বিএসইসির দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে কারসাজি চক্র

সাঈদ শিপন
সাঈদ শিপন সাঈদ শিপন , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১২:৩৫ পিএম, ১৪ এপ্রিল ২০১৯

>> চেয়ারম্যান ও কমিশনার নিয়োগে মানা হচ্ছে না আইন
>> ৫-১০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার বিপরীতে জরিমানা ৫-১০ লাখ
>> তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতেই ব্যবস্থা গ্রহণ করে কমিশন : মুখপাত্র

একের পর এক কারসাজি চলছে দেশের পুঁজিবাজারে। কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে বাড়ানো হচ্ছে বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ারের দাম। এর মাধ্যমে একটি চক্র বাজার থেকে মোটা অঙ্কের মুনাফা তুলে নিলেও সর্বশান্ত হচ্ছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।

এমন প্রেক্ষাপটে দেশের পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) তদন্তে কারসাজির প্রমাণ উঠে আসলেও নেয়া হচ্ছে না কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। ফলে কারসাজি করে বার বার পার পেয়ে যাচ্ছে মুনাফালোভী চক্রটি। নতুন নতুন কারসাজিতে জড়িত হচ্ছেন তারা।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থার দুর্বলতার কারণেই কারসাজি চক্রটি কঠিন শাস্তির হাত থেকে রক্ষা পেয়ে যাচ্ছেন। এ দুর্বলতার পেছনে নিয়ন্ত্রক সংস্থার শীর্ষ কর্তাব্যক্তিদের নিয়োগের ক্ষেত্রে আইন না মানাও একটি কারণ।

গত বছরের এপ্রিলে বিএসইসির চেয়ারম্যান হিসেবে ড. এম খায়রুল হোসেনের চুক্তির মেয়াদ দুই বছর বাড়ানো হয়। এ ক্ষেত্রে আইনের কোনো তোয়াক্কা করা হয়নি। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএনইসি) আইন- ১৯৯৩ এর ৫ এর ৬ উপধারায় বলা হয়েছে, ‘বিএসইসির চেয়ারম্যান ও কমিশনাররা শুধুমাত্র একটি মাত্র মেয়াদের জন্য পুনরায় নিয়োগের যোগ্য হইবেন’।

কিন্তু ২০১১ সালের ২৩ আগস্ট বিএসইসিতে চেয়ারম্যান হিসেবে খায়রুল হোসেনের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দু’দফা বাড়ানো হয়েছে। প্রথমবার তাকে তিন বছরের জন্য নিয়োগ দেয়া হয়। যা শেষ হওয়ার আগেই পুনরায় নিয়োগ পান তিনি। তবে এক্ষেত্রে তিনি চার বছরের জন্য নিয়োগ পান। দ্বিতীয় দফায় তাকে চার বছরের জন্য নিয়োগ দেয়া হয়। কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়, ওই নিয়োগের আগেই কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের মেয়াদ তিন বছর থেকে বাড়িয়ে চার বছর করা হয়।

দ্বিতীয় দফায় অর্থাৎ ২০১৪ সালের ১০ এপ্রিল চার বছরের চুক্তিতে বিএসইসির চেয়ারম্যান করা হয় খায়রুল হোসেনকে। তবে তিনি বিএসইসিতে যোগ দেন ওই বছরের ১৫ মে। সে হিসাবে দুই দফা বিএসইসির চেয়ারম্যান নিয়োগ পাওয়া খায়রুল হোসেনের সাত বছর পূর্ণ হয় গত বছরের ১৪ মে। কিন্তু সেই মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই সরকার তাকে আরও দুই বছরের জন্য নিয়োগ দিয়ে নির্দেশনা জারি করে। একইভাবে কমিশনার হেলাল উদ্দিন নিজামির চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ক্ষেত্রেও আইন লঙ্ঘন করে দুই দফা মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে।

এ বিষয়ে ডিএসইর এক সদস্য বলেন, বিএসইসির চেয়ারম্যান ও একজন কমিশনারের নিয়োগ নবায়ন হয়েছে আইন লঙ্ঘন করে। যে নিয়ন্ত্রক সংস্থার চেয়ারম্যান ও কমিশনার নিয়োগের ক্ষেত্রে আইন মানা হয় না, সেই সংস্থা আইনের সঠিক প্রয়োগ করবে কীভাবে?

