পুঁজিবাজারে ঝুঁকি বাড়ছে!

সাঈদ শিপন
সাঈদ শিপন সাঈদ শিপন , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১১:১৩ এএম, ১৯ জানুয়ারি ২০১৯

নর্দান জুট ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি লিমিটেড। সর্বশেষ সমাপ্ত হিসাব বছরে (২০১৭ সালের জুলাই থেকে ২০১৮ জুন পর্যন্ত) পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানটি কোনো মুনাফা করতে পারেনি। উল্টো তিন কোটি ৬৭ লাখ টাকা লোকসানে আছে। শেয়ারপ্রতি ১৭ টাকা ১৫ পয়সা লোকসানে থাকায় হিসাব বছরে শেয়ারহোল্ডারদের কোনো লভ্যাংশ দিতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। ফলে স্থান হয়েছে ‘পঁচা’ বা জেড গ্রুপে।

মোটা অঙ্কের লোকসান করা এবং শেয়ারহোল্ডারদের কোনো লভ্যাংশ না দেয়ার পরও নতুন হিসাব বছরে কোম্পানির শেয়ারের দাম বেড়েছে হুহু করে। ১৪ জানুয়ারি লেনদেন শেষে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারের দাম দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৪২৮ টাকায়। অথচ গত বছরের অক্টোবরের শুরুতে এর শেয়ারের দাম ছিল ৩২৫ টাকা। সে হিসেবে সাড়ে তিন মাসে দাম বেড়েছে প্রায় সাড়ে চারগুণ। অর্থাৎ জেড গ্রুপের এ কোম্পানির শেয়ারে এক লাখ টাকা সাড়ে তিস মাস খাটিয়ে প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকা মুনাফা পাওয়া গেছে।

দীর্ঘদিন ধরে লোকসানে নিমজ্জিত এবং জেড গ্রুপে থাকা আরেকটি প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো সিনথেটিক। গত ২ ডিসেম্বর কোম্পানিটির শেয়ারের দাম ছিল পাঁচ টাকা ৮০ পয়সা। সেখান থেকে টানা বেড়ে ৬ জানুয়ারি কোম্পানিটির শেয়ারের দাম ১০ টাকায় উঠে আসে। অর্থাৎ এক মাসের ব্যবধানে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।

অন্যভাবে বলা যায়, যদি কোনো বিনিয়োগকারী ডিসেম্বরের শুরুতে বেক্সিমকো সিনথেটিকের শেয়ারে এক লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন, তাহলে বর্তমানে তার কাছে থাকা শেয়ারের মূল্য এক লাখ ৭২ হাজার টাকা ছাড়িয়ে গেছে। অর্থাৎ এক লাখ টাকা এক মাস খাটিয়েই ৭২ হাজার টাকা মুনাফা পাওয়া গেছে।

শেয়ারের দামে এমন উল্লম্ফন ঘটলেও কোম্পানিটি ২০১২ সালের পর থেকে বিনিয়োগকারীদের কোনো লভ্যাংশ দিতে পারেনি। বরং প্রতি বছরই লোকসানের খাতায় নাম লিখিয়েছে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছে ৮৭ পয়সা। এর আগে ২০১৪ সালে শেয়ারপ্রতি লোকসান হয় ৩১ পয়সা। এছাড়া ২০১৫ সালে ৮১ পয়সা এবং ২০১৬ সালে এক টাকা ১৮ পয়সা শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়। আর ২০১৭ সালে শেয়ারপ্রতি লোকসান হয় দুই টাকা ৬২ পয়সা।

শুধু নর্দান জুট বা বেক্সিমকো সিনথেটিক নয় সম্প্রতি বেশকিছু কোম্পানির শেয়ারের দাম এমন অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। শেয়ারের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ার কারণে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) থেকে বিনিয়োগকারীদের সতর্ক করে বার্তাও প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু এতেও লাভ হচ্ছে না। ঊর্ধ্বমুখী বাজারে বেশকিছু দুর্বল কোম্পানির শেয়ারের দাম হুহু করে বাড়ছে। দুর্বল কোম্পানির শেয়ারের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ায় পুঁজিবাজারে ঝুঁকি সৃষ্টি হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

