দুই-তৃতীয়াংশ প্রতিষ্ঠানের অডিট রিপোর্ট ভুয়া

সাঈদ শিপন
সাঈদ শিপন সাঈদ শিপন , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১০:৫৬ এএম, ০৭ মে ২০১৯

>> বছরে অডিট রিপোর্ট করে ২২ হাজারের মতো প্রতিষ্ঠান
>> এনবিআরের কাছে রিটার্ন জমা দেয় ৫৫ হাজার প্রতিষ্ঠান
>> ৩৩ হাজার প্রতিষ্ঠানের অডিট রিপোর্ট সই করেন কারা?

সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিতে দুই-তৃতীয়াংশ প্রতিষ্ঠানই জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) ভুয়া অডিট রিপোর্ট জমা দিচ্ছে। চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টের সিল, সই জাল করে ভুয়া তথ্য ও পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে তৈরি হচ্ছে এসব অডিট রিপোর্ট। এতে মোটা অঙ্কের রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আয়কর রিটার্ন জমা দেয়ার সময় কোম্পানিগুলোকে নিরীক্ষিত আর্থিক বিবরণী বা অডিট রিপোর্ট জমা দিতে হয়। এ নিরীক্ষা কার্যক্রম সম্পাদন করতে হয় নির্দিষ্ট চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টের মাধ্যমে।

যেসব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট নিরীক্ষা কার্যক্রম সম্পাদন করেন তাদের সনদ দেয় ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএবি) ও ইনস্টিটিউট অব কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএমএবি)।

ওই দুই প্রতিষ্ঠান থেকে সিএ অথবা সিএমএ পাস করা চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টরা অডিট রিপোর্ট দেয়ার যোগ্যতা রাখেন। বর্তমানে অডিট রিপোর্ট দিতে পারেন এমন যোগ্যতাসম্পন্ন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট আছেন তিন হাজার ১২২ জন। তাদের মধ্যে সিএ পাস করা এক হাজার ৮০৫ জন এবং সিএমএ পাস করা আছেন এক হাজার ৩১৭ জন।

সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, অডিট রিপোর্ট দেয়ার যোগ্যতা রাখা এসব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট বছরে ২২ হাজার প্রতিষ্ঠানের অডিট রিপোর্ট দিয়ে থাকেন। সে হিসাবে বৈধ অডিট রিপোর্ট আছে ২২ হাজার প্রতিষ্ঠানের। তবে এনবিআরের কাছে রিটার্ন জমা দেয়া প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৫৫ হাজার। অর্থাৎ ৩৩ হাজার প্রতিষ্ঠান এনবিআরের কাছে ভুয়া অডিট রিপোর্ট জমা দিচ্ছে।

এনবিআরের এক কর্মকর্তা বলেন, রিটার্ন জমা দেয়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে বড় একটা অংশই ভুয়া অডিট রিপোর্ট জমা দেয়। এ ধরনের অভিযোগ আনেক আগে থেকেই আছে। ভুয়া তথ্য ও পরিসংখ্যান দিয়ে তৈরি করা এসব অডিট রিপোর্টের কারণে কোম্পানিগুলোর প্রকৃত আয়ের চিত্র পাওয়া যায় না। মূলত কর ফাঁকি দেয়ার জন্য এসব প্রতিষ্ঠান এমন অনৈতিক কাজ করে। এতে সরকার বিপুল অঙ্কের রাজস্ব হারাচ্ছে।

ওই কর্মকর্তা আরও জানান, যেসব প্রতিষ্ঠান ভুয়া অডিট রিপোর্ট জমা দেয় তাদের ধরতে ২০১৫ সালে একবার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক, রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মস (আরজেএসসি) ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)-সহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সহায়তায় ভুয়া অডিট রিপোর্ট চিহ্নিত করার উদ্যোগ নেয়া হয়। তবে যে কারণেই হোক এখনও ভুয়া অডিট রিপোর্ট জমা দেয়া বন্ধ হয়নি।

বিভিন্ন কোম্পানির অডিট রিপোর্ট করে থাকেন এমন এক চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট নাম প্রকাশ না করে বলেন, আরজেএসসি থেকে নিবন্ধন নেয়া কোম্পানির সংখ্যা দুই লাখের ওপরে। অথচ এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাত্র ৫৫ হাজার আয়কর রিটার্ন দেয়। আবার যেসব কোম্পানি রিটার্ন জমা দেয় তাদের বেশির ভাগ ভুয়া অডিট রিপোর্ট দেয়। অপরদিকে যোগ্যতাসম্পন্ন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টরা যে অডিট রিপোর্ট অনুমোদন করেন তার মান নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। এটা খুবই দুঃখজনক।

