নির্বাচন আসলেই বিদেশিদের ‘স্লো-ভাব’

সাঈদ শিপন
সাঈদ শিপন সাঈদ শিপন , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১১:১৩ এএম, ১১ ডিসেম্বর ২০১৮

জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দেশের পুঁজিবাজারে টানা শেয়ার বিক্রির চাপ অব্যাহত রেখেছেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। শেষ দুই মাসে (অক্টোবর ও নভেম্বর) বাজার থেকে বিদেশিরা যে পরিমাণ অর্থের শেয়ার ক্রয় করেন, বিক্রি করেছেন তার চেয়ে বেশি।

শুধু এবারই নয়, জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এর আগেও বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এমন ঘটনা ঘটান। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে ও পরে টানা ১০ মাস বিদেশিরা বাজার থেকে যে পরিমাণ শেয়ার কিনেছিলেন, বিক্রি করেছিলেন এর চেয়ে বেশি।

অবশ্য কিছুটা ব্যতিক্রম ছিল ২০১৪ সালের নির্বাচনের সময়। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ও পরে টানা ৪২ মাস বিদেশিদের শেয়ার বিক্রির থেকে ক্রয় বেশি ছিল। তবে নির্বাচনের আগে ও পরের চার মাস তাদের শেয়ার লেনদেনের পরিমাণ কিছুটা কমে যায়।

নির্বাচন-কেন্দ্রিক বিনিয়োগে এমন স্লো-ভাব প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শান্তিপূর্ণভাবে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে- এমন সংস্কৃতি এখনও আমাদের দেশে গড়ে ওঠেনি। ২০০১ সালের নির্বাচন বাদে অতীতের প্রতিটি নির্বাচনের সময় এক ধরনের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ফলে নির্বাচন আসলেই এক ধরনের অনিশ্চয়তা দেখা যায়। এবারও এর ব্যতিক্রম নয়। ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ নির্বাচনে সব দল অংশগ্রহণের ঘোষণা দিলেও অনিশ্চয়তা এখনও কাটেনি।

তারা বলছেন, নির্বাচন-কেন্দ্রিক অনিশ্চয়তার কারণে সব শ্রেণি ও পেশার মানুষের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্কভাব বিরাজ করে। যার প্রভাব পড়ে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে। দেশি বিনিয়োগকারীরা এখন নতুন করে বিনিয়োগ করছেন না। ফলে বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। পুঁজিবাজারের বিদেশি বিনিয়োগকারীরা তাদের কাছে থাকা শেয়ার বিক্রি করে নিরাপদ অবস্থানে থাকার চেষ্টা করছেন। নির্বাচনের সময় তারা নিজেদের গুটিয়ে নেন, এ কারণে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে স্লো-ভাব পরিলক্ষিত হয়।

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, চলতি বছর বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রির চাপ বাড়ান এপ্রিল মাস থেকে। এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত টানা পাঁচ মাস বিদেশিরা শেয়ার ক্রয় থেকে বিক্রি বেশি করেন। এর মধ্যে এপ্রিলে ক্রয় থেকে বিক্রি বেশি করেন ২৪ কোটি ৬৯ লাখ টাকার শেয়ার। পরের মাস মে-তে ২৮২ কোটি ৩৪ লাখ, জুনে ২০৬ কোটি ৭১ লাখ, জুলাইতে ৩২ কোটি ৭১ লাখ এবং আগস্টে পাঁচ কোটি ৭৫ লাখ টাকার শেয়ার ক্রয় থেকে বিক্রি বেশি ছিল।

টানা পাঁচ মাস শেয়ার বিক্রির চাপ বাড়ানোর পর সেপ্টেম্বরে এসে বিদেশিরা শেয়ার ক্রয়ের পরিমাণ বাড়ান। মাসটিতে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিক্রি থেকে ৩৫ কোটি ১৬ লাখ টাকার শেয়ার বেশি ক্রয় করেন। তবে নির্বাচনের ডামাডোলের ভেতরে অক্টোবরে আবার পাল্টে যাই সেই চিত্র। মাসটিতে বিদেশিদের ক্রয় থেকে বিক্রি বেশি হয় ২০১ কোটি ২৮ লাখ টাকার শেয়ার।

নভেম্বর মাসেও সেই ধারা অব্যাহত ছিল। সদ্য সমাপ্ত মাসটিতে বিদেশিদের শেয়ার ক্রয় থেকে বিক্রি বেশি হয়েছে ২২ কোটি ৫০ লাখ টাকার। এ মাসে বিদেশিরা ৩২৩ কোটি ৮৪ লাখ ৮৫ হাজার ৯৫১ টাকার শেয়ার কেনার বিপরীতে বিক্রি করেন ৩৪৬ কোটি ৩৫ লাখ ১৮ হাজার ৪৪৪ টাকার।

২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাসে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুটি পৃথক জোট করে নির্বাচন করে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৩০টি আসনে এককভাবে জয়ী হয়। তবে ওই নির্বাচনের আগে প্রধান দুই দলের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে বড় ধরনের মতবিরোধ দেখা দেয়। ফলে সামরিক সরকার ২০০৭ সালের শুরুর দিকে জরুরি অবস্থা জারি করে দুই বছর দায়িত্বে থাকে।

রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে ওই সময় পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০০৯ সালের জুন পর্যন্ত টানা ১০ মাস বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নেয় বিদেশিরা।

