সেই কোম্পানিতে ধরা বিনিয়োগকারীরা
সোনার বাংলা ইন্স্যুরেন্স, ইউনাইটেড ইন্স্যুরেন্স, স্ট্যান্ডার্ড ইন্স্যুরেন্স, রূপালী লাইফ, অগ্রণী ইন্স্যুরেন্স, প্রভাতী ইন্স্যুরেন্সসহ দুই ডজনের বেশি বীমা কোম্পানি হঠাৎ-ই পুঁজিবাজারে রূপকথার ‘আলাউদ্দিনের চেরাগ’র ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। অল্প সময়ের মধ্যে একাধিক কোম্পানির শেয়ারের দাম বেড়ে তিনগুণ ছাড়িয়ে যায়।
কোম্পানিগুলোর শেয়ারের এমন অস্বাভাবিক দাম বাড়ার পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) থেকে দফায় দফায় বিনিয়োগকারীদের সতর্ক করে তথ্য প্রকাশ করা হয়। এরপরও এক শ্রেণির বিনিয়োগকারী ‘অস্বাভাবিক’ দামের কোম্পানিগুলোর শেয়ার কেনা থেকে বিরত থাকেননি।
রাতারাতি মুনাফার আশায় যেসব বিনিয়োগকারী অতিরিক্ত মূল্যে ওইসব কোম্পানির শেয়ার কিনেছেন তাদের অধিকাংশই ধরা খেয়েছেন। কারণ অস্বাভাবিক দাম বাড়ার পর এখন কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দাম টানা কমেছে। কিছু কিছু কোম্পানির শেয়ারের দাম কমে অর্ধেকেও নেমে এসেছে।
সম্প্রতি বীমা খাতের যে কয়টি কোম্পানির শেয়ারের দাম অস্বাভাবিক উত্থান-পতন হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত সোনার বাংলা ইন্স্যুরেন্স। কোম্পানিটির চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন বীমা মালিকদের সমিতি বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইএ) প্রেসিডেন্ট শেখ কবির হোসেন। যিনি শেয়ার সংরক্ষণের দায়িত্বপালনকারী প্রতিষ্ঠান সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিডিবিএল)- এর চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পালন করছেন।
পুঁজিবাজারে ‘আলাউদ্দিনের চেরাগ’র ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া সোনার বাংলা ইন্স্যুরেন্স’র শেয়ারের দাম গত বছরের ২৬ নভেম্বর ছিল ১৪ টাকা। যা অনেকটা টানা বেড়ে চলতি বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি ৬৭ টাকা ৩০ পয়সায় পৌঁছে যায়। অর্থাৎ মাত্র দুই মাসে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম বাড়ে প্রায় পাঁচগুণ। কোম্পানিটির শেয়ারের এমন দাম বাড়ার পেছনে একটি কারসাজি চক্রের হাত রয়েছে বলে বাজারে গুঞ্জন রয়েছে।
বীমা খাতের ওই কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করে একটি পক্ষ কয়েকগুণ মুনাফা করে নিলেও, বিনিয়োগকারীদের একটি পক্ষ ধরা খেয়েছেন। কারণ তিন মাস ধরে অনেকটা টানা দরপতনের কারণে ৩০ জুন লেনদেন শেষে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম দাঁড়িয়েছে ৩৭ টাকা ২০ পয়সায়। এ হিসাবে যারা ৬০ টাকার ওপরে কোম্পানিটির শেয়ার কিনেছিলেন তাদের বিনিয়োগ করা অর্থ এখন কমে প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে।
সোনার বাংলার মতো শেয়ারের দামে অস্বাভাবিক উত্থান-পতন হওয়া আরও এক কোম্পানি ইউনাইটেড ইন্স্যুরেন্স। আড়াই মাসের মধ্যে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম বেড়ে প্রায় চারগুণ হয়। যা এখন কমে প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। গত বছরের ১৮ ডিসেম্বর কোম্পানিটির শেয়ারের দাম ছিল ২২ টাকা ৮০ পয়সা, যা টানা বেড়ে চলতি বছরের ৩ মার্চ দাঁড়ায় ৮৩ টাকা ৭০ পয়সা। কোম্পানিটির শেয়ারের এ অস্বাভাবিক দাম খুব বেশিদিন স্থিতিশীল ছিল না। ৩০ জুন লেনদেন শেষে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম কমে ৫৫ টাকা ২০ পয়সায় দাঁড়ায়। অর্থাৎ যারা ৮০ টাকার ওপরে কোম্পানিটির শেয়ার কিনেছিলেন তাদের বিনিয়োগের পরিমাণ এখন কমে প্রায় অর্ধেকে ঠেকেছে।
মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে শেয়ারের দাম বেড়ে তিনগুণ হওয়া প্রভাতী ইন্স্যুরেন্সের শেয়ারের দামও এখন কমে প্রায় অর্ধেকে দাঁড়িয়েছে। গত বছরের ১১ ডিসেম্বর কোম্পানিটির শেয়ারের দাম ছিল ১৫ টাকা ৯০ পয়সা। সেখান থেকে চলতি বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি কোম্পানিটির শেয়ারের দাম বেড়ে হয় ৪৩ টাকা ৩০ পয়সা। এরপরই কমতে থাকে শেয়ারের দাম। ৩০ জুন লেনদেন শেষে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম দাঁড়িয়েছে ২৬ টাকা ৫০ পয়সা।
শুধু সোনার বাংলা, ইউনাইটেড ও প্রভাতী ইন্স্যুরেন্স নয়, গত সাত মাসে বীমা খাতের অন্তত ২৫টি কোম্পানির শেয়ারের দামে অস্বাভাবিক উত্থান-পতন দেখা গেছে। এসব কোম্পানির শেয়ারের দাম অল্প সময়ের মধ্যে যেমন অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে, তেমনি দাম কমে আবার প্রায় আগের স্থানে ফিরে গেছে।
এর মধ্যে রয়েছে- ফারইষ্ট ইসলামী লাইফ, মেঘনা লাইফ, পদ্মা ইসলামী লাইফ, প্রাইম ইসলামী লাইফ, রূপালী লাইফ, সন্ধানী লাইফ, পূরবী জেনারেল, প্রাইম, ফিনিক্স, জনতা, মার্কেন্টাইল, অগ্রণী, এশিয়া, এশিয়া প্যাসিফিক, বাংলাদেশ ন্যাশনাল, রূপালী, কন্টিনেন্টাল, ইষ্টল্যান্ড, কর্ণফুলি, স্ট্যান্ডার্ড, তাকাফুল ও ইসলামী ইন্স্যুরেন্স।
কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দামের উত্থান-পতনের চিত্র-
কোম্পানির নাম |
শেয়ারের দামের চিত্র |
||
অস্বাভাবিক উত্থানের আগে দাম |
সর্বোচ্চ দাম |
৩০ জুনের দাম |
|
প্রভাতী ইন্স্যুরেন্স |
১৫ টাকা ৯০ পয়সা |
৪৩ টাকা ২০ পয়সা |
২৬ টাকা ৫০ পয়সা |
স্ট্যান্ডার্ড ইন্স্যুরেন্স |
২১ টাকা |
৪৩ টাকা ৬০ পয়সা |
২৮ টাকা ২০ পয়সা |
রূপালী লাইফ |
৪০ টাকা ৮০ পয়সা |
১১০ টাকা |
৬০ টাকা ৯০ পয়সা |
অগ্রণী ইন্স্যুরেন্স |
১৬ টাকা |
৪২ টাকা ৭০ পয়সা |
২৫ টাকা |
প্রাইম ইন্স্যুরেন্স |
১২ টাকা ৫০ পয়সা |
২৫ টাকা ৪০ পয়সা |
২০ টাকা ২০ পয়সা |
পূরবী জেনারেল ইন্স্যুরেন্স |
১২ টাকা |
২২ টাকা ১০ পয়সা |
১৫ টাকা ৬০ পয়সা |
ইসলামী ইন্স্যুরেন্স |
২০ টাকা ৫০ পয়সা |
২৮ টাকা ৬০ পয়সা |
২১ টাকা ৯০ পয়সা |
ফিনিক্স ইন্স্যুরেন্স |
২৩ টাকা ২০ পয়সা |
৪২ টাকা ৩০ পয়সা |
২৭ টাকা ৯০ পয়সা |
জনতা ইন্স্যুরেন্স |
১২ টাকা ৭০ পয়সা |
২৩ টাকা ৮০ পয়সা |
১৬ টাকা ৭০ পয়সা |
মার্কেন্টাইল ইন্স্যুরেন্স |
