আসছে মুদ্রানীতি : বেসরকারি খাতে ঋণ বাড়ানোই মূল চ্যালেঞ্জ

জাগো নিউজ ডেস্ক
জাগো নিউজ ডেস্ক জাগো নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত: ০২:০৫ পিএম, ২৩ জানুয়ারি ২০১৯

>> চলতি মাসের শেষ সপ্তাহে নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা
>> সম্প্রসারণমূলক মুদ্রানীতি প্রণয়ন করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক
>> কাজে আসেনি সুদহার কামানোসহ বেশকিছু উদ্যোগ
>> সরকারের ঋণ নেয়ার বিষয়টি সমন্বয়ের আহ্বান

কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জনে বাড়াতে হবে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ। বিষয়টি মাথায় রেখে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ বাড়াতে সম্প্রসারণমূলক মুদ্রানীতি প্রণয়ন করতে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সবকিছু ঠিক থাকলে চলতি মাসের শেষ সপ্তাহে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের (জানুয়ারি-জুন) মুদ্রানীতি ঘোষণা করবেন গভর্নর ফজলে কবির।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ তলানিতে রয়েছে। এখন বিনিয়োগ পরিস্থিতি উন্নতি করতে না পারলে চলতি অর্থবছরে সরকার লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারবে না। এমন পরিস্থিতিতে কীভাবে ঋণপ্রবাহ তথা বিনিয়োগের গতি ফেরানো যায়, সে বিষয়টি বেশি গুরুত্ব পাবে মুদ্রানীতিতে।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জনের মধ্যে ভারসাম্য রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতি বছর দু’বার মুদ্রানীতি প্রণয়ন ও প্রকাশ করে। ছয় মাস অন্তর এই মুদ্রানীতি একটি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে অর্থাৎ জুলাই মাসে এবং অন্যটি জানুয়ারি মাসে প্রণয়ন হয়। দেশের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় মুদ্রানীতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে পরবর্তী ছয় মাসে অভ্যন্তরীণ ঋণ, মুদ্রার সরবরাহ, অভ্যন্তরীণ সম্পদ, বৈদেশিক সম্পদ কতটুকু বাড়বে বা কমবে এর একটি পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘মুদ্রানীতিতে নতুন কিছু থাকবে বলে মনে হচ্ছে না। বরাবরের মতো এবারও বাংলাদেশ ব্যাংক বাজেটের প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ধরে মুদ্রানীতি ঘোষণা করবে। বেসরকারি খাতের ঋণের লক্ষ্যমাত্রা আগের মতো ধরা হবে। অর্থাৎ জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশ, মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশ ধরে এর সঙ্গে তিন শতাংশ যোগ করে এবারও সর্বোচ্চ ঋণ প্রবাহ ধরা হচ্ছে। যা আগে ছিল ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ।

তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেসরকারি খাতের ঋণ বাড়ানোর জন্য সুদহার কামানোসহ বেশকিছু উদ্যোগ নেয়। কিন্তু এসব উদ্যোগ কোনো কাজে আসেনি; ঋণ প্রবাহও বাড়েনি। এ থেকে প্রমাণ হয় আমাদের অর্থনীতিতে ঋণ বাড়লে তা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। কিন্তু ঋণের প্রবৃদ্ধি কমলে তা বাড়ানো যায় না।

‘এখন বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ বাড়ানোই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে’ উল্লেখ করে মির্জ্জা আজিজ বলেন, ‘এটি বাড়াতে না পারলে কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব হবে না; একই সঙ্গে কর্মসংস্থানও বাড়বে না।’

বর্তমানে বেসরকারি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অনেক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। এজন্য বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে দীর্ঘমেয়াদের উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি সুশাসন নিশ্চিত করা, অবকাঠামোগত সমস্যার সমাধান, ‘ইজ অব ডুয়িং বিজনেস' বা ব্যবসা সহজীকরণ করতে হবে। এছাড়া নীতিনির্ধারণী বিষয়ে বিভিন্ন ব্যবসাবান্ধব পদক্ষেপ নিতে হবে বলে পরামর্শ দেন প্রবীণ এ অর্থনীতিবিদ।

এদিকে চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধের মুদ্রানীতিতে ডিসেম্বর পর্যন্ত বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন হয় ১৬ দশমিক ৮০ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে, ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বেসরকারি খাতে প্রকৃত ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৩ দশমিক ২০ শতাংশ। যা বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতির লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩ দশমিক ৬০ শতাংশ কম। ডিসেম্বরের প্রবৃদ্ধি গত ৩৯ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগে ২০১৫ সালের অক্টোবরে ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ১৩ দশমিক ২২ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, বেসরকারি খাতের ওপর নির্ভর করে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। ধারাবাহিকভাবে বেসরকারি খাতে ঋণ কমাটা অর্থনীতির জন্য শুভকর নয়। খুব নেতিবাচক। কেননা এ রকম প্রবণতা থাকলে কর্মসংস্থান কমবে। অর্থনীতির অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হবে।

