চড়েছে বহুজাতিক কোম্পানির শেয়ার দাম

সাঈদ শিপন
সাঈদ শিপন সাঈদ শিপন , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০১:৩৬ পিএম, ১৮ মার্চ ২০১৯

ডেটল, মরটিন, হারপিক, ভ্যানিশ, লাইজল ও ভিটসহ কয়েকটি প্রসাধন পণ্যের কল্যাণে দেশে দাপটের সঙ্গে ব্যবসা করছে রেকিট বেনকিজার। দেশের পুঁজিবাজারে বহুজাতিক এ কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয় ১৯৮৭ সালে। ভালো ব্যবসার পাশাপাশি শেয়ারহোল্ডারদের মোটা অঙ্কের লভ্যাংশ দেয়ার কারণে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার বরাবরই বিনিয়োগকারীদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে।

বর্তমানে কোম্পানিটির শেয়ার পুঁজিবাজারে সব থেকে দামির তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। ১৪ মার্চ লেনদেন শেষে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার দাম দাঁড়ায় ৩ হাজার ২৪৬ টাকা, যা গত ২৫ ফেব্রুয়ারি ছিল ২ হাজার ৩৯৯ টাকা। অর্থাৎ মাত্র ১২ কার্যদিবসে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার দাম বাড়ে ৮৪৭ টাকা।

অবশ্য এ কোম্পানির শেয়ারের দাম বৃদ্ধির প্রবণতা গত নভেম্বর থেকেই রয়েছে। লভ্যাংশ ঘোষণাকে কেন্দ্র করে প্রায় চার মাস ধরে কোম্পানিটির শেয়ার দাম অনেকটা টানা বেড়েছে। তবে গত সপ্তাহে ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো বাংলাদেশের লভ্যাংশ ঘোষণার পর রেকিট বেনকিজারের শেয়ারের দাম বৃদ্ধির পালে নতুন করে হাওয়া লেগেছে।

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত ৭ নভেম্বর রেকিট বেনকিজারের শেয়ার দাম ছিল ১ হাজার ৭০১ টাকা। সেখান থেকে কয়েক ধাপে বেড়ে ১১ মার্চ কোম্পানিটির শেয়ার দাম দাঁড়ায় ২ হাজার ৮০৪ টাকায়। ১২ মার্চ ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো বাংলাদেশের লভ্যাংশ ঘোষণার সংবাদ আসার পর ওইদিনই রেকিট বেনকিজারের শেয়ার দাম বাড়ে ১৪০ টাকা। পরের দুদিন দাম বাড়ার এ প্রবণতা অব্যাহত থাকলে মাত্র তিন কার্যদিবসে কোম্পানিটির শেয়ার দাম বাড়ে ৪৪২ টাকা।

পুঁজিবাজারে সার্বিক এক ধরনের মন্দা দেখা দিলেও শেয়ারহোল্ডারদের নিয়মিত মোটা অঙ্কের লভ্যাংশ দেয়া বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর শেয়ার দাম বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সম্প্রতি এমন দাপট দেখা গেল। বিশেষ করে ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো বাংলাদেশ শেয়ারহোল্ডারদের জন্য ৫০০ শতাংশ নগদ ও ২০০ শতাংশ বোনাস শেয়ার ঘোষণার পর এসব কোম্পানির শেয়ার দাম বৃদ্ধি শুরু হয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বহুজাতিক কোম্পানির সংখ্যা খুবই কম। যে কয়টি তালিকাভুক্ত তার বড় অংশেরই পরিশোধিত মূলধন খুবই কম। তালিকাভুক্ত হওয়ার পর দীর্ঘদিনেও এসব কোম্পানি মূলধন বাড়ায়নি। ফলে শেয়ারের সংখ্যাও কম। আবার স্বল্পসংখ্যক শেয়ারের মধ্যে সিংহভাগই রয়েছে উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের হাতে। ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা চাইলেও এসব কোম্পানির শেয়ার কিনতে পারেন না। অপরদিকে কোম্পানিগুলো নিয়তিম ভালো পারফর্মেন্স করছে এবং মোটা অঙ্কের লভ্যাংশ দিচ্ছে। যে কারণে, শেয়ারের অনেক দাম হওয়ার পরও বিনিয়োগকারীদের একটি অংশ এসব কোম্পানির দিকে ঝুঁকছে।

