ডিএসইর ‘বেতন নৈরাজ্য’ ঠেকাতে পদক্ষেপ নিচ্ছে বিএসইসি
দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) কর্মকর্তাদের ‘বেতন নৈরাজ্য’ ঠেকাতে চাকরির বিধিমালা তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। এ লক্ষ্যে বিএসইসির উপ-পরিচালক আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করে দিয়েছে বিএসইসি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ডিএসইতে কারও বেতন এক লাফে বেড়েছে ৮০ শতাংশের ওপরে। আবার কেউ কেউ আট বছরেও পদোন্নতি পাননি। কেউ আবার নিজের চুক্তিভিত্তিক চাকরি স্থায়ী করে নিয়েছেন। বেতন বৈষম্যের কারণে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষোভ বিরাজ করছে।
এমনকি বেতন বৈষম্যের কারণে এক নারী কর্মকর্তা ডিএসইর প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও) আব্দুল মতিন পাটোয়ারীর সঙ্গে বাগবিতণ্ডায়ও জড়ান। আবার আইন ভেঙে কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দেয়ার প্রতিবাদ করে চাকরি ছাড়েন ডিএসইর হিসাব বিভাগের সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম) মোহাম্মদ ওবায়দুর হাসান।
বিএসইসি সূত্রে জানা গেছে, বেতন বৈষম্য নিয়ে কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ ও অনিয়মের অভিযোগ উঠায় ডিএসইর চাকরি বিধিমালা করে দেয়ার পদক্ষেপ নিয়েছে বিএসইসি। এ লক্ষ্যে আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বে গঠিত বিএসইসির কমিটি ডিএসইর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে দু’দফা বৈঠকও করেছে। বৈঠকে ডিএসইর কর্মকর্তারা বিএসইসির উদ্যোগকে স্বাগত জানান। পাশাপাশি প্রধান অর্থ কর্মকর্তা ও প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তার (সিটিও) পদ দুটি চুক্তিভিক্তিক করার দাবি জানান।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিএসইর একাধিক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, বেতন ও পদোন্নতি নিয়ে ডিএসইতে একপ্রকার ‘নৈরাজ্য’ চলছে। আমরা এর অবসান চাই। আমরা চাই বিএসইসি থেকে আমাদের চাকরির বিধিমালা করে দেয়া হোক। সেই সঙ্গে যারা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছেন, তারা চুক্তিভিত্তিকই থাকবেন। একটি পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়ে, সেই পদ স্থায়ী করে নেয়া অনৈতিক।
যোগাযোগ করা হলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সাইফুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘চাকরির বিধিমালা তৈরির জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি সার্বিক বিষয় খতিয়ে দেখবে। কমিশন আইনের মধ্য থেকে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে।’
এদিকে ডিএসইর একাধিক কর্মকর্তা অভিযোগ করে বলেন, নিয়ম অনুযায়ী ডিএসইর স্থায়ী কর্মকর্তাদের একবারে মোট বেতনের সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়বে। কিন্তু ২০১৭ সালে দুজন কর্মকর্তার বেতন একবারে ৮০ শতাংশের ওপরে বাড়নো হয়। আবার সিএফও ও প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তার (সিটিও) চাকরি চুক্তিভিত্তিক হলেও তারা তা স্থায়ী করে নেন। কতিপয় কর্মকর্তার এমন বাড়তি সুযোগ-সুবিধা প্রদান খরচ কমানোর জন্য ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশন আইনের লঙ্ঘন বলে মন্তব্য করেন তারা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ডিএসইর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কে এ এম মাজেদুর রহমান ও সিএফও আব্দুল মতিন পাটোয়ারীর আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত দুই কর্মকর্তা মোহাম্মদ আসাদুর রহমান ও মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মিয়ার বেতন একবারে ৮০ শতাংশের ওপরে বাড়ানো হয়।
ওই দুই কর্মকর্তার এমন অস্বাভাবিক বেতন বাড়ানোর পাশাপাশি এমডি, সিএফও, সিটিও’র বেতনও বাড়িয়ে নেয়া হয়েছে। এমডি মাজেদুর রহমান নিজের বেতন পাঁচ লাখ টাকা থেকে ২০ শতাংশ বাড়িয়ে ছয় লাখ করে নিয়েছেন। সিএফও আব্দুল মতিন পাটোয়ারী ও সিটিও জিয়াউল করিমের বেতন ২১ শতাংশ বেড়ে চার লাখ থেকে হয়েছে চার লাখ ৮৩ হাজার টাকা।
এর মধ্যে সিএফও ও সিটিও পদ দুটি চুক্তিভিত্তিক থাকায় ওই দুই পদে উচ্চ বেতনে প্রবেশ করেন আব্দুল মতিন পাটোয়ারী ও জিয়াউল করিম। কিন্তু ডিএসইতে যোগদানের পর তারা নিজেদের পদ স্থায়ী করে নেন। তবে পদ দুটি স্থায়ী হলেও বেতন কাঠামো নতুন করে নির্ধারণ করা হয়নি। বরং নতুন করে তারা গ্রাচুইটি, প্রভিডেন্ট ফান্ড, আর্ন লিভ, ওয়ার্কার প্রফিট পার্টিসিপেশন ফান্ড সুবিধা পাচ্ছেন।
