প্রবাসী বীমা : অংশীদারিত্বে প্রিমিয়াম প্রদানের প্রস্তাব
দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে রেমিট্যান্স যোদ্ধা প্রবাসীদের জীবন বীমা সুবিধার আওতায় আনার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। চলতি বছরের বাজেটে এমন ঘোষণা দেয়া হয়। অবশ্য প্রবাসীদের জীবন বীমা সুবিধার আওতায় আনতে গত বছর থেকে নীতিমালা চূড়ান্ত করতে কাজ করছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। তবে এটি এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত করা সম্ভব হয়নি।
এর আগে প্রবাসীদের জীবন বীমা সুবিধার আওতায় আনতে একটি খসড়া নীতিমালা প্রস্তুত করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। এ নীতিমালার আওতায় বিদেশগামী কর্মীদের প্রয়োজনীয়তা ও আর্থিক সামর্থ্য বিবেচনায় নিয়ে দুই বছরে পাঁচ লাখ ও দুই লাখ টাকা বীমা অঙ্কের দুটি পরিকল্পনা বা পলিসি ডিজাইন করা হয়। এক্ষেত্রে পাঁচ লাখ টাকার বীমার জন্য প্রবাসীদের প্রিমিয়াম দিতে হবে দুই হাজার ৯২৫ টাকা এবং দুই লাখ টাকার বীমার জন্য প্রিমিয়াম দিতে হবে এক হাজার টাকা।
আরও পড়ুন > বীমার আওতায় যেসব সুবিধা পাবেন প্রবাসীরা
এটি চূড়ান্ত করতে সম্প্রতি প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ইমরান আহমদের সভাপতিত্বে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় প্রবাসীকর্মীদের আর্থিক সক্ষমতা বিবেচনা করে প্রিমিয়ামের টাকা অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে কর্মী, ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড এবং সরকারের ভর্তুকির মাধ্যমে পরিশোধের প্রস্তাব করা হয়। এ প্রস্তাব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখছে অর্থ মন্ত্রণালয়। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদ বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সদয় নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রবাসীকর্মীদের বীমার আওতায় আনার লক্ষ্যে সরকার বদ্ধপরিকর। এ দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন এবং অভূতপূর্ব উন্নয়নে আমাদের প্রবাসীকর্মীদের পরিশ্রমলব্ধ রেমিট্যান্সের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই কর্মীবান্ধব অর্থাৎ কর্মীর ওপর যেন অতিরিক্ত আর্থিক চাপ না পড়ে সেজন্য বিদেশগামীকর্মীদের বাধ্যতামূলক বীমার আওতায় আনার লক্ষ্যে পরিকল্পনা চলছে। এছাড়া সবচেয়ে কম প্রিমিয়ামে কর্মীরা কীভাবে সবচেয়ে বেশি সুবিধা পেতে পারেন, সেদিকে লক্ষ্য রেখে বীমার প্রিমিয়াম নির্ধারণ এবং বীমার অর্থপ্রাপ্তি সহজ করার বিষয়টি নিশ্চিত করা হবে।
আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় ইমরান আহমদ বলেন, প্রবাসীকর্মীদের মানসম্মত সেবা প্রদান এবং বীমার দাবি আদায় নিশ্চিতের জন্য বীমা ব্যবস্থাপনাকে গতিশীল, আধুনিক ও জবাবদিহিতামূলক করতে হবে। সেক্ষেত্রে প্রস্তাবিত বীমা ব্যবস্থাকে প্রতিযোগিতামূলক করার লক্ষ্যে জীবন বীমা কর্পোরেশনের পাশাপাশি বেসরকারি বীমা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বীমা ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব প্রদানের সম্ভাব্যতা যাচাই করা যেতে পারে।
মনে রাখতে হবে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) সব বীমা কোম্পানির জন্য সমানভাবে ব্যবস্থা নেবে এবং জীবন বীমা কর্পোরেশনকে প্রতিযোগিতামূলক একটি কোম্পানি হিসেবে বিবেচনা করা হবে বলে- মন্তব্য করেন তিনি।
আরও পড়ুন > ঘোষণা মঞ্চের ব্যয় ৪০ হাজার, ছাতার ৮০ হাজার!
বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের সদস্য গোকুল চাঁদ দাস প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য বীমা নীতিমালা প্রণয়নের প্রেক্ষাপট এ সময় উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে বীমা আইন অনুযায়ী আইডিআরএ কর্তৃক ‘প্রবাসীকর্মী বীমা নীতিমালা’র খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে। জীবন বীমা কর্পোরেশনের একচ্যুয়ারি (বিমা-গাণনিক) কর্তৃক প্রিমিয়ামের অঙ্ক নির্ধারণপূর্বক একটি বীমা প্রকল্প প্রস্তুত করা হয়েছে। যেখানে বিদেশগামী কর্মীদের বীমার মেয়াদকালীন সময় মৃত্যু ও স্থায়ী অক্ষমতাজনিত কারণে শতভাগ বীমা সুবিধাসহ বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন মাত্রায় সুবিধার বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে।
সভায় জীবন বীমা কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান শেলীনা আফরোজা বলেন, এ নীতিমালার আলোকে মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে একটি সভা করে এবং আইডিআরএ’র পরামর্শক্রমে জীবন বীমা কর্পোরেশন প্রবাসীকর্মীদের জন্য বীমা প্রকল্প প্রস্তুত করেছে। বীমা আইনের আলোকে একজন অভিজ্ঞ একচ্যুয়ারি তা প্রণয়ন করেছেন।
তিনি আরও বলেন, সরকারি-বেসরকারি সব বীমা প্রতিষ্ঠানের জন্য একই সুবিধা উন্মুক্ত করে একটি বীমা প্রকল্প গ্রহণ করা সময়সাপেক্ষ বিষয়। কারণ সেটা পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস অনুযায়ী করতে হবে। অন্যদিকে জীবন বীমা কর্পোরেশন একটি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বিধায় সরাসরি জীবন বীমা কর্পোরেশনের সঙ্গে এটি করতে পারে সরকার।
এ পরিপ্রেক্ষিতে তিনি মতামত ব্যক্ত করেন যে, প্রাথমিকভাবে দুই বছরের জন্য প্রবাসীকর্মীদের বীমা ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব জীবন বীমা কর্পোরেশনের ওপর দেয়া যেতে পারে। ওই সময়ের পর জীবন বীমা কর্পোরেশনের পারফরমেন্স যাচাই করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকেও দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো’র মহাপরিচালক মো. সেলিম রেজা এ প্রসঙ্গে বলেন, এ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে যেসব বাংলাদেশি কর্মসংস্থানের জন্য বিদেশ গমন করেন তাদের অধিকাংশই অসচ্ছল। তাই তাদের জন্য জীবন বীমা বাধ্যতামূলক করার লক্ষ্যে এমনভাবে প্রিমিয়াম হার নির্ধারণ করা প্রয়োজন যাতে তারা আর্থিক চাপের সম্মুখীন না হন এবং বীমার দাবি আদায়ে কোনোরূপ ভোগান্তির শিকার না হন।
অর্থ বিভাগের যুগ্ম সচিব ড. মো. নজরুল ইসলাম বলেন, চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি প্রদানের বিষয়ে উচ্চপর্যায়ে আলোচনা-সাপেক্ষে প্রিমিয়ামের হার স্থির করা যেতে পারে।
ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের পরিচালক নূর আক্তার বলেন, গত ৩০ এপ্রিল ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের মহাপরিচালকের সভাপতিত্বে বিভিন্ন ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বীমা ব্যবস্থাপনার পূর্ণাঙ্গ অটমেশনের মাধ্যমে ব্যবস্থাপনা ব্যয় কমিয়ে আনা সম্ভব এবং এর মাধ্যমে প্রিমিয়ামের টাকার পরিমাণ কমে যেতে পারে বলে অভিমত ব্যক্ত করা হয়।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সাদিয়া পারভীন বলেন, দেশের অসচ্ছল কর্মীদের জন্য মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রস্তাবিত প্রকল্পের প্রিমিয়ামের হার পর্যালোচনা করা যেতে পারে।
বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের সদস্য গকুল দাস কার্যপত্রে উপস্থাপিত মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যানের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে সভায় বলেন, ২০১৮ সালে মোট সাত লাখ ৩৪ হাজার ১৮১ কর্মী প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে বিদেশ গেছেন। এর মধ্যে বিদেশে মৃত্যুবরণকারীর সংখ্যা মোট তিন হাজার ৭৯৩ জন। এর মধ্যে ৭০০ কর্মী বিদেশ গমনের দুই বছরের মধ্যে মৃত্যুবরণ করেন। এ পরিসংখ্যানের ওপর ভিত্তি করে এবং প্রবাসীকর্মীদের আর্থিক সামর্থ্য বিবেচনায় এনে প্রস্তাবিত বীমা প্রকল্পের প্রিমিয়ামের অর্থ পর্যালোচনা করার জন্য তিনি জীবন বীমা কর্পোরেশনকে অনুরোধ জানান।
এমইউএইচ/এমএআর/জেআইএম