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ওষুধ ও রসায়ন খাতের প্রতিষ্ঠান রেকিট বেনকিজার ২০১৭ সালে শেয়ারহোল্ডারদের ৭৯০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেয়। তার আগের বছর ৭৭৫ শতাংশ এবং ২০১৫ সালে ৬৫০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেয় এ প্রতিষ্ঠান। নিয়মিত এমন বড় লভ্যাংশ দেয়া কোম্পানিটির পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ মাত্র ৪ কোটি ৭২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। আর শেয়ার সংখ্যা ৪৭ লাখ ২৫ হাজার। এর মধ্যে ৮২ দশমিক ৯৬ শতাংশ শেয়ারই রয়েছে উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের হাতে। সে হিসাবে শেয়ারহোল্ডারদের বড় লভ্যাংশ দিলেও তার সিংহভাগই নিয়ে যাচ্ছেন উদ্যোক্তা ও পরিচালকরা।

বর্তমানে শেয়ারের দামের দিক থেকে সবার উপরে রয়েছে ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো বাংলাদেশ। লভ্যাংশ ঘোষণার কারণে গত ১২ মার্চ কোম্পানিটির শেয়ার দাম একদিনে ১ হাজার ৫৫১ টাকা পর্যন্ত বেড়ে যায়। মাত্র ৬০ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধনের এ কোম্পানিটির মোট শেয়ারের ৭২ দশমিক ৯১ শতাংশই রয়েছে উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের হাতে। আর সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে আছে মাত্র দশমিক ৬৮ শতাংশ শেয়ার।

স্বল্প মূলধনের আরেক বহুজাতিক কোম্পানি বার্জার পেইন্টস। গত দেড় মাসে কোম্পানিটির শেয়ার বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। জানুয়ারি মাসের শুরুতে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারের দাম ছিল ১ হাজার ৩৪৫ টাকায়, যা ১৪ মার্চ লেনদেন শেষে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৮৭ টাকায়। বর্তমানে এ কোম্পানির শেয়ার দাম উপরের দিক থেকে তৃতীয় স্থানে রয়েছে। গত বছর ১০০ শতাংশ বোনাস শেয়ার দিয়ে মূলধন দ্বিগুণ করার পরও কোম্পানিটির বর্তমান পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ ৪৬ কোটি ৩৭ লাখ ৮০ হাজার টাকা। প্রতিষ্ঠানটির মোট শেয়ারের ৯৫ শতাংশই রয়েছে উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের হাতে।

রেকিট বেনকিজার, ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো বাংলাদেশ, বার্জার পেইন্টসর পাশাপাশি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বহুজাতিক কোম্পানির মধ্যে রয়েছে- গ্লাক্সোস্মিথকাইন, ম্যারিকো বাংলাদেশ, লিন্ডে বাংলাদেশ, বাটা সু, লাফার্জহোলসিম সিমেন্ট, হাইডেলবার্গ সিমেন্ট, আরএকে সিরামিকস, সিঙ্গার বাংলাদেশ এবং গ্রামীণফোন। এর মধ্যে- গ্লাক্সোস্মিথকাইন, ম্যারিকো বাংলাদেশ, লিন্ডে বাংলাদেশ, বাটা সু- এ চার কোম্পানির শেয়ার দাম শীর্ষ ১০ দামি প্রতিষ্ঠানের তালিকায় রয়েছে।

গ্লাক্সোস্মিথক্লাইন

গত ৫ মার্চ কোম্পানিটির শেয়ার দাম ছিল ১ হাজার ৩২৯ টাকা, যা টানা বেড়ে ১৪ মার্চ দাঁড়ায় ১ হাজার ৫৬৬ টাকায়। অর্থাৎ সাত কার্যদিবসে কোম্পানিটির শেয়ার দাম বেড়েছে ২৩৮ টাকা। মাত্র ১২ কোটি ৪ লাখ ৬০ হাজার টাকা পরিশোধিত মূলধনের এ কোম্পানিটির মোট শেয়ারের ৮১ দশমিক ৯৮ শতাংশই রয়েছে উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের হাতে। প্রতিটি ১০ টাকা অবিহিত মূল্যের শেয়ারের বিপরীতে শেয়ারহোল্ডারদের ২০১৭ সালে ৫৫০ শতাংশ, ২০১৬ সালে ৫০০ শতাংশ ও ২০১৫ সালে ৫৫০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেয় কোম্পানিটি।

ম্যারিকো বাংলাদেশ

২০১৯ সালের জন্য লভ্যাংশ ঘোষণার অপেক্ষায় থাকা কোম্পানিটি শেয়ারহোল্ডারদের ২০১৮ সালে ৬০০ শতাংশ, ২০১৭ সালে ৫০০ শতাংশ, ২০১৬ সালে ৪৫০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেয়। এবারও এ কোম্পানি মোটা অঙ্কের লভ্যাংশ দেবে এমটাই প্রত্যাশা করছেন বিনিয়োগকারীরা। ফলে লভ্যাংশ ঘোষণাকে কেন্দ্র করে গত ৭ থেকে ১৩ মার্চ পর্যন্ত চার কার্যদিবসে কোম্পানিটির শেয়ার দাম বাড়ে ২৫৩ টাকা। বর্তমানে কোম্পানিটির শেয়ার দাম রয়েছে ১ হাজার ৫২৬ টাকায়। ৩১ কোটি ৫০ লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধনের এ কোম্পানির মোট শেয়ারের ৯০ শতাংশই রয়েছে উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের হাতে।

