বিশেষ সুবিধা পাচ্ছেন ঋণখেলাপিরা
>> মওকুফ, অবলোপন ও স্বল্প সুদে ঋণ পাচ্ছেন খেলাপিরা
>> ভালো গ্রাহকও এখন ঋণখেলাপি হওয়ার সুযোগ খুঁজছেন
>> সুবিধা নয় খেলাপিদের সামাজিকভাবে বয়কটের আহ্বান
>> ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা
ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ফেরত দেন না। হয়ে যান ঋণখেলাপি। খেলাপি ঋণের কারণে শাস্তির ভয়ে যেখানে তটস্থ থাকার কথা সেখানে আমাদের দেশে ঘটছে উল্টোটা। ঋণখেলাপি হলেই যেন খুলছে কপাল!
সুদ মওকুফ, পুনঃতফসিল, পুনর্গঠন, স্বল্প সুদে ঋণ, অবলোপনসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে সরকার। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ আর প্রভাবশালীদের চাপে অনিচ্ছা সত্ত্বেও এসব সুবিধা দিয়ে যাচ্ছে নিয়ন্ত্রণ সংস্থা কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
আরও পড়ুন >> কৃষি খাতেও কমেছে ঋণ বিতরণ
নতুন সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে আ হ ম মুস্তফা কামাল দায়িত্ব নেয়ার পরই ঘোষণা দেন, খেলাপি ঋণ এক টাকাও বাড়বে না। প্রায় এক লাখ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ কীভাবে কমিয়ে আনা যায়, তা নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে আসে একের পর এক প্রস্তাব। অসহায়ের মতো যা বাস্তবায়ন করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
কাগজে-কলমে খেলাপি ঋণ কমাতে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ঋণ অবলোপন-সংক্রান্ত নীতিমালা শিথিল করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নতুন নীতিমালায়, তিন বছরের মন্দমানের খেলাপি ঋণ আর্থিক হিসাব থেকে বাদ দেয়া যাবে। এতে কাগজে–কলমে খেলাপি ঋণ কম দেখাতে পারবে ব্যাংকগুলো। একই সঙ্গে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ অবলোপনের ক্ষেত্রে মামলাও করতে হবে না।
এছাড়া এসব ঋণের পুরোটার ওপর নিরাপত্তা সঞ্চিতিও না রাখার সুযোগ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর আগে কোনো ঋণ মন্দমানে শ্রেণিকৃত হওয়ার পাঁচ বছর পূর্ণ না হলে তা অবলোপন করা যেত না। আর মামলা না করে অবলোপন করা যেত সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকার ঋণ।
মন্দ বা ক্ষতিকর মানের খেলাপি ঋণকে স্থিতিপত্র (ব্যালান্সশিট) থেকে বাদ দেয়াই হলো ঋণ অবলোপন (রাইট অফ)। ২০০৩ সাল থেকে ঋণ অবলোপন করে আসছে ব্যাংকগুলো। সর্বশেষ ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরের হিসাব অনুযায়ী, ব্যাংকগুলো হল-মার্ক, বিসমিল্লাহসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ঋণ অবলোপন করেছে ৪৯ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা। অবলোপন করা ঋণ থেকে আদায় হয়েছে ১১ হাজার ৮৭৯ কোটি টাকা। ফলে এখন অবলোপন ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৩৭ হাজার ৮৬৬ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংকগুলো যাচাই-বাছাই ছাড়াই ঋণ দেয়ায় খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। অনেক সময় ঋণগ্রহীতাকে খুঁজেও পাওয়া যায় না। তাই ব্যালান্সশিট ভালো দেখাতে রাইট অফ করা হয়। তবে মামলা ছাড়াই যেসব ঋণ অবলোপন হবে, তা যেন মওকুফ না হয় সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। কারণ মামলা না থাকলে ওই ঋণের খোঁজ থাকবে না। এ রীতি চালু হলে ঋণ নিয়ে আর কেউ পরিশোধ করবে না। এজন্য নিয়ন্ত্রণ সংস্থাকে কঠোর হতে হবে।