‘বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ কমে যাওয়া মুদ্রানীতির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ’ উল্লেখ করে সালেহ উদ্দিন আরও বলেন, ‘বেশ কয়েকটি কারণে ঋণের প্রবাহ কমছে। প্রথমত, ঋণের চাহিদা কম; আবার হঠাৎ করে কেউ বিনিয়োগে যেতে চাচ্ছে না। এছাড়া আমানত কম, তারল্য সংকটসহ নানা কারণে ব্যাংকাররা এখন ৯ শতাংশ সুদে ঋণ দিতে চাচ্ছেন না। অন্যদিকে, বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যাংকঋণে ঝুঁকছে সরকার। সরকার শুধু ব্যাংক থেকে নয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেও ঋণ নিচ্ছে। সবমিলিয়ে মুদ্রা সরবরাহ এখন সংকোচিত হয়েছে।

তিনি বলেন, এখন চ্যালেঞ্জ নিয়ে বেসরকারি খাতের ঋণ বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে সরকার যেন ঋণ বেশি না নেয় সেই বিষয়টি সমন্বয় করতে হবে। কারণ সরকার বেশি খরচ করলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে।

সাবেক এ গভর্নর আরও বলেন, ঋণের প্রবাহ বাড়াতে হলে ব্যাংকের সেবার মান উন্নত করতে হবে। আমানতের প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে নয়-ছয় করলে চলবে না। নিয়মতান্ত্রিকভাবে সমন্বয় করতে হবে।

এদিকে মুদ্রানীতি প্রণয়নের লক্ষ্যে ইতোমধ্যে দেশের সাবেক অর্থমন্ত্রী, উপদেষ্টা, গভর্নর, ব্যাংকার, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও গবেষকদের মতামত নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কীভাবে ঋণপ্রবাহ বাড়ানো যায় সেই কৌশল নির্ণয়ে বেশি জোর দেয়া হচ্ছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, নির্বাচনের কারণে ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলেন। ফলে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ তথা ঋণপ্রবাহ কমে। এখন নির্বাচন শেষ হয়েছে, প্রেক্ষপটও চেঞ্জ হবে। আশা করছি ঋণপ্রবাহও বাড়বে।

‘এখন বাংলাদেশ ব্যাংক বেসরকারি খাতে ঋণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে যা যা করণীয় তা করবে। এক্ষেত্রে সব ধরনের নীতি সহায়তা দেয়া হবে। চলতি মাসের শেষ সপ্তাহে মুদ্রানীতি ঘোষণা করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, সেখানে ঋণের প্রবাহ বাড়ানোর বিষয়ে নির্দেশনা থাকবে’ বলেও জানান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ কর্মকর্তা।

এর আগে চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর) মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় গভর্নর ফজলে কবির বলেছিলেন, ‘উচ্চতর প্রবৃদ্ধির প্রত্যাশার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ব্যাংক খাতের অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধি আগের অর্থবছরের ১৪.৬ শতাংশের বিপরীতে চলতি অর্থবছরে ১৫.৯ শতাংশ ধরা হয়েছে। এর মধ্যে সরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি ১০.৪ শতাংশ এবং বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১৬.৮ শতাংশ।’

‘সরকারি খাতের ঋণের চাহিদা কম থাকায় বেসরকারি খাতের ঋণে উচ্চতর প্রবৃদ্ধি সংকুলানের সুযোগ থাকবে’ বলেও জানান গভর্নর।

তবে পদ্মা সেতুসহ বিভিন্ন বড় প্রকল্পের কাজ চলমান রাখতে বাড়ছে সরকারের ঋণ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে গত ৩ জানুয়ারি পর্যন্ত ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ নিয়েছে পাঁচ হাজার ১১০ কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে সরকারের মোট ঋণ দাঁড়িয়েছে ৯৩ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা। ডিসেম্বর শেষে যা ছিল ৯২ হাজার ১০৫ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে শেষে ব্যাংকঋণ ছিল ৮৮ হাজার ২৫৮ কোটি টাকা। এ হিসাবে জুনের তুলনায় বেড়েছে পাঁচ হাজার ১১০ কোটি টাকা।

এসআই/এমএআর/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।