লিন্ডে বাংলাদেশ

১৫ কোটি ২১ লাখ ৮০ হাজার টাকা পরিশোধিত মূলধনের ওষুধ ও রসায়ন খাতের এ কোম্পানির মোট শেয়ারের ৬০ শতাংশ রয়েছে উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের হাতে। ২০১৭ সালে ৩৪০ শতাংশ এবং ২০১৬ ও ২০১৫ সালে ৩১০ শতাংশ করে লভ্যাংশ দেয়া প্রতিষ্ঠানটি কিছুদিনের মধ্যে ২০১৮ সালের জন্য লভ্যাংশ ঘোষণা করবে। গত ১৩ ও ১৪ মার্চ দুই কার্যদিবসে কোম্পানিটির শেয়ার দাম ৬৩ টাকা বেড়ে ১ হাজার ২৮৯ টাকায় অবস্থান করছে।

বাটা সু

চামড়া খাতের বহুজাতিক এ কোম্পানির শেয়ার দাম ১০ থেকে ১৪ মার্চ পর্যন্ত চার কার্যদিবসে বাড়ে ১৩৪ টাকা। বর্তমানে কোম্পানিটির শেয়ার দাম ১ হাজার ২৬৫ টাকা। শেয়ারবাজারের দামের দিক থেকে শীর্ষ ১০টি প্রতিষ্ঠানের তালিকায় কোম্পানিটি রয়েছে। ১৩ কোটি ৬৮ লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধনের এ কোম্পানির মোট শেয়ারের ৭০ শতাংশ রয়েছে উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের হাতে। ২০১৭ সালে ৩৩৫ শতাংশ, ২০১৬ সালে ৩৩০ শতাংশ ও ২০১৫ সালে ৩২০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেয়া এ কোম্পানি ২০১৮ সালের লভ্যাংশ ঘোষণার অপেক্ষায় আছে।

ডিএসইর এক সদস্য বলেন, সম্প্রতি ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো লভ্যাংশ হিসেবে ২০০ শতাংশ বোনাস শেয়ার দেয়। এর আগে বার্জার পেইন্টস ও বাটা সু লভ্যাংশ হিসেবে ১০০ শতাংশ করে বোনাস শেয়ার দেয়। ধারণা করা হচ্ছে, স্বল্প মূলধনের বহুজাতিক অন্য কোম্পানিগুলোও শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ হিসেবে বোনাস শেয়ার দিতে পারে। আর লভ্যাংশ হিসেবে বোনাস শেয়ারের ঘোষণা আসলে শেয়ার মূল্যে বড় ধরনের উত্থান হবে। এ কারণে, বিনিয়োগকারীদের একটি অংশ হয় তো স্বল্প মূলধনের বহুজাতিক কোম্পানির শেয়ার কিনছে। তাই এখনই দাম বাড়া শুরু হয়েছে।

ডিএসইর আরেক সদস্য বলেন, সরকারের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো বড় অঙ্কের মুনাফা করছে। সিংহভাগ শেয়ার হাতে রেখে তারা লভ্যাংশের বড় অংশ বিদেশে নিয়ে যাচ্ছে। ফলে মুনাফার সুফল এ দেশের বিনিয়োগকারীরা খুব একটা পাচ্ছেন না। অপরদিকে খুব সামান্য অংশ শেয়ার সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে থাকাই শেয়ার ক্রয়ের চাপ বাড়লেই হুহু করে এসব কোম্পানির শেয়ার দাম বেড়ে যায়।

ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) সভাপতি শাকিল রিজভী বলেন, বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর লভ্যাংশ ঘোষণার সময় এসেছে। ইতোমধ্যে ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো ভালো লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। এ কারণে বহুজাতিক কোম্পানির প্রতি শেয়ারহোল্ডারদের আগ্রহ আরও বেড়েছে। বর্তমানে কোম্পানিগুলোর শেয়ার দাম বেশি মনে হলেও এতে বিনিয়োগ করা নিরাপদ। কারণ কোম্পানিগুলোর গ্রোথ খুব ভালো। সুতরাং শেয়ার কিনে ধরে রাখলে বিনিয়োগকারীদের লোকসান হবে না।

এমএএস/জেডএ/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।