ভালো কোম্পানি তালিকাভুক্তিতে নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা চালাতে হবে
পুঁজিবাজারের উন্নয়ন করতে হলে ভালো ভালো কোম্পানি তালিকাভুক্ত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে যেসব প্রতিবন্ধকতা আছে তা কাটাতে পদক্ষেপ নিতে হবে। যে ক্ষেত্রে আইনি বাধ্যবাধকতা নেই সে ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ছাড় দিয়ে কোম্পানির সঙ্গে সমঝোতা করতে হবে। পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে এ জন্য নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
রাজধানীর পল্টনে অবস্থিত একটি হোটেলে মঙ্গলবার ‘দীর্ঘমেয়াদী অর্থায়নে শেয়ারবাজারের গুরুত্ব’ শীর্ষক এক সেমিনারে এসব কথা বলেন বক্তারা। ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ডিবিএ) এবং অনলাইন নিউজ পোর্টাল বিজনেস আওয়ার টুয়েন্টিফোর ডটকম যৌথভাবে এ সেমিনারের আয়োজন করে।
ডিবিএ সভাপতি শাকিল রিজভীর সভাপতিত্বে এবং ওমেরা ফুয়েলস লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আক্তার হোসেন সান্নামাতের সঞ্চালনায় সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান খায়রুল হোসেন।
প্রধান বক্তা ছিলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ও বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী।
প্যানেল আলোচক ছিলেন বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) সাবেক সভাপতি মো. ছায়েদুর রহমান ও ক্যাপিটাল মার্কেট জার্নালিস্ট ফোরামের (সিএমজেএফ) সভাপতি হাসান ইমাম রুবেল। সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সাবেক সাধারণ সম্পাদক রাজু আহমেদ।
দেশে সুস্থ পুঁজিবাজার থাকলে বিদেশি বিনিয়োগ আসতে পারে এবং এ বিনিয়োগ কাঙ্ক্ষিত পর্যায় থাকলে তা পুঁজিবাজারের গতি সঞ্চারে সহায়ক হবে উল্লেখ করে মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের নতুন ভালো প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) আনতে হবে। ভালো কোম্পানি কেন আসতে চাই না, সেই প্রতিবন্ধকতা কাটাতে পদক্ষেপ নিতে হবে। যে ক্ষেত্রে তালিকাভুক্তিতে আইনি বাধ্যবাধকতা নেই, সে ক্ষেত্রে সমঝোতাই একমাত্র পন্থা। নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ভালো কোম্পানি আনতে হবে। এ জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা চালাতে হবে। ভালো কোম্পানিকে ভালো প্রিমিয়াম দেয়া যেতে পারে। তবে বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে যে প্রাইসিং হচ্ছে তা অনেক ক্ষেত্রেই যথার্থ না। এ জন্য বিএসইসিকে কিছু পরিবর্তন আনতে হবে।’
বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ছে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘২০০৮-০৯ অর্থবছরে বেসরকারি বিনিয়োগ ছিল ২১ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। এক দশক পর ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৩ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ। অর্থাৎ এক দশকে বেসরকারি বিনিয়াগ মাত্র দুই শতাংশের মতো বেড়েছে। বেসরকারি বিনিয়োগের প্রতিবন্ধকতা দূর করা গেলে তা শেয়ারবাজারেও ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।’
বিএসইসির চেয়ারম্যান খায়রুল হোসেন বলেন, ‘আমরা পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট সবাইকে সঙ্গে নিয়ে এবং অর্থমন্ত্রী ও সাবেক অর্থমন্ত্রী প্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রীকে অন্তর্ভুক্ত করে দীর্ঘস্থায়ী স্থিতিশীল পুঁজিবাজার গড়ে তুলতে কাজ করছি। আইন মেনেই আমরা আইপিও অনুমোদন দেই। কোনো কোম্পানি শেয়ার দাম ধরে রাখতে পারছে, আবার কেউ পারছে না। এক্ষেত্রে আমাদের করার কিছু থাকে না। আইপিওর আগে আমরা কোম্পানি পরিদর্শন করি না, পরিদর্শন করে স্টক এক্সচেঞ্জ ও মার্চেন্ট ব্যাংক।’
মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোকে মানসম্পন্ন আইপিও আনার নির্দেশ দিয়ে তিনি বলেন, ‘আইপিও অনুমোদনের জন্য আবেদন করা কোম্পানির কাছ ব্যাখ্যা চাওয়া হলেও অনেক কোম্পানি ৯ মাস পেরিয়ে গেলেও কোনো জবাব দিচ্ছে না। এতে কোম্পানির আইপিও অনুমোদন আটকে যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে আইপিও আবেদন বাতিল করা হচ্ছে।’
ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, ‘ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে নির্দিষ্ট হারে সুদ দিতে হয়। এমনকি কোম্পানি লোকসান করলেও সুদ পরিশোধ করতেই হবে। কিন্তু পুঁজিবাজার থেকে অর্থ নিলে কোম্পানিকে কোনো সুদ দিতে হয় না। শুধু বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দিলেই হয়। তাও কোনো কোনো বছর না দিলেও চলে। এরপরও খুবই নগন্য একটি অংশ পুঁজিবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহ করছে। সবাই ছুটছে ব্যাংকে।’
তিনি বলেন, ‘তালিকাভুক্ত হলে সব থেকে বড় সুবিধা পাওয়া যায় কর্পোরেট ট্যাক্সে। এত বড় সুবিধা পাওয়ার পরও আমাদের কোম্পানি এ সুযোগ নিচ্ছে না। এর কারণ হলো আইন থাকলেও তার বাস্তবায়ন নেই। ৩৫ শতাংশ কর্পোরেট ট্যাক্সের কথা বলা আছে, কিন্তু এটা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা-তা কেউ খতিয়ে দেখে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘পুঁজিবাজার ভালো করতে হলে ভালো কোম্পানির বিকল্প নেই। গত ৮-১০ বছরে হাতেগোনা দুই-একটি ছাড়া ভালো কোম্পানি পুঁজিবাজারে আসেনি। যতদিন দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়া যাবে, ততদিন মুনষ ব্যাংকে ছুটবে। যখন ব্যাংক থেকে দীর্ঘমেয়াদী ঋণ পাওয়া যাবে না তখন মানুষ আপনা আপনিই পুঁজিবাজারে আসবে।’
শাকিল রিজভী বলেন, ‘ভালো কোম্পানির জন্য দুই-তিন বছরের জন্য একটি পরিকল্পনা নিতে হবে। ভালো কোম্পানি আনতে যে যে সুবিধা দেয়া যায় দিতে হবে। তালিকাভুক্তির ফি প্রথম দুই বছর ছাড় দেয়া যায় কিনা দেখতে হবে। পাশাপাশি আইপিও দীর্ঘসূত্রিতা কমানোর জন পদক্ষেপ নিতে হবে।’
তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়ে সিএমজেএফ সভাপতি হাসান ইমাম রুবেল বলেন, ‘যদি কোনো কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন ৫০ কোটি টাকার উপরে হয়, তাহলে ওই কোম্পানিকে ঋণ নিতে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার বাধ্যবাধকতা আরোপ করা যেতে পারে।’
এমএএস/এনডিএস/জেআইএম