২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে ২১ কোটি ২০ লাখ, অক্টোবরে ১৫ কোটি ৭৯ লাখ, নভেম্বরে ১২১ কোটি ৭৬ লাখ এবং ডিসেম্বরে ৯৫ কোটি ৯৯ লাখ টাকা শেয়ার ক্রয় থেকে বিক্র বেশি করেন বিদেশিরা। নির্বাচন শেষে ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ১৩ কোটি ৯৮ লাখ, ফেব্রুয়ারিতে ১০৫ কোটি ৬৫ লাখ, মার্চে ১০০ কোটি ২২ লাখ, এপ্রিলে ৬৭ কোটি ৯৬ লাখ, মে-তে ২৩ কোটি ২৮ লাখ এবং জুনে ১২৮ কোটি ৪৮ লাখ টাকার শেয়ার ক্রয় থেকে বিক্রি বেশি করেন।

পরবর্তীতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ না করায় ১৫৪টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থীরা বিজয়ী হন। ৫ জানুয়ারির ওই নির্বাচনের আগে ও পরে দেশজুড়ে ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। তবে বিরোধী পক্ষের জ্বালাও-পোড়াও ও ভাঙচুর কঠোর হাতে দমন করে সরকার। ফলে কিছুদিনের মধ্যেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে।

অতীতের মতো দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দেখা দিলেও সে সময় পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি। নির্বাচনের আগে ও পরে বিদেশিদের বিনিয়োগ উঠিয়ে নেয়ার ঘটনাও সে সময় ঘটেনি। তবে তাদের লেনদেনের পরিমাণ কিছুটা কমে যায়।

দশম সংসদ নির্বাচনের আগের বছর অর্থাৎ ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে বিদেশিদের শেয়ার লেনদেনের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৬০ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। যা এক মাস আগে নভেম্বরে ছিল ৪০৮ কোটি ১৬ লাখ টাকা। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন শেষে ওই মাসেই বিদেশিদের লেনদেন বেড়ে ৫২৭ কোটি ৯৪ লাখ টাকা ছাড়িয়ে যায়। পরের মাস ফেব্রুয়ারিতে বিদেশিদের লেনদেনের পরিমাণ কমে ১৫১ কোটি ৩৩ লাখ টাকায় নেমে আসে। কিন্তু মার্চে তা বেড়ে ৩১৩ কোটি টাকায় পৌঁছে। এপ্রিলে এসে বিদেশিদের লেনদেন এক লাফে বেড়ে হয় এক হাজার ১৮০ কোটি ৭৯ লাখ টাকা।

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় বিদেশি বিনিয়োগে খুব একটা নেতিবাচক প্রভাব না পড়লেও ২০১৫ সালের মার্চ থেকে মে পর্যন্ত টানা তিন মাস বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নেয় বিদেশিরা। এর মধ্যে মার্চে ৩২ কোটি ২৯ লাখ, এপ্রিলে ৬৭ কোটি দুই লাখ এবং মে মাসে ৮৭ কোটি ২৮ লাখ টাকার শেয়ার ক্রয় থেকে বিক্রি বেশি করেন তারা।

বিদেশি বিনিয়োগকারীদের এমন আচরণ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, নির্বাচনের সময় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এক ধরনের অনিশ্চয়তা থাকে। ফলে বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এবারের নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণের ঘোষণা দিলেও অনিশ্চয়তা কাটেনি। যে কারণে দেশি বিনিয়োগকারীরাও খুব একটা বিনিয়োগ করছেন না। এ পরিস্থিতিতে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ তুলে নেবেন- এটাই স্বাভাবিক।

২০১৪ সালের নির্বাচনের সময় বিদেশি বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব না পড়ার কারণ প্রসঙ্গে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ২০১৪ সালের নির্বাচন হয়েছিল একপাক্ষিক। সে সময় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির কিছুটা অবনতি হলেও অনিশ্চয়তার মাত্রা ছিল কম। যে কারণে বিনিয়োগে খুব একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. বখতিয়ার হাসান জাগো নিউজকে বলেন, নির্বাচনে জয় লাভ করে কোন দল সরকার গঠন করবে, তা আগেই নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। ফলে নির্বাচন ঘিরে এক ধরনের অনিশ্চয়তা থাকে। অতীতের নির্বাচনেও এটা দেখা গেছে। এবারও নির্বাচন-কেন্দ্রীক অনিশ্চয়তার কারণে বিনিয়োগে কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। যে কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রির চাপ বাড়িয়েছেন। তবে এটা সাময়িক। এখন শেয়ার বিক্রি করে বিদেশিরা কিছুদিন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবেন। এরপর আশা করা যায়, তারা আবার বিনিয়োগে ফিরে আসবেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড পাবলিক পলিসি বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান জোগো নিউজকে বলেন, নির্বাচনের সময় বিদেশিদের অধিকমাত্রায় শেয়ার বিক্রি এটাই ইঙ্গিত করে যে, তারা নির্বাচন নিয়ে শঙ্কিত। ২০১৪ সালের নির্বাচন একটি অনিশ্চিত পরিস্থির মধ্যে হয়েছে। এবারের নির্বাচন নিয়ে এখনও অনিশ্চয়তা রয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা রাজনৈতিক পরিস্থিতি দেখে পুঁজিবাজারে আসেন, আবার চলে যান। ২০১৫ সালে বিএনপির আন্দোলনের কারণে এক ধরনের অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছিল, ফলে সে সময়ও বিদেশিদের শেয়ার বিক্রির চাপ বেড়ে যায়।

ডিএসই ব্রোকারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) সভাপতি শাকিল রিজভী বলেন, নির্বাচন আসলেই বিদেশিদের শেয়ার বিক্রির চাপ বেড়ে যায়। এর কারণ হতে পারে, তারা মনে করে আমাদের নির্বাচনে কোনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে। ফলে এক ধরনের অনিশ্চয়তