বছর ঘুরেও শেষ হয় না ডিএসইর পর্যালোচনা!

সাঈদ শিপন
সাঈদ শিপন সাঈদ শিপন , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৮:৪৮ এএম, ২৯ জুন ২০১৯

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত সমতা লেদার পাঁচ বছরের অধিক সময় ধরে বিনিয়োগকারীদের কোনো লভ্যাংশ দেয় না। স্বাভাবিক নিয়মেই দীর্ঘদিন ধরে কোম্পানিটি বাজারের পচা কোম্পানি বা ‘জেড’ গ্রুপের তালিকায় রয়েছে। এরপরও এর শেয়ারের দাম আকাশচুম্বী। মূলত কারসাজি চক্রের মুনাফা হাতিয়ে নেয়ার কৌশলের কারণেই কোম্পানিটির শেয়ারের এমন দাম।

সমতা লেদার’র মতো দুর্বল কোম্পানির শেয়ারের আকাশচুম্বী দাম হওয়া এবং মাঝেমধ্যে সেই দাম বৃদ্ধির পালে নতুন করে হওয়া লাগার কারণে সার্বিক পুঁজিবাজার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ কারণে সমতা লেদার’র মতো দুর্বল কোম্পানি যেগুলো পাঁচ বছর বা তার বেশি সময় ধরে বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দেয় না- এমন ১৬টি কোম্পানির আর্থিক অবস্থা পর্যালোচনা করার সিদ্ধান্ত নেয় দেশের প্রধান পুঁজিবাজার- ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) কর্তৃপক্ষ।

কোম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে- মেঘনা পেট ইন্ডাস্ট্রিজ, বিচ হ্যাচারি, ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক, দুলামিয়া কটন, সমতা লেদার, শ্যামপুর সুগার মিলস, জিল বাংলা সুগার মিলস, ইমাম বাটন, মেঘনা কনডেন্সড মিল্ক, সাভার রিফ্র্যাক্টরিজ, বেক্সিমকো সিনথেটিক্স, জুট স্পিনার্স, শাহীনপুকুর সিরামিক, সোনারগাঁও টেক্সটাইল ও ইনফরমেশন সার্ভিস নেটওয়ার্ক।

গত বছরের আগস্টে এ সিদ্ধান্ত নেয়ার মূল উদ্দেশ্য ছিল দুর্বল কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজার থেকে তালিকাচ্যুত করা। তবে প্রায় বছর পেরিয়ে গেলেও ডিএসই’র সেই উদ্যোগের বাস্তব কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি। ১৬টি কোম্পানির মধ্যে মাত্র তিনটির পারফরমেন্স পর্যালোচনা করতে পেয়েছে ডিএসই। বাকি ১৩টির পারফরমেন্স পর্যালোচনা করা হচ্ছে বলে প্রতিদিন ডিএসই’র ওয়েবসাইটের মাধ্যমে তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে।

পারফরমেন্স পর্যালোচনা সম্পন্ন করা তিনটি কোম্পানি মেঘনা পেট ইন্ডাস্ট্রিজ, বিচ হ্যাচারি ও ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ’র বাণিজ্যিক কার্যক্রম ও উৎপাদন তিন বছরের বেশি সময় ধরে বন্ধ রয়েছে বলে ডিএসই তথ্য পেয়েছে। বাকি ১৩টি কোম্পানিরও একই অবস্থা বলে ডিএসই’র একটি সূত্রে জানা গেছে। এরপরও অদৃশ্য কারণে কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়া থেকে বিরত রয়েছে ডিএসই।

সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ২০১৫ সালের লিস্টিং রুলসের ৫১ (১) (এ) ধারা অনুযায়ী, এসব কোম্পানির পারফরমেন্স রিভিউ করার উদ্যোগ নেয়া হয়। রিভিউ শেষে ডিএসই’র ২০১৫ সালের লিস্টিং রেজুলেশনের ৫২ (১) (সি) ধারা অনুযায়ী কোম্পানিগুলোকে মূল মার্কেট থেকে তালিকাচ্যুত করা হবে- এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, ডিএসই যে কয়টি কোম্পানির অবস্থা পর্যালোচনা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার সবকটির আর্থিক অবস্থা অত্যন্ত দুর্বল। এমন কোম্পানির আর্থিক অবস্থা পর্যালোচনার জন্য এত দীর্ঘ সময় নেয়া কিছুতেই উচিত হচ্ছে না। ডিএসই’র উচিত দ্রুত পর্যালোচনা সম্পন্ন করে এসব কোম্পানির বাস্তব চিত্র প্রকাশ করা এবং তালিকাচ্যুত করার উদ্যোগ নেয়া।

এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলন, কোম্পানির আর্থিক অবস্থা পর্যালোচনা করতে ডিএসই’র এত দীর্ঘ সময় নেয়া কিছুতেই উচিত হচ্ছে না। দ্রুত পর্যালোচনা সম্পন্ন করে কোম্পানিগুলোর বাস্তব চিত্র প্রকাশ করা উচিত।

বিশিষ্ট এ অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, যে কয়টি কোম্পানির আর্থিক অবস্থা পর্যালোচনা করা হচ্ছে তার সবকটি দুর্বল কোম্পানি এবং ‘জেড’ গ্রুপভুক্ত। এসব কোম্পানিকে পুঁজিবাজার থেকে তালিকাচ্যুত করা উচিত। এমন দুর্বল কোম্পানিতে যেসব বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করছেন তাদেরও দোষ আছে। কেন তারা এমন দুর্বল কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করবেন?