তারা বলছেন, সম্প্রতি পুঁজিবাজারে যে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা দিয়েছে তা প্রত্যাশিতই ছিল। কিন্তু ভালো মানের কোম্পানির পাশাপাশি কিছু দুর্বল কোম্পানির শেয়ারের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। এসব কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়ার যথাযথ কোনো কারণ নেই। কোনো বিশেষ চক্র পরিকল্পতিভাবে এসব কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়াচ্ছে। এতে অতিরিক্ত মুনাফার লোভে সাধারণ বিনিয়োগকারী তাদের শেয়ার কিনছেন। ফলে ওই বিনিয়োগকারীর পুঁজি যেমন ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে তেমনি বাজারে সৃষ্টি হচ্ছে ঝুঁকি।

অস্বাভাবিকভাবে শেয়ারের দাম বাড়ার কারণে চলতি মাসে ডিএসই থেকে ২২টি কোম্পানির বিষয়ে সতর্কবার্তা প্রকাশ করা হয়েছে। এর মধ্যে ১০টিই জেড গ্রুপের প্রতিষ্ঠান। এগুলো মধ্যে রয়েছে- বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স, মেঘনা কনডেন্সড মিল্ক, ইনফরমেশন সার্ভিসেস, মেঘনা পেট, সাইনপুকুর সিরামিক, নর্দান জুট, বেক্সিমকো সিনথেটিক, এমারেল্ড অয়েল, সাভার রিফ্র্যাক্টরিজ, এরামিট সিমেন্ট ও শ্যামপুর সুগার মিল।

জেড গ্রুপের বাইরে থাকা কোম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে- অ্যাপেক্স ফুডস, প্যারামাউন্ট ইনস্যুরেন্স, নর্দান জেনারেল ইনস্যুরেন্স, সিভিও পেট্রো কেমিক্যাল, অ্যাপোল ইস্পাত, ইউনাইটেড ইনস্যুরেন্স, আলহাজ টেক্সটাইল, বিডিকম, আলিফ মেনুফ্যাকচারিং, শেফার্ড ইন্ডাস্ট্রিজ ও স্ট্যান্ডার্ড ইনস্যুরেন্স।

বছরের পর বছর ধরে বিনিয়োগকারীদের কোনো লভ্যাংশ দেয় না মেঘনা পেট। এমনকি কোম্পানিটির সম্পদ মূল্য ঋণাত্মক অবস্থায় রয়েছে। অর্থাৎ কোম্পানিটির সব সম্পদ বিক্রি করেও দায় পরিশোধ হবে না। এরপর অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম। এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে এর শেয়ারের দাম বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে।

গত ১৭ ডিসেম্বর মেঘনা পেটের শেয়ারের দাম ছিল ১৪ টাকা। যা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে ৮ জানুয়ারি দাঁড়ায় ২৩ টাকা ১০ পয়সায়। অর্থাৎ ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে একজন বিনিয়োগকারী কোম্পানিটির এক লাখ টাকার শেয়ার কিনে ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত ধরে রাখলে মুনাফা করেছেন ৬৫ হাজার টাকা।

শেয়ারের এমন অস্বাভাবিক দাম বাড়া কোম্পানিটি চলতি বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে ব্যবসা করে সাত লাখ ২০ হাজার টাকা লোকসান করেছে। এতে শেয়ারপ্রতি লোকসানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ছয় পয়সা।

ডিএসই বিনিয়োগকারীদের জন্য মেঘনা পেটের ২০১৪ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে শেয়ারপ্রতি আয় এবং শেয়ারপ্রতি সম্পদ মূল্যের তথ্য প্রকাশ করেছে। ওই তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, প্রত্যেক বছরেই কোম্পানিটি লোকসানে রয়েছে এবং সম্পদের মূল্যও ঋণাত্মক।