ফলে ওই দুই কর্মকর্তা গড়ে প্রতি মাসে যে বেতন পাচ্ছেন, তা এমডির চেয়েও বেশি। সব সুবিধা বিবেচনায় নিলে তাদের প্রতি মাসে গড় বেতন-ভাতা দাঁড়ায় ছয় লাখ ১১ হাজার টাকার ওপর। এদিক বিবেচনা করলে নিচের পদে চাকরি করেও দুই কর্মকর্তা প্রতিষ্ঠানের শীর্ষকর্তা এমডির থেকে প্রতি মাসে গড়ে ১১ হাজার টাকা করে বেশি পাচ্ছেন।
বেতন বৈষম্যের শিকার হয়ে ফৌজিয়া সিদ্দিক নামে এক নারী কর্মকর্তা ডিএসইর প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও) আব্দুল মতিন পাটোয়ারীর সঙ্গে বাগবিতণ্ডায় জড়ান। তার আগে আইন ভেঙে কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দেয়ার প্রতিবাদ করে চাকরি ছাড়েন ডিএসইর হিসাব বিভাগের সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম) মোহাম্মদ ওবায়দুর হাসান।
চাকরি ছাড়ার আগে ওবায়দুর হাসান বিএসইসিতে লিখিত অভিযোগও করেন। ওই অভিযোগে তিনি উল্লেখ করেন, “ডিএসইর ব্যবস্থাপনা পর্ষদ ‘ডিএসই বোর্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেশন রেজুলেশন ২০১৩’ এবং ডিএসই সার্ভিস রুলস’র ৯.১.১ ও ৯.১.২ ধরা লঙ্ঘন করেছে।”
ওবায়দুর হাসান অভিযোগ করেন, ডিএসই সার্ভিস রুলস এর ৯.১.১ ও ৯.১.২ ধরা অনুযায়ী, কর্মকর্তাদের পদোন্নতি হবে বার্ষিক কর্মদক্ষতা মূল্যায়নের ভিত্তিতে। যা বিভাগীয় প্রধানের সুপারিশের ভিত্তিতে ব্যবস্থাপনা পরিচালক অনুমোদন করবেন। কিন্তু সম্প্রতি ব্যবস্থাপনা পর্ষদের কিছু সদস্য কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দেয়ার ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনা পরিচালককে ‘ভোট’ নিতে বাধ্য করেন। ব্যবস্থাপনা পর্ষদের কিছু সদস্যের এমন অবৈধ প্ররোচনায় প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। কর্মকর্তাদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে ‘ভোট’ এর এই পদ্ধতি সমর্থনযোগ্য ও প্রতিপালনযোগ্য নয়।
তিনি বিএসইসিকে জানান, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ‘বোর্ড অ্যান্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেশন রেজুলেশন ২০১৩’ এর ১০ (৫) ধরা অনুযায়ী, স্বাধীন, সঠিক, স্বচ্ছ ও দক্ষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে স্টক এক্সচেঞ্জ পরিচালনা করা ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব। সুতরাং ওই ধরা অনুযায়ী কর্মকর্তাদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে ‘ভোট’ সঠিক ও স্বচ্ছ পদ্ধতি নয়। তালিকাভুক্ত কোম্পানির নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে এমন অনৈতিক কার্যকলাপের উদাহরণ ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশন পরবর্তী ডিএসইর সুনাম ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে।
এদিকে প্রধান অর্থ কর্মকর্তা আব্দুল মতিন পাটোয়ারীর সঙ্গে ফৌজিয়া সিদ্দিক’র বাগবিতণ্ডার একটি অডিও রেকর্ড ছড়িয়ে পড়ে ইউটিউবে। প্রায় ৩০ মিনিটের ওই অডিও রেকর্ডে বেশ উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়। যার অধিকাংশই ছিল বৈষম্যের বিষয়ে সিএফওকে উদ্দেশ্য করে নানা প্রশ্ন। তবে ওই কর্মকর্তা একের পর এক প্রশ্ন করে গেলেও তার উত্তর দিতে ব্যর্থ হন আব্দুল মতিন পাটোয়ারী।
ওই কর্মকর্তা অভিযোগ করে আব্দুল মতিন পাটোয়ারীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘এখানে কাজের মূল্যায়ন হয় না। এখানে বেতন অর্ধেক করে দেবেন আর আমরা কাজ করব! আপনি একজন স্থায়ী চাকরিজীবী। আপনি সর্বোচ্চ বেতনভোগী। আপনার বেতন কত? আপনার বেতন দেড় থেকে দুই লাখ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। অথচ আপনি অনেক বেশি নিচ্ছেন। আপনি তো অনিয়ম করছেন। এ সময় সিএফও বলেন, এটি আমি নিচ্ছি না। আমাকে দেয়া হয়েছে।’
ওই কর্মকর্তা অভিমান করে বলেন, ‘আপনি কন্ট্রিবিউট ছাড়াই টাকা পাচ্ছেন। তাহলে আমরা কাজ করব কেন? আপনি আমাদের মতো পিএফ, ইন্সুরেন্স সুবিধা নিচ্ছেন। আপনি স্যালারি বেশি নিচ্ছেন। আপনার কন্ট্রিবিউশন কী? কেউ কি বলতে পারবেন সিএফও স্যার আসার পর স্টক এক্সচেঞ্জে এই জিনিসটা চেঞ্জ হয়েছে? স্যালারি কমানো ছাড়া আর কিছুই করেননি। আপনি কেন বেশি স্যালারি নিচ্ছেন? আপনি জাতে মাতাল তালে ঠিক। আপনার বেলায় আপনি ষোল আনা।’
এমএএস/এমএআর/আরএস/এমকেএইচ