।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি ) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘স্বশাসিত সংস্থার উদ্বৃত্ত অর্থ সরকারের কোষাগারে নেবে- এ ধরনের আইন করছে বলে শুনছি, কিন্তু এখন পর্যন্ত আমরা বিস্তারিত কিছু জানি না। এটা করলে পুরো ব্যাংক খাতে প্রভাব পড়বে। কারণ এ অর্থ কোনো না কোনো ব্যাংকে ডিপোজিট আকারে আছে, এটি চলে গেলে সমস্যা তো হবে। কারণ এটা ব্যাংকেই থাকবে না, চলে যাবে।’

‘সরকার তো এ টাকা ব্যয় করবে। ব্যয় যখন করবে তখন ব্যাংকের মাধ্যমেই করতে হবে। এ প্রক্রিয়ায় কত সময় নেবে- এটাই এখন দেখার বিষয়। যদি বেশি সময় টাকা আটকে থাকে তাহলে বড় প্রভাব পড়বে। কারণ বর্তমানে ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট চলছে’- যোগ করেন তিনি।

এদিকে স্বশাসিত সংস্থার উদ্বৃত্ত অর্থ সরকারি কোষাগারে চলে গেলে প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়ে যাবে- এমনটি মনে করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘তাদের জমা অর্থ চলে গেলে গবেষণা প্রশিক্ষণ উন্নয়নসহ বিশেষ কোনো কাজের ব্যয় নির্বাহে সরকারের মুখাপেক্ষি হয়ে থাকতে হবে। সরকার যদি এ অর্থ সঠিকভাবে ব্যয় করতে না পারে তাহলে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।’

এসআই/এমএআর/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।