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ডিএসই গত বছরের আগস্টে যখন সমতা লেদার’র আর্থিক অবস্থা পর্যালোচনা করার উদ্যোগ নেয় তখন কোম্পানিটির শেয়ারের দাম ছিল ৪৯ টাকা। এরপর ডিএসই’র পদক্ষেপের তথ্য প্রকাশ হলে কিছুদিন কোম্পানিটির শেয়ারের দাম কমতে থাকে। কিন্তু মাস পার না হতেই আবারও দফায় দফায় বাড়তে থাকে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম। এর মধ্যে চলতি বছরের মার্চ থেকে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম বাড়ার পালে নতুন করে হওয়া লেগেছে। গত তিন মাসে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম বেড়েছে ২০ টাকার ওপরে।

সাভার রিফ্র্যাক্টরিজ’র আর্থিক তথ্য পর্যালোচনার জন্য ডিএসই থেকে যখন উদ্যোগ নেয়া হয়, তখন কোম্পানিটির শেয়ারের দাম ছিল ১১৮ টাকা। এরপর এক মাসের মধ্যে তা কমে ৮০ টাকায় চলে আসে। তবে দীর্ঘদিনেও ডিএসই কোনো সিদ্ধান্ত না নেয়ায় চলতি বছরের শুরুতে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম বৃদ্ধির পালে নতুন করে হাওয়া লাগে। ১৪ জানুয়ারি কোম্পানিটির শেয়ারের দাম ১৭৯ টাকায় পৌঁছে যায়। এরপর দাম কমে মার্চে তা আবার ৮০ টাকায় চলে আসে। এরপর আবার দাম বাড়া শুরু হয়। ২৩ জুন লেনদেন শেষে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম দাঁড়িয়েছে ১১৯ টাকায়।

শুধু সমতা লেদার বা সাভার রিফ্র্যাক্টরিজ নয়, ডিএসই যে কয়টি কোম্পানির আর্থিক অবস্থা পর্যালোচনা করছে তার বেশির ভাগেরই চিত্র এমন। দীর্ঘদিনেও কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ না নেয়ার কারণে বিশেষ চক্র অনৈতিক ফায়দা লুটছে। এ কারণে মাঝেমধ্যে কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দাম হঠাৎ হঠাৎ অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে- এমন অভিযোগ বাজার সংশ্লিষ্টদের।

এ বিষয়ে ডিএসই’র এক সদস্য নাম প্রকাশ না করে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ‘জেড’ গ্রুপে থাকা কোম্পানিগুলো শেয়ারহোল্ডারদের কোনো লভ্যাংশ দিতে পারছে না। অনেক কোম্পানি ধারাবাহিকভাবে লোকসান করছে। কারও কারও সম্পদমূল্যও ঋণাত্মক। অথচ পুঁজিবাজারে প্রায় প্রায় এসব কোম্পানির শেয়ারের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যায়। এক ধরনের চক্র এসব কোম্পানির শেয়ার নিয়ে খেলা করে। এতে বাজারে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। যে কারণে বাজারের স্বার্থে এসব কোম্পানি তালিকাচ্যুত করা উচিত। চাপ উপেক্ষা করে ডিএসই’র এ বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া উচিত।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও পুঁজিবাজার বিশ্লেষক আবু আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, কোম্পানিগুলোর আর্থিক অবস্থা পর্যালোচনার জন্য ডিএসই’র এত দীর্ঘ সময় নেয়া উচিত হচ্ছে না। তাদের উচিত দ্রুত কোম্পানির আর্থিক অবস্থা পর্যালোচনা শেষ করে বিএসইসি’র মাধ্যমে তালিকাচ্যুত করার উদ্যোগ নেয়া।

ডিএসই’র পরিচালক রকিবুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, কোনো অবস্থাতেই নন-পারফরমিং ও জেড গ্রুপের শেয়ার মূল মার্কেটে থাকা উচিত না। তালিকাচ্যুত করার ক্ষেত্রে যদি আইনে কোনো অসামঞ্জস্যতা থাকে, তাহলে অনতিবিলম্বে তা সংশোধন করা উচিত। এক্ষেত্রে ভারত, থাইল্যান্ডের মতো উন্নয়নশীল দেশে যে ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হয়, সে ধরনের পদক্ষেপ নেয়া উচিত।

এমএএস/এমএআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।

আরও পড়ুন