২৩ টাকা ২০ পয়সা |
৩৫ টাকা ৭০ পয়সা |
২৬ টাকা ৮০ পয়সা |
এশিয়া ইন্স্যুরেন্স |
১৬ টাকা ৭০ পয়সা |
৩৮ টাকা ৭০ পয়সা |
২৪ টাকা ৪০ পয়সা |
এশিয়া প্যাসেফিক ইন্স্যুরেন্স |
১৮ টাকা ৮০ পয়সা |
৩২ টাকা ৮০ পয়সা |
২৫ টাকা ৮০ পয়সা |
বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স |
১৫ টাকা ৪০ পয়সা |
৩০ টাকা ২০ পয়সা |
২০ টাকা ২০ পয়সা |
কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্স |
১৬ টাকা ৬০ পয়সা |
৩০ টাকা ৯০ পয়সা |
২১ টাকা ৯০ পয়সা |
ইষ্টল্যান্ড ইন্স্যুরেন্স |
১৮ টাকা ১০ পয়সা |
৩৪ টাকা ৮০ পয়সা |
২৫ টাকা ৭০ পয়সা |
ফারইষ্ট ইসলামী লাইফ |
৫৭ টাকা ২০ পয়সা |
৭৪ টাকা |
৬০ টাকা ৯০ পয়সা |
কর্ণফুলি ইন্স্যুরেন্স |
১৪ টাকা ৪০ পয়সা |
২৬ টাকা ৪০ পয়সা |
১৮ টাকা ৩০ পয়সা |
মেঘনা লাইফ |
৫০ টাকা ৬০ পয়সা |
৯৩ টাকা |
৬০ টাকা ১০ পয়সা |
পদ্মা ইসলামী লাইফ |
২২ টাকা ১০ পয়সা |
৩০ টাকা |
২৩ টাকা ৯০ পয়সা |
প্রাইম ইসলামী লাইফ |
৪৩ টাকা ৮০ পয়সা |
৭৩ টাকা ৪০ পয়সা |
৫৫ টাকা ২০ পয়সা |
রূপালী ইন্স্যুরেন্স |
১৬ টাকা ৮০ পয়সা |
২৮ টাকা ৪০ পয়সা |
১৯ টাকা ৮০ পয়সা |
সন্ধানী লাইফ |
২৩ টাকা ৪০ পয়সা |
৩৫ টাকা ৩০ পয়সা |
২৬ টাকা ৩০ পয়সা |
তাকাফুল ইন্স্যুরেন্স |
২৬ টাকা ১০ পয়সা |
৪০ টাকা |
২৬ টাকা ১০ পয়সা |
পুঁজিবাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, চলতি বছরের শুরুর দিকে বীমা খাতের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম যেভাবে বেড়েছে তা অনেকটাই অস্বাভাবিক ছিল। কিছু কিছু কোম্পানির শেয়ারের দাম এমন হারে বেড়েছে যা কল্পনাও করা যায় না। এমন অস্বাভাবিক দাম বাড়ার কারণে এখন কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দাম কমছে। এ দাম কমার কারণে যদি কোনো বিনিয়োগকারী লোকসানের মুখে পড়েন তাহলে তার দায় অবশ্যই ওই বিনিয়োগকারীকে নিতে হবে। অতিরিক্ত মুনাফার আশায় যদি কেউ নিজের অর্থ ঝুঁকি মধ্যে ফেলেন তার দায় অন্য কেউ নিতে পারেন না।
এ বিষয়ে ডিএসই’র এক সদস্য নাম প্রকাশ না করে বলেন, একটি কোম্পানির শেয়ারের দাম অতীতে কখনোই ২২ টাকার ওপরে যায়নি। সেই কোম্পানির শেয়ারের দাম হু হু করে বেড়ে ৬০ টাকা ছাড়িয়ে গেল। এটা কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারে না। এমন অস্বাভাবিক দাম বাড়ার কারণে এখন শেয়ারের দামে পতন হচ্ছে। এজন্য বিনিয়োগকারীদের যেমন দায় আছে, তেমনি শেয়ারের এমন দাম বাড়ানোর পেছনে যারা জড়িত- নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত তাদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, অতিরিক্ত মুনাফার আশায় গুজবে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করা ঠিক নয়। বিনিয়োগের আগে অবশ্যই সার্বিক তথ্য পর্যালোচনা করতে হবে। অতিরিক্ত মুনাফার আশায় যদি কোনো বিনিয়োগকারী নিজের অর্থ ঝুঁকির মধ্যে ফেলেন, তাহলে তার দায় তাকেই নিতে হবে। এমন কোম্পানিতে বিনিয়োগকারীরা কেন বিনিয়োগ করবেন?