আরও পড়ুন >> খেলাপি ঋণ এখন ৯৯ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা
এদিকে ঋণ অবলোপন নীতিমালা শিথিলের পরই ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কমাতে অনাদায়ী ঋণের সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চলতি বছরের ২১ এপ্রিল খেলাপি ঋণ হিসাবায়নের ক্ষেত্রেও সময় বাড়ানো হয়।
সব ধরনের চলতি ঋণ, ডিমান্ড ঋণ, ফিক্সড টার্ম লোন অথবা যেকোনো ঋণের কিস্তি তিন মাসের বেশি, কিন্তু নয় মাসের কম অনাদায়ী থাকলে তা সাব-স্ট্যান্ডার্ড ঋণ হিসেবে হিসাবায়ন করা হবে। আগে তিন মাসের বেশি অনাদায়ী থাকলে সাব-স্ট্যান্ডার্ড গণনা হতো।
নয় মাসের বেশি কিন্তু ১২ মাসের কম অনাদায়ী থাকলে তা ডাউটফুল লোন বা সন্দেহজনক ঋণ হবে। আগে ছয় মাসের বেশি, নয় মাসের কম অনাদায়ী ঋণকে ডাউটফুল লোন বা সন্দেহজনক ঋণ বলা হতো।
১২ মাসের বেশি অনাদায়ী ঋণ ব্যাড ডেট বা মন্দ ঋণ হবে। আগে নয় মাসের বেশি অনাদায়ী ঋণ মন্দ ঋণ হিসেবে বিবেচিত হতো। তবে সার্কুলারে সাব-স্ট্যান্ডার্ড ঋণের একটা অংশ খেলাপি ঋণ হিসেবে দেখাতে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আগে সাব-স্ট্যান্ডার্ড ঋণ খেলাপি ঋণ হিসেবে গণ্য করা হতো না। ৩০ জুন থেকে এ পদ্ধতি কার্যকর হবে। এটি বাস্তবায়ন হলে কাগজে-কলমে খেলাপি ঋণ কমে আসবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে ঋণ বিতরণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে নয় লাখ ১১ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা, যা ডিসেম্বর’১৭ শেষে ছিল ৭৪ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা বা ৯ দশমিক ৩১ শতাংশ। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৯ হাজার ৬০৮ কোটি টাকা। এর আগে ২০১৬ সালে খেলাপি ঋণ ছিল ৬২ হাজার ১৭২ কোটি টাকা। ২০১৫ সালে ছিল ৫১ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা।
শুধু ঋণের পরিমাণ কমানোই নয়, ঋণ খেলাফিদের নানা সুযোগ-সুবিধা দিতেও বেশকিছু উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। ইতোমধ্যে তাদের বিশেষ সুযোগ দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে একটি খসড়া পাঠিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এখানে ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট এবং ৯ শতাংশ সুদহারে ঋণ পুনঃতফসিলের জন্য ১০ বছরের প্রস্তাব রয়েছে। যা শিগগিরই সার্কুলার আকারে জারি করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদ্যমান নিয়মে সবমিলিয়ে একটি মেয়াদে ঋণ সর্বোচ্চ তিনবার অর্থাৎ ৩৬ মাসের জন্য পুনঃতফসিল করা যায়। এজন্য ডাউন পেমেন্ট হিসাবে মোট বকেয়ার প্রথমবার ১০ শতাংশ, দ্বিতীয়বার ২০ শতাংশ এবং তৃতীয়বার ৩০ শতাংশ অর্থ জমা দিতে হয়। এর বাইরে কোনো গ্রাহককে অতিরিক্ত সুবিধা দিতে হলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন নিতে হয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠাতে হয়।
