বিদেশিদের রেকর্ড শেয়ার বিক্রির চাপ
> বিএসইসির চাপেও থামেনি বিদেশিদের শেয়ার বিক্রি
> বিদেশিদের বিক্রির চাপ সামলানোর সক্ষমতা নেই বাজারের
> শেয়ারবাজারের ইতিহাসে বিদেশিদের টানা ছয় মাস শেয়ার বিক্রি
> ছয় মাসে বিদেশির ক্রয় থেকে বিক্রি বেশি ৬২২ কোটি টাকা
> এই ছয় মাসে ৩৮ হাজার কোটি টাকা মূলধন হারিয়েছে ডিএসই
নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চাপ থাকার পরও বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি অব্যাহত রেখেছেন। সদ্যসমাপ্ত আগস্ট মাসে বিদেশিরা শেয়ারবাজার থেকে যে পরিমাণ টাকার শেয়ার কিনেছেন বিক্রি করে দিয়েছেন প্রায় তার দ্বিগুণ। এ নিয়ে টানা ছয় মাস বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শেয়ার ক্রয় থেকে বিক্রি বেশি করলেন। দেশের শেয়ারবাজোরের ইতিহাসে এর আগে কখনও বিদেশিরা টানা ছয় মাস এমন শেয়ার বিক্রির চাপ অব্যাহত রাখেনি।
বিদেশি বিনিয়োগকারীদের শেয়ার ক্রয়-বিক্রয়ের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) হালনাগাদ তথ্য পর্যালোচনা করে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। বাজারের ওপর আস্থা না পাওয়ায় বিদেশিরা এভাবে শেয়ার বিক্রি করছেন বলে অভিমত শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টদের।
বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মাসের পর মাস শেয়ার বিক্রির চাপ অব্যাহত থাকায় সার্বিক শেয়ারবাজারেও মন্দাভাব দেখা দিয়েছে। প্রায় সাত মাস ধরে মন্দা চলছে শেয়ারবাজারে। বিদেশি শেয়ার বিক্রির চাপ শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টদের মধ্যে উদ্বেগ ছড়িয়েছে। যে কারণে বিদেশিদের শেয়ার বিক্রির প্রবণতা থামাতে বিএসইসি থেকে কয়েকটি ব্রোকারেজ হাউসকে চাপ দেয়া হয়েছে। এরপরও বিদেশিদের শেয়ার বিক্রির প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে।
বিএসইসি সূত্রে জানা যায়, বিদেশিদের অব্যাহত শেয়ার বিক্রি সার্বিক শেয়ারবাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। যে কারণে বিদেশিদের অব্যাহত শেয়ার বিক্রির চাপ থাকায় গত মাসে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের পোর্টফোলিও নিয়ে কাজ করে এমন ব্রোকারেজ হাউসের কর্মকর্তাদের ডাকা হয় এবং বিদেশিদের শেয়ার বিক্রির চাপ কমানোর পদক্ষেপ নিতে বলা হয়। তবে বিএসইসির এমন চাপের পরও বিদেশিদের শেয়ার বিক্রির প্রবণতা আটকানো যায়নি।
সদ্যসমাপ্ত আগস্ট মাসে বিদেশিরা যে টাকার শেয়ার কিনেছেন বিক্রি করেছেন তার থেকে ১০৩ কোটি টাকা বেশি। মাসটিতে বিদেশিরা ১৭৬ কোটি টাকার শেয়ার কেনার বিপরীতে বিক্রি করেছেন ২৭৯ কোটি টাকা। এর আগের মাস জুলাইতে বিদেশিরা শেয়ারবাজার থেকে ৩০৯ কোটি টাকার শেয়ার ক্রয়ের বিপরীতে বিক্রি করেন ৪৭৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ মাসটিতে বিদেশিরা শেয়ার ক্রয় থেকে বিক্রি বেশি করেন ১৬৫ কোটি টাকা।
জুলাই মাসের মতো আগের চার মাসেও বিদেশিদের শেয়ার বিক্রির চাপ ছিল। এর মধ্যে জুনে বিদেশিরা যে পরিমাণ টাকার শেয়ার কেনেন বিক্রি করেন তার থেকে ১১ কোটি বেশি। মাসটিতে বিদেশিরা ২৯৫ কোটি টাকার শেয়ার ক্রয়ের বিপরীতে বিক্রি করেন ৩০৫ কোটি টাকা।
একইভাবে মে মাসে বিদেশিরা শেয়ার ক্রয় থেকে বিক্রি বেশি করেন ৬৫ কোটি টাকা। তার আগের মাস এপ্রিলে ১৫৪ কোটি টাকা। আর মার্চে ক্রয় থেকে বিক্রি বেশি ছিল ১২৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ মার্চ থেকে আগস্ট পর্যন্ত বিদেশিরা যে পরিমাণ টাকার শেয়ার ক্রয় করেছেন বিক্রি করেছেন তার থেকে ৬২২ কোটি টাকা বেশি।
মাসের হিসাবে এর আগে বিদেশিদের শেয়ার বিক্রির টানা চাপ ছিল গত বছর। ২০১৮ সালের এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত টানা পাঁচ মাস বিদেশিরা শেয়ার ক্রয় থেকে বিক্রি বেশি করেন। এর মধ্যে এপ্রিলে শেয়ার ক্রয় থেকে বিক্রি বেশি করেন ২৫ কোটি, মে-তে ২৮২ কোটি, জুনে ২০৭ কোটি, জুলাইতে ৩৩ কোটি এবং আগস্টে ৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ গত বছর টানা পাঁচ মাসে বিদেশিরা শেয়ার ক্রয় থেকে বিক্রি বেশি করেন ৫৫৩ কোটি টাকা।