তিনি অভিযোগ করেন, দুষ্টচক্র কখন, কোন শেয়ার নিয়ে কারসাজি করে তার সবই বিএসইসি জানে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে বিএসইসি দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেয় না। মাঝেমধ্যে লোক দেখানোর জন্য কিছু ব্যক্তিকে নামমাত্র জরিমানা করা হয়।

সম্প্রতি মুন্নু জুট স্টাফলার্স, মুন্নু সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজ, লিগাসি ফুটওয়্যার, বাংলাদেশ অটোকার, কুইন সাউথ টেক্সটাইল, আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজ ও ইস্টার্ন লুব্রিকেন্টসের শেয়ার নিয়ে কারসাজি করার প্রমাণ পায় বিএসইসি। ওই অপরাধে জড়িত থাকার দায়ে কমার্স ব্যাংক সিকিউরিটিজ অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের সাবেক এভিপি মো. সাইফুল ইসলামকে ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।

একই অপরাধে মো. আলী মনসুরকে ১০ লাখ, মুকুল কুমার সাহাকে এক লাখ, লিপিকা সাহাকে দুই লাখ, মো. আব্দুল হালিমকে ২৫ লাখ, কমার্স ব্যাংকের ভিপি মোহাম্মদ সাইফুল ইসলামকে ২৫ লাখ, পদ্মা গ্লাসকে পাঁচ লাখ, রহমত মেটালকে দুই লাখ, আব্দুল কাউয়ুমকে পাঁচ লাখ, মরিয়ম নেছাকে পাঁচ লাখ, মেসার্স কাউয়ুম অ্যান্ড সন্সকে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।

এছাড়া পপুলার লাইফ ইন্স্যুরেন্স ও স্টাইল ক্রাফটের শেয়ার নিয়ে কারসাজিরও প্রমাণ পায় বিএসইসি। এরপর পপুলার লাইফের শেয়ার নিয়ে অনিয়ম করায় মোস্তফা হেলাল কবিরকে ১০ লাখ, ফউজিয়া ইয়াসমিনকে ১০ লাখ এবং মো. শাহাদাত হোসেনকে ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।

অন্যদিকে স্টাইল ক্রাফটের শেয়ার লেনদেনে অনিয়ম করায় মো. ইডমুন গুডাকে দুই লাখ এবং মো. মাহামুদুজ্জামানকে দুই লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিএসইসির তদন্তের ভিত্তিতে কারসাজির সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া ব্যক্তিদের যে জরিমানা করা হয়েছে, তারা এর থেকে কয়েকগুণ বেশি মুনাফা করেছেন। মোটা অঙ্কের মুনাফা তুলে নেয়ার পর নামমাত্র কিছু জরিমানা করা হলে এসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কিছুই হবে না। বরং তারা নতুন করে কারসাজিতে জড়িত হবে।

এ বিষয়ে ডিএসইর এক সদস্য বলেন, এতগুলো কোম্পানির শেয়ার নিয়ে কারসাজির পর কোনো কোনো অপরাধীকে মাত্র দুই থেকে পাঁচ লাখ টাকাও জরিমানা করা হয়েছে। এমন নামমাত্র শাস্তি দিয়ে কারসাজি ঠেকানো যাবে না। এটা বন্ধ করতে হলে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

ডিএসইর ওই সদস্য আরও বলেন, সম্প্রতি বিভিন্ন বীমা কোম্পানির শেয়ারের দাম যেভাবে বেড়েছে তা কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারে না। এমন দাম বাড়ার ফলে বিশেষ চক্র বাজার থেকে মোটা অঙ্কের মুনাফা তুলে নিয়ে গেছে। কিন্তু নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি এ নিয়ে এখনও কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। হয়তো একদিন শোনা যাবে, বিএসইসির তদন্তে দু-এক কোম্পানির শেয়ার নিয়ে কারসাজির তথ্য বেরিয়ে এসেছে এবং নামমাত্র কিছু জরিমানা করা হবে। কিন্তু তার আগেই তো সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সর্বনাশ যা হওয়ার তা হয়ে যাবে।

কারসাজির মাধ্যমে ৫-১০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার বিপরীতে ৫-১০ লাখ টাকা জরিমানা করে কারসাজি বন্ধ করা যাবে কি- বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সাইফুর রহমানকে এমন প্রশ্ন করা হয়। উত্তরে তিনি বলেন, জরিমানা করার বিষয়টি সম্পূর্ণই কমিশনের ওপর নির্ভর করে। কমিশন মনে করলে জারিমানা করবে। যতটুকু তথ্য-প্রমাণ হাজির হবে তার ভিত্তিতেই কমিশন ব্যবস্থা গ্রহণ করে।

এমএএস/এমএমজেড/এমএআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।