ন্যায্যমূল্য ফিরে আসলেই কাঁচা চামড়া রফতানি নয়
এবার কোরবানির ঈদে কোরবানিদাতারা চামড়া নিয়ে বসে থাকলেও চামড়া কিনতে আসেনি কেউ। ফলে অনেকে দুপুরের আগেই একেবারে বিনামূল্যে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামসহ কয়েকটি সেবামূলক দাতব্য প্রতিষ্ঠানকে চামড়া দিয়ে দেয়।
দুপুরের পর ঢাকায় কিছু মৌসুমি ব্যবসায়ী চোখে পড়লেও তারা লাখ টাকা দামের গরুর চামড়া কেনেন মাত্র ১৫০-৩০০ টাকায়। খাসির চামড়া বিক্রি হয় ২০ থেকে ৩০ টাকায়। ফলে অনেকে ক্ষোভ জানিয়ে চামড়া ড্রেন-ডাস্টবিনে ফেলে দেন।
সরকার নির্ধারিত দাম কার্যকর না হওয়ায় কোরবানির চামড়া বাণিজ্যে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে এসেছে। তবে বড় অংকের বাণিজ্য রক্ষায় এবারই প্রথম কাঁচা চামড়া রফতানির অনুমতি দিয়েছে সরকার। দেশীয় শিল্প রক্ষায় কাঁচা চামড়া রফতানির সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে ট্যানারি মালিকরা। একই সঙ্গে, তারা তাদের অবস্থান থেকে সরে এসে আগামী শনিবার (১৭ আগস্ট) থেকে সরকারের নির্ধারিত দামে কাঁচা চামড়া কেনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তাই চামড়ার বাজারে যদি ন্যায্যমূল্য ফিরে আসে তাহলে কাঁচা চামড়া রফতানি থেকে সরে আসবে সরকার। তবে চামড়ার দাম না বাড়লে কাঁচা চামড়া রফতানির সিদ্ধান্ত বহাল থাকবে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব জানা গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মফিজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা কাঁচা চামড়া রফতানির সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করিনি। তবে আমরা এটাও জানি যে, ঢালাওভাবে কাঁচা চামড়া রফতানি করার অনুমোদন দিলে দেশে চামড়া শিল্প উন্নয়নে কিছু বাধাগ্রস্ত হবে। আমরা চাই না একটা সম্ভাবনাময় খাত বাধাগ্রস্ত হোক। তাই বলে আমরা এ-ও হতে দিতে পারি না যে, চামড়া বিক্রি হবে না। দাম না পেয়ে মানুষ চামড়া পুঁতে ফেলবে, নদীতে ফেলে দেবে। তাই আমরা ঢালাওভাবে না দিয়ে কেস টু কেস ভিত্তিতে কাঁচা চামড়া রফতানিতে অনুমোদনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
সচিব বলেন, ‘আগামী শনিবার (১৭ আগস্ট) থেকে নির্ধারিত মূল্যে কাঁচা চামড়া ক্রয় শুরু করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন। এর ফলে যদি চামড়ার বাজারে ন্যায্যমূল্য ফিরে আসে তাহলে হয়তো আমরা কাঁচা চামড়া রফতানি অনুমোদন দেব না। তবে বিক্রেতারা যদি চামড়ার ন্যায্যমূল্য না পায়, তাহলে কাঁচা চামড়া রফতানির অনুমোদন দেব। কারণ এটা এতিম, গরিব, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর হক। এক্ষেত্রে আমরা পানির দরে চামড়া বিক্রি হতে দিতে পারি না।’
ন্যায্যমূল্য না পেয়ে চামড়া পুঁতে ফেলা উচিত হয়নি বলে মন্তব্য করেন মো. মফিজুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন গণমাধ্যমে দেখছি পশুর দাম না পেয়ে অনেকেই চামড়া পুঁতে ফেলেছে কিংবা রাস্তায় ফেলে দিয়েছে। যারা এসব কাজ করেছে, তারা কাণ্ডজ্ঞানহীন কাজ করেছে। কেননা লবণ দিয়ে ৩ মাস পর্যন্ত চামড়া সংরক্ষণ করা যায়। যা আমরা গণমাধ্যমে প্রচার করেছি। তাদের উচিত ছিল চামড়াগুলো নষ্ট না করে লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করা।’
এদিকে চামড়ার দাম কমে যাওয়ার পেছনে ব্যবসায়ীদের কারসাজি আছে বলে মন্তব্য করেছেন খোদ বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। গতকাল বুধবার (১৪ আগস্ট) রংপুরের শালবন এলাকায় নিজ বাসভবনে সাংবাদিকদের কাছে এই মন্তব্য করেন তিনি। গত কয়েক বছরের মধ্যে এবার কোরবানি হওয়া পশুর চামড়ার দাম অনেক কম। চামড়ার দামে ধস নেমেছে। এ নিয়ে দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে। চামড়া ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকেই বলছেন, এবার চামড়ার দাম স্মরণকালের মধ্যে সর্বনিম্ন। দাম না পেয়ে অনেকেই চামড়া ফেলে দিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, ‘চামড়া নিয়ে যখনই ভালো উদ্যোগ গ্রহণ করি তখনই তার বিরুদ্ধাচরণ করা হচ্ছে। ঈদের আগে ট্যানারি মালিক ও চামড়া ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করে চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু দুঃখজনক হলো, তার কোণো প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। চামড়ার দাম একেবারেই কমে গেছে। এটা গ্রহণযোগ্য নয়। এ কারণেই সরকার কাঁচা চামড়া রফতানির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। তিনি বলেন, কোনোভাবেই চামড়া শিল্পকে ধ্বংস করতে দেয়া যাবে না।