জানা গেছে, ঋণখেলাপিদের সরকার বিশেষ সুবিধা দেবে- অর্থমন্ত্রীর এমন ঘোষণার পর অনেক নিয়মিত ও ভালো গ্রাহকও এখন ঋণখেলাপি হওয়ার সুযোগ খুঁজছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক শিল্পোদ্যোক্তা জানান, আমি যে লোন নিয়েছি তার সুদহার প্রায় সাড়ে ১২ শতাংশ। কিন্তু সরকার ঋণখেলাপিদের ৯ শতাংশ হারে ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ দেবে। তাহলে আমি নিয়মিত গ্রহক হয়ে কি দোষ করলাম? খেলাপি হওয়াই ভালো। তাহলে ৯ শতাংশ হরে ঋণ পাব।
আরও পড়ুন >> খেলাপি ঋণ এক টাকাও বাড়বে না : অর্থমন্ত্রী
এ বিষয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, খেলাপিদের জন্য সরকার যে পদক্ষেপ নিচ্ছে, তা করলে ব্যাংক খাতে আরও বেশি সমস্যা দেখা দেবে। মোট ঋণের ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ১০ বছরে বকেয়া টাকা পরিশোধের সুযোগ দেয়া হবে। তাদের ঋণের সুদ হবে ৯ শতাংশ। এটিই যদি হয় তাহলে যারা ঋণখেলাপি নয়, নিয়মিত গ্রাহক তাদের ক্ষেত্রে অবিচার করা হবে। তারা ১০ থেকে ১২ শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে পরিশোধ করছে। পরবর্তীতে এ ঋণ আর পরিশোধ করবে না। কারণ তারা বলবে, খেলাপি হলেই তো কম সুদে ঋণ পাওয়া যাবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এ প্রসঙ্গে জানান, ঋণ পুনর্গঠনের পূর্ব অভিজ্ঞতা খুব ভালো নয়। ক্ষতিগ্রস্ত শিল্পোদ্যোক্তাদের বিশেষ সুবিধা দিতে ২০১৫ সালে ঋণ পুনর্গঠনের নীতিমালা জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, ঋণ পুনর্গঠনের মাধ্যমে শিল্পগ্রুপগুলোর লোকসান কাটিয়ে উঠবে এবং ঋণ পরিশোধ করবে। যেসব শিল্পগ্রুপের ৫০০ কোটি টাকার ওপরে খেলাপি ঋণ ছিল তাদের ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে এবং যেসব শিল্পগ্রুপের এক হাজার কোটি টাকার ওপরে খেলাপি ঋণ ছিল তাদের ১ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ঋণ নবায়নের সুযোগ দেয়া হয়।
ওই সময় ১১টি শিল্পগ্রুপ ১৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠন করে। ফলে কাগজে-কলমে খেলাপি ঋণের পরিমাণও কমে। কিন্তু পুনর্গঠনের সুবিধার পরও সময় মতো ঋণ পরিশোধ না করায় পরবর্তীতে তা আবারও খেলাপি হয়ে যায়। তাই খেলাপিদের গণহারে সুবিধা দিলে আগামীতে ব্যাংক খাতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মত দেন তিনি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খেলাপি ঋণ কমাতে পদ্ধতিগত বড় পরিবর্তন আনতে হবে। ঋণখেলাপিদের বড় ধরনের শাস্তি দিতে হবে, অথবা সামাজিকভাবে তাদের একঘরে করতে হবে। যেমনটি করা হয় চীন ও নেপালে। চীনে ঋণখেলাপিদের বিমানে ওঠায় নিষেধাজ্ঞা আছে, নেপালের মতো দেশে ঋণখেলাপিরা পাসপোর্ট সুবিধা পান না। এসব দেশ থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে।
এখন সময় এসেছে খেলাপি ঋণ কমাতে হলে আমাদেরও এমন বড় কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তাতে তারা একটা বড় ধাক্কা খাবেন, সবাই সতর্ক হবেন। এ ধাক্কাটা দিতেই হবে। এছাড়া ব্যাংকগুলোর আগ্রাসী মুনাফার প্রবণতাও কমাতে হবে।
এসআই/এমএআর/আরআইপি