তিনি বলেন, যেসব প্রতিষ্ঠান ভুয়া অডিট রিপোর্ট জমা দিচ্ছে, তাদের চিহ্নিত করা খুব একটা কঠিন কাজ নয়। যোগ্যতাসম্পন্ন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টরা কোন কোন প্রতিষ্ঠানের অডিট রিপোর্ট অনুমোদন দিচ্ছেন সেই তালিকার সঙ্গে রিটার্ন জমা দেয়া কোম্পানিগুলো মেলালে সহজেই ভুয়া অডিট রিপোর্ট চিহ্নিত করা সম্ভব।

‘যোগ্যতাসম্পন্ন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টরা যেসব প্রতিষ্ঠানের অডিট রিপোর্ট অ্যাপ্রুভ (অনুমোদন) করেছেন তার তথ্য একাধিকবার এনবিআরের কাছে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু এরপরও ভুয়া অডিট রিপোর্ট দেয়া বন্ধ হচ্ছে না।’

ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিলের (এফআরসি) চেয়ারম্যান সি কিউ কে মোস্তাক আহমেদ এ প্রসঙ্গে বলেন, শুধুমাত্র কোয়ালিফাইড অ্যাকাউন্ট্যান্টরাই অডিট রিপোর্টে সই করতে পারেন। তারা ছাড়া কারও ক্ষমতা নেই অডিট রিপোর্ট অ্যাপ্রুভ করার। কোন কোন প্রতিষ্ঠান ভুয়া অডিট রিপোর্ট দিচ্ছে তা এনবিআরের জন্য ধরা খুবই সহজ। কোয়ালিফাইড অ্যাকাউন্ট্যান্টরা কোন কোন প্রতিষ্ঠানের অডিট রিপোর্ট দিয়েছেন তা-তো উন্মুক্ত।

‘সুতরাং তাদের তালিকার সঙ্গে রিটার্ন জমা দেয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর তালিকা এনবিআর মিলিয়ে দেখলেই সহজে বুঝা যাবে কারা অনিয়ম করছে’- যোগ করেন তিনি।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন বলেন, একটি কোম্পানির ব্যালান্স শিট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ব্যালান্স শিট দেখেই কোম্পানির বাস্তব চিত্র পাওয়া যায়। কিন্তু আমাদের বাজারে সৎ ও শক্তিশালী ব্যালান্স শিটের সমস্যা রয়েছে। এ কারণে দুর্বল কোম্পানি তালিকাভুক্ত হচ্ছে। অডিটররা কীভাবে এসব ব্যালান্স শিট অনুমোদন করছেন তা ভেবে দেখা উচিত।

তিনি বলেন, গত কয়েক বছরে যেসব কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে তাদের ব্যালান্স শিট দেখলে কষ্ট হয়। এসব কোম্পানির ব্যালান্স শিট তো কোনো চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট অনুমোদন দিয়েছেন। ব্যালান্স শিটে লাভ-লোকসানের কোনো ধারাবাহিকতা নেই। একবার লোকসান করছে তো পরের বছরই বড় মুনাফা করছে। এটা কখনওই প্রকৃত চিত্র হতে পারে না।

এফআরসি’র নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, অডিটররা দুর্বল অডিট রিপোর্ট দেন- এমন অভিযোগ দীর্ঘদিনের। আমাদের দেশে প্রফেশনাল চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টদের বেতন খুবই কম। দুর্বল অডিট রিপোর্টের জন্য এটি একটি অন্যতম কারণ। তবে কোনো চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট অডিট রিপোর্ট দেয়ার ক্ষেত্রে নিয়ম-নীতি লঙ্ঘন করলে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষমতা এফআরসিকে দেয়া হয়েছে।

ভুয়া অডিট রিপোর্টের বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের দেশে বর্তমানে কোয়ালিফাইড অ্যাকাউন্ট্যান্ট আছেন তিন হাজার ১২২ জন। তাদের বাইরে কেউ অডিট রিপোর্ট সই করার যোগ্যতা রাখেন না।

‘আমাদের তথ্য অনুযায়ী, কোয়ালিফাইড অ্যাকাউন্ট্যান্টরা বছরে ২২ হাজারের মতো কোম্পানির অডিট রিপোর্ট করে থাকেন। অথচ এনবিআরের কাছে রিটার্ন জমা দেয় ৫৫ হাজার কোম্পানি। তাহলে বাকি ৩৩ হাজার কোম্পানির অডিট রিপোর্ট করা সই করেন? এটা বুঝতে বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না’- বলেন মোহাম্মদ মহিউদ্দিন আহমেদ।

এমএএস/এমএআর/এমকেএইচ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।