এবার কোরবানির কাঁচা চামড়ার এই খারাপ পরিস্থিতির জন্য ট্যানারি মালিক, পাইকার ও আড়তদাররা একে অপরকে দোষারোপ করছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে গত মঙ্গলবার (১৩ আগস্ট) ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে কাঁচা চামড়া রফতানির অনুমতি নেয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক নির্ধারিত মূল্যে কাঁচা চামড়া ক্রয়-বিক্রয় নিশ্চিত করতে ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা কামনা করা হয়।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানায়, বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য মতে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, নির্ধারিত মূল্যে কোরবানির পশুর চামড়া ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে না। এ বিষয়ে চামড়া শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের দায়িত্বশীল হবার আহ্বান জানায় মন্ত্রণালয়।
কাঁচা চামড়ার গুণাগুণ যাতে নষ্ট না হয়, সেজন্য স্থানীয়ভাবে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে চামড়া সংরক্ষণের জন্য ব্যবসায়ী ও স্থানীয় প্রশাসনের প্রতি অনুরোধ জানানো হয়। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদানের জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক এবং উপজেলা নির্বাহী অফিসারসহ সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগিতা কামনা করে মন্ত্রণালয়।
কাঁচা চামড়া রফতানির ঘোষণায় ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে চামড়ায় লবণ দিয়ে তা সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে পাইকারি ব্যবসায়ীরা। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতসহ বিশ্বের অনেক দেশে কাঁচা চামড়ার দাম বেশি। এ কারণে কাঁচা চামড়া রফতানির অনুমতিকে সাধুবাদ জানিয়েছে পাইকার ও আড়তদাররা।
এ পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল বুধবার (১৪ আগস্ট) ধানমন্ডিতে জরুরি সংবাদ সম্মেলনে দেশীয় শিল্প রক্ষায় কাঁচা চামড়া রফতানির সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানান ট্যানারি মালিকরা।
সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সভাপতি শাহীন আহমেদ বলেন, ‘আমরা জেনেছি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কাঁচা চামড়া রফতানির সুযোগ দিতে যাচ্ছে। এতে শতভাগ দেশীয় এ শিল্প হুমকির মুখে পড়বে। সাভারের আধুনিক চামড়া শিল্পনগরী প্রয়োজনীয় কাঁচা চামড়ার অভাবে সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে পড়বে। ফলে চামড়া শিল্পনগরীতে ৭ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ ঝুঁকিতে পড়বে। ট্যানারি শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত হাজার হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে যাবে। এতে শ্রমিক অসন্তোষ সৃষ্টি হতে পারে।’
সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাঁচা চামড়া রফতানির সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানান ট্যানারি মালিকদের এ নেতা।
বিটিএর সভাপতি বলেন, ‘কোরবানির সময় মাঠ পর্যায় থেকে কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করে আড়তদার ও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। তাদের কাছ থেকে লবণযুক্ত চামড়া আমরা কিনে থাকি। এবার আগামী ২০ আগস্ট থেকে আমরা লবণযুক্ত কাঁচা চামড়া সরকার নির্ধারিত মূলে সংগ্রহ শুরু করব।’
এরপর গতকালই বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে বৈঠকে বসে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে ২০ আগস্টের আগেই অবিলম্বে নির্ধারিত মূল্যে কাঁচা চামড়া ক্রয় শুরু করবে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন।
এদিকে পবিত্র ঈদুল আজহার আগে গত ৬ আগস্ট সরকার ও ব্যবসায়ীরা মিলে কোরবানির পশুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দেয়। তারা জানায়, এবার ঢাকায় প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম ৪৫-৫০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৩৫-৪০ টাকা হবে। গত বছর প্রতি বর্গফুটের দাম একই ছিল।
২০১৭ সালে প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম ছিল ঢাকায় ৪৫-৫৫ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৪০-৪৫ টাকা।
এ ছাড়া সারাদেশে খাসির চামড়া প্রতি বর্গফুট ১৮-২০ টাকা এবং বকরির চামড়া ১৩-১৫ টাকায় সংগ্রহ করতে বলা হয় ব্যবসায়ীদের। গতবার খাসির চামড়ার দামও ছিল একই। তবে ২০১৭ সালে খাসির চামড়া ছিল প্রতি বর্গফুট ২০-২২ টাকা এবং বকরির চামড়ার দাম ছিল ১৫-১৭ টাকা। তবে বাস্তবে এ দাম নির্ধারণ কোনো কাজেই আসেনি।
উল্লেখ্য, ঢাকায় পাঁচ বছরে কোরবানির গরুর চামড়ার দাম (প্রতি বর্গফুট) ২০১৪ সালে ৭৫ থেকে ৮০ টাকা, ২০১৫-তে ৫০ টাকা, ২০১৬-তে ৫০-৫৫ টাকা, ২০১৭-তে ৫০-৫৫ টাকা, ২০১৮-তে ৪৫-৫০ টাকা নির্ধারণ করে দেয়া হয়।
ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে বছরে মোটামুটি ২২ কোটি বর্গফুট চামড়া পাওয়া যায়। এর মধ্যে ৬৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ গরুর, ৩১ দশমিক ৮২ শতাংশ ছাগলের, ২ দশমিক ২৫ শতাংশ মহিষের এবং ১ দশমিক ২ শতাংশ ভেড়ার চামড়া। মোট চামড়ার অর্ধেকের বেশি আসে কোরবানির ঈদের সময়।
এমইউএইচ/এসআর/পিআর