তিনি বলেন, যদি কোনো কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে কারসাজির অভিযোগ ওঠে তবে নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত তা তদন্ত করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া। তবে একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, বিনিয়োগকারী কিন্তু তার দায় এড়াতে পারেন না। নিজের পুঁজি সুরক্ষার দায়িত্ব বিনিয়োগকারীকেই নিতে হবে।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. বখতিয়ার হাসান বলন, যদি কোনো কোম্পানির শেয়ারের দাম কারসাজির মাধ্যমে বাড়ানোর অভিযোগ ওঠে তাহলে তা খতিয়ে দেখে বিএসইসির কঠোর পদক্ষেপ নেয়া উচিত। তবে বিনিয়োগকারীরা তাদের দায় এড়াতে পারেন না। স্বাভাবিকভাবে একটি কোম্পানির শেয়ারের দাম কত টাকা হতে পারে, তার মূল্যায়ন বিনিয়োগকারীকে করতে হবে। এটা তাকে শিখতে হবে। গুজবে কান দিয়ে বিনিয়োগ করে লোকসানে পড়লে তার দায় অন্য কেউ নেবে না।
ডিএসই’র পরিচালক মো. রকিবুর রহমান বলেন, কোনো কোম্পানির শেয়ারের দাম যদি গ্রোথের কারণে বাড়ে তাহলে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু যে কোম্পানির গ্রোথ নেই সেই কোম্পানির শেয়ারের দাম হঠাৎ বাড়া কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারে না। একটি কোম্পানির শেয়ারের দাম ২০ টাকা থেকে ৬০ টাকা হয়ে যাবে, আবার আগের জায়গায় ফিরে আসবে- এটা কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়। এর পেছনে নিশ্চয়ই কেউ জড়িত।
তিনি বলেন, প্রকৃত বিনিয়োগকারীরা কিছুতেই এমন আচরণ করতে পারেন না। যারা কোম্পানির শেয়ার নিয়ে এমন খেলা করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিত। পাশাপাশি বিনিয়োগকারীদেরও দায় নিতে হবে। যেনতেন শেয়ারে বিনিয়োগ করে লোকসানে পড়লে তার দায় অন্য কেউ নেবে না।
ডিএসই’র অপর পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন বলেন, বাজেটে বীমা কোম্পানির জন্য বেশকিছু প্রণোদনা দেয়া হবে- এমন প্রত্যাশার কারণে বীমা খাতের কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দাম বাড়ে। তবে বাজেটে কিছু প্রণোদনা দেয়া হলেও তা প্রত্যাশা অনুযায়ী হয়নি, যে কারণে এখন কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দাম কমছে। এছাড়া কিছু বীমা কোম্পানির শেয়ারের দাম কারসাজি করেও বাড়ানো হয়েছে। ফলে এখন ওই কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দামও কমছে।
এমএএস/এমএআর/জেআইএম