তবে টাকার অঙ্কে বিদেশিদের শেয়ার বিক্রির চাপ সব থেকে বেশি ছিল ২০১০ সালে। ওই বছরের অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বর টানা তিন মাস বিক্রি বেশি ছিল বিদেশিদের। এর মধ্যে অক্টোবরে ৬৩ কোটি টাকা, নভেম্বরে ১৫৭ কোটি টাকা এবং ডিসেম্বরে ৪৯৫ কোটি টাকা শেয়ার ক্রয় থেকে বিক্রি বেশি ছিল বিদেশিদের। অর্থাৎ টানা তিন মাসে বিদেশিরা ৭১৫ কোটি টাকা ক্রয় থেকে বিক্রি বেশি করে।
বিদেশিরা ২০১০ সালের যে সময় শেয়ার বিক্রির চাপ বাড়ায়, সে সময়েই দেশের শেয়ারবাজারে এক কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সৃষ্টি হয়। সে সময়ের মহাধসে নিঃস্ব হয় অসংখ্য ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী। ধকল সামলাতে না পেরে ধুঁকতে থাকে শেয়ারবাজার। দীর্ঘ প্রায় ৯ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও সেই ধকল পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি শেয়ারবাজার।
এ পরিস্থিতিতেই চলতি বছরে এসে আবারও শেয়ার বিক্রির চাপ বাড়িয়েছে বিদেশিরা। আর বিদেশিদের এমন শেয়ার বিক্রির প্রভাবে গত ছয় মাসে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান মূল্য সূচক ডিএসইএক্স কমেছে ৭০০ পয়েন্টের ওপরে। আর বাজার মূলধন কমেছে ৩৮ হাজার কোটি টাকার বেশি।
শেয়ারবাজারে বিদেশিদের শেয়ার বিক্রির প্রভাবের বিষয়ে ডিএসইর পরিচালক রকিবুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, শেয়ারবাজারে বিদেশিদের লেনদেনের পরিমাণ বেশি না। কিন্তু বিদেশিরা যখন শেয়ার বিক্রি করেন একসঙ্গে করেন। আমাদের বাজারের যে সক্ষমতা তা বিদেশিদের ওই বিক্রির চাপ সামাল দেয়ার মতো না। ফলে বিদেশিরা শেয়ার বিক্রি করলে এক ধরনের আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। যার ফলে সার্বিক বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
এদিকে গত ছয় মাস বিদেশিরা অব্যাহতভাবে শেয়ার বিক্রি করলেও চলতি বছরের প্রথম দুই মাসের চিত্র ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি পর পর দুই মাস শেয়ার বিক্রির থেকে ক্রয়ে বেশি মনোযোগী ছিলেন বিদেশিরা। এর মধ্যে জানুয়ারিতে বিদেশিদের শেয়ার বিক্রির থেকে ক্রয় বেশি হয় ১৭৫ কোটি টাকা। আর ফেব্রুয়ারিতে শেয়ার বিক্রির থেকে ক্রয় বেশি ছিল ৩২৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ চলতি বছরের দুই মাসে বিদেশিরা যে টাকার শেয়ার বিক্রি করেন ক্রয় করেন তার থেকে ৪৯৮ কোটি টাকা বেশি।
বিদেশিদের এমন টানা শেয়ার ক্রয়ের কারণে ওই দুই মাসে শেয়ারবাজারে বড় ধরনের উত্থান ঘটে। ডিএসইর প্রধান মূল্য সূচক ডিএসইএক্স বাড়ে ৩২৬ পয়েন্ট। আর বাজার মূলধন বাড়ে ২৭ হাজার ৭৭৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ মাত্র দুই মাসে ডিএসইতে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ার ও ইউনিটের সম্মিলিত দাম বাড়ে প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা।
বিদেশি বিনিয়োগকারীদের পোর্টফোলিও নিয়ে কাজ করে এমন একটি ব্রোকারেজ হাউজের শীর্ষ এক কর্মকর্তা বলেন, বিএসইসি থেকে বিদেশিদের শেয়ার বিক্রির প্রবণতা কমানোর জন্য আমাদের ওপর চাপ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু আমরা কীভাবে বিদেশিদের শেয়ার বিক্রি আটকাব। আমরা তো কাউকে বলতে পারি না শেয়ার বিক্রি করবে না।
ওই কর্মকর্তা বলেন, এখন বিদেশিরা শেয়ার বিক্রি করলেও বছরের শুরুতে অনেক শেয়ার কিনেছেন। তখন তো তাদের শেয়ার না কেনার জন্য কেউ বলেনি। বিনিয়োগকারী কখন শেয়ার কিনবে, আবার কখন শেয়ার বিক্রি করবে তা একান্তই তার বিষয়। এ ক্ষেত্রে ব্রোকারেজ হাউজের কিছু করার নেই। আর শেয়ার বাজারের এখন বড় সমস্যা বিদেশিদের শেয়ার বিক্রি হয়, গ্রামীণফোনসহ কয়েকটি ইস্যু এর জন্য দায়ী। এসব সমস্যার সমাধানের উদ্যোগ না নিয়ে আমাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে। আমরা যদি এখন বিদেশিদের শেয়ার বিক্রি করতে না দেই, তা বাজারের ওপর আরও খারাপ প্রভাব ফেলবে।
এমএএস/বিএ/এমকেএইচ