সাধারণ বীমায় অনিয়ম, নষ্ট হচ্ছে কাজের পরিবেশ
সিনিয়র কর্মকর্তাকে অবমূল্যায়ন করে অধস্তন কর্মকর্তাদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠান সাধারণ বীমা কর্পোরেশন পরিচালিত হচ্ছে। একই সঙ্গে সরকারি নীতিমালা লঙ্ঘন করে ৩০ কর্মকর্তাকে তিন বছরের অধিক সময় ধরে একই বিভাগে/শাখায় পদায়ন করে রাখা হয়েছে। এমন কার্যকলাপ কোম্পানিটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করছে এবং কাজের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। বীমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) তদন্তে এমন চিত্র উঠে এসেছে।
আইডিআরএর সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের এপ্রিলে সাধারণ বীমা ঐক্য পরিষদ নামে অর্থ মন্ত্রণালয়ে সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের অনিয়ম নিয়ে একটি অভিযোগ করা হয়। বিষয়টি তদন্ত করতে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে গত বছরের জুনে আইডিআরএ’র চেয়ারম্যানের কাছে একটি চিঠি পাঠানো হয়।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের উপ-সচিব মো. সাঈদ কুতুব স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের সব স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের (স্বাক্ষরবিহীন) কাছ থেকে একটি অভিযোগ পাওয়া গেছে। অভিযোগের বিষয়ে তদন্তপূর্বক প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশক্রমে অভিযোগপত্রটি অগ্রায়ন করা হলো।
চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি তদন্ত করতে একটি কমিটি গঠন করে আইডিআরএ। ওই কমিটির তদন্তে বেরিয়ে আসে যে, সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি হলেও জেনারেল ম্যানেজার জ্যোৎস্না বিকাশ চাকমাকে প্রশাসনের কোনো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেয়া হয়নি। তার চেয়ে জুনিয়র ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার মো. আবদুল বারেক ও মো. জাকির হোসেনকে প্রশাসনিকসহ বেশির ভাগ গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
এ ধরনের কর্মকাণ্ড সিনিয়র কর্মকর্তা জ্যোৎস্না বিকাশ চাকমার জন্য অসম্মানের বলে তদন্ত কমিটির পক্ষ থেকে মতামত দিয়ে আরও বলা হয়, তিনি (জ্যোৎস্না বিকাশ চাকমা) কাজকর্মে অদক্ষ হলে তার জবাবদিহিতা চাওয়া যেত বা তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া যেত। কিন্তু তা না করে তাকে বাদ দিয়ে অধস্তন ডিজিএমকে দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন সিনিয়র কর্মকর্তাকে অবমূল্যায়নের পর্যায়ে পড়ে। এতে প্রতিষ্ঠানের কাজের পরিবেশ বিঘ্নিত হয়।
তদন্ত কমিটির অভিমত, দু’জন ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার মো. আব্দুল বারেক ও মো. জাকির হোসেনকে অতিরিক্ত দায়িত্ব প্রদান যথাযথ নয় মর্মে কমিটি মনে করে। তাদের দীর্ঘদিন ধরে প্রশাসন ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে রাখায় প্রতিষ্ঠানের কর্মপরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি করেছে। একই বিভাগে/শাখায় ৩০ কর্মকর্তাকে তিন বছরের অধিক সময় ধরে পদায়ন রাখা সরকারি নীতিমালার পরিপন্থী।
এদিকে গত বছরের এপ্রিলে সাধারণ বীমা ঐক্য পরিষদ’র নামে অর্থ মন্ত্রণালয়ে দায়ের করা অভিযোগে বলা হয়, ১৯৭৩ সালে সৃষ্টি সাধারণ বীমা কর্পোরেশন একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। বর্তমানে বার্ষিক মুনাফার পরিমাণ প্রায় ২৫০ কোটি টাকা। তারপরও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শাহরিয়ার আহসান সরকারি নিয়মনীতি তোয়াক্কা না করে মনগড়া নিয়ম-কানুন দিয়ে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন। তার অসৎ কর্মপরিচালনার জন্য একটি বিশেষ জনগোষ্ঠীর মাধ্যমে সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের সব স্তর তিনি নিয়ন্ত্রণ করছেন।
এতে আরও উল্লেখ করা হয় যে, সাধারণ বীমা কর্পোরেশনে ইতোপূর্বে ছয়জন জেনারেল ম্যানেজার ছিলেন। বর্তমানে মাত্র একজন জেনারেল ম্যানেজার থাকা সত্ত্বেও এমডি তাকে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় না দিয়ে শুধু ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার দিয়ে কর্পোরেশনের গুরুত্বপূর্ণ বিভাগগুলো পরিচালনা করছেন। বোর্ড, প্রশাসন, পুনঃবীমা, সম্পত্তি সংরক্ষণ বিভাগসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে তিনি তার পৃষ্ঠপোষকদের দ্বারা পরিচালনা করছেন।