২০১৪ সালে মেঘনা পেটের শেয়ারপ্রতি লোকসান ছিল ৪৭ পয়সা এবং শেয়ারপ্রতি সম্পদ মূল্য ছিল ঋণাত্মক এক টাকা ৯৯ পয়সা। ২০১৫ সালে শেয়ারপ্রতি লোকসান হয় ৪১ পয়সা এবং শেয়ারপ্রতি সম্পদ মূল্য দাঁড়ায় ঋণাত্মক দুই টাকা ৪০ পয়সা, ২০১৬ সালে শেয়ারপ্রতি লোকসান ৩৯ পয়সা এবং সম্পদ মূল্য ঋণাত্মক দুই টাকা ৮০ পয়সা, ২০১৭ সালে শেয়ারপ্রতি লোকসান ৪০ পয়সা এবং সম্পদ ঋণাত্মক তিন টাকা ২০ পয়সা। আর সর্বশেষ সমাপ্ত হিসাব বছরে শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছে ৩৯ পয়সা এবং শেয়ারপ্রতি সম্পদ মূল্য দাঁড়িয়েছে ঋণাত্মক তিন টাকা ৫৯ পয়সা। এভাবে প্রতি বছরই কোম্পানিটি লোকসান করছে আর সম্পদ মূল্য ঋণাত্মক হওয়ার হার বাড়ছে।

দুর্বল কোম্পানির শেয়ারের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধির বিষয়ে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, দুর্বল কোম্পানির শেয়ারের দাম বৃদ্ধির কারণে বাজারে এক ধরনের ঝুঁকি সৃষ্টি হয়। বিশ্বের কোনো দেশে জেড গ্রুপ বলে কিছু নেই। এখানে জেড গ্রুপ কারার অর্থই হলো এগুলো পঁচা কোম্পানি। এরপরও বিনিয়োগকারীরা সেই কোম্পানির শেয়ার কিনে দাম বাড়ায়। বিনিয়োগকারীদের বাছ-বিচার করে বিনিয়োগ করা উচিত বলে জানান তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড পাবলিক পলিসি বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, কিছু কোম্পানি তো নেই বললেই চলে। কোনো ব্যবসা-বাণিজ্য নেই। প্রশ্ন হলো এগুলো এখনো তালিকাভুক্ত কেন?

‘ফ্রি মার্কেটে বিনিয়োগকারীকে দায়িত্ব নিতে হবে। সে ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীরা জেড গ্রুপের শেয়ারে বিনিয়োগ না করলেই পারে। তারা যদি জাঙ্ক কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করে তাহলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’

ডিএসইর পরিচালক রকিবুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘জেড গ্রুপ, জাঙ্ক গ্রুপ, নন পারফরমেন্স শেয়ারের দাম বাড়লে ভয় লাগে। যেগুলো ভালো শেয়ার, যারা লভ্যাংশ দিচ্ছে, বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) করছে, যাদের স্বচ্ছতা আছে সেই কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়লে ভালো লাগে। কিন্তু সব কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়লে ভয় হয়। বর্তমানে ভালো কোম্পানির সঙ্গে পঁচা কোম্পানির শেয়ারের দাম বেড়ে যাচ্ছে। এতে বাজারে এবং বিনিয়োগকারীদের জন্য ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘ভালো কোম্পানির পাশাপাশি খারাপ কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়ার অর্থ হলো আমরা বিচার-বিশ্লেষণ করে বিনিয়োগ করছি না। তাহলে দেখা যাচ্ছে, এক শ্রেণির বিনিয়োগকারী আছেন তারা এসব শেয়ার নিয়ে খেলাধুলা পছন্দ করেন। তাদেরকে থামাতে হবে। জেড গ্রুপের শেয়ার নিয়ে খেলাধুলা বন্ধ করতে হবে। আর বিনিয়োগকারীদের উচিত হবে মৌলিক শেয়ারে বিনিয়োগ করা।

এমএএস/এএইচ/এমএআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।