‘বলাবাহুল্য যে, এমডি তার নিজ জেলার লোকদের প্রাধান্য দিয়ে প্রশাসন বিভাগকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করছেন। প্রশাসনের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার, ম্যানেজার, ডেপুটি ম্যানেজার, সহকারী ম্যানেজারসহ সবাই তার নিজ জেলার’ বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।
এতে বলা হয়, প্রশাসনের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার আব্দুল বারেকের দুর্নীতির বিরুদ্ধে এর আগে পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ হয়। কিন্তু বর্তমান এমডি তাতে কর্ণপাত না করে উল্টো তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ হলো পুনঃবীমা বিভাগ। সেখানেও তিনি তার নিজ জেলার লোককে প্রাধান্য দিয়েছেন। ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার জাকির হোসেনকে সার্বিক দায়িত্ব দিয়ে পুনঃবীমা বিভাগ পরিচালনা করছেন। এর মাধ্যমে তিনি কোটি কোটি টাকা কমিশন হিসেবে প্রাইভেট কোম্পানির কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছেন।
এতে আরও বলা হয়, পুনঃবীমা (অগ্নি) বিভাগে প্রশাসনের ডিজিএম বারেক প্রশাসন বিভাগ ছাড়াও অন্য অনেকগুলো দফতরের দায়িত্ব পালন করছেন এবং তার স্ত্রী শাহানা গনীকে বদলি করে পুনঃবীমা বিভাগে নিয়ে এসেছেন। এছাড়া পুনঃবীমার (সার্বিক দায়িত্ব) ডিজিএম জাকির হোসেনের স্ত্রী পারভীন সুলতানা অর্থ ও হিসাব বিভাগের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সর্বোপরি এমডি তার ছত্রচ্ছায়ায় তাদের দিয়ে দুর্নীতি ও অপকর্মগুলো সম্পাদন করছেন, যার কারণে এমডির বিরুদ্ধে কেউ কিছুই বলার সাহস পাচ্ছেন না।
‘এমডি তার পছন্দের লোককে গুরুত্বপূর্ণ বিভাগে বদলি করছেন’- এমন অভিযোগ করে আরও বলা হয়েছে যে, ‘তিন বছরের অধিক কেউ একই কর্মস্থলে থাকতে পারবেন না- এমন আইন পাস করা হয়েছে। এ আইনের সাহায্যে এমডি নিজের পছন্দ মতো কর্মকর্তাদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিভাগে বদলি করেছেন। এমনও হয়েছে যে, তার আক্রোশের কারণে ছয় মাসে অনেক কর্মকর্তাকে দুবারও বদলি করা হয়েছে।’
আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে লোক নিয়োগের ক্ষেত্রেও অনিয়ম করা হচ্ছে- উল্লেখ করে বলা হয়, ‘এমডি আউটসোর্সিং হিসেবে লোক নিয়োগ দিচ্ছেন। এতে তার নিজের আত্মীয়দের নিয়োগ দিয়ে প্রতি মাসে মোটা অঙ্কের কমিশন হাতিয়ে নিচ্ছেন। পূর্বের কর্মচারী ইউনিয়ন এ কাজে বাধা দেয়। কিন্তু ইউনিয়নের সভাপতি মোস্তাফা কামাল ও সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন পাটোয়ারীকে সুকৌশলে প্রমোশন দিয়ে ইউনিয়নকে অকেজো করা হয়েছে।’
এতে আরও বলা হয়, এমডি নিজ কর্তৃত্ব বজায় রাখার জন্য উপরের পদোন্নতি কার্যক্রম বন্ধ রেখে শুধু কর্মচারী ইউনিয়নের নেতাদের টার্গেট করে পদোন্নতি প্রদান করছেন। আসলে এমডির ওপরের ভাব দেখে বোঝার উপায় নেই যে, তিনি সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের সর্বস্তরে কী নাজুক অবস্থা সৃষ্টি করে রেখেছেন। তিনি তার দুঃশাসন বজায় রাখার লক্ষ্যে সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কোণঠাসা করে রেখেছেন। সত্য কথা বললে তাকে সাজা প্রদান এবং বদলিও করেন।
আরও পড়ুন >> বীমা কর্পোরেশনের মূলধন বাড়ল
সার্বিক বিষয়ে সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহরিয়ার আহসানের সঙ্গে গতকাল মঙ্গলবার (১৮ জুন) দুপুরে মোবাইলে ফোনে জাগো নিউজের পরিচয় দিয়ে যোগাযোগ করা হয়। প্রথমে তিনি ব্যস্ততার কথা বলে দুই ঘণ্টা পরে ফোন দিতে বলেন। তার কথা মতো দুই ঘণ্টা পর আবার ফোন দেয়া হয়। কিন্তু এ পর্যায়ে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।
আইডিআরএ মুখপাত্র ও সদস্য গোকুল চাঁদ দাস এ প্রসঙ্গে জাগো নিউজকে বলেন, তদন্ত করা হয়েছে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে। তদন্ত কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে কর্তৃপক্ষ এখনও কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। এছাড়া সাধারণ বীমা কর্পোরেশন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, সুতরাং এখানে আমাদের ভূমিকা কতটুকু সেটাও দেখতে হবে। কর্তৃপক্ষ কোনো সিদ্ধান্ত না নেয়া পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা যাবে না।
এমএএস/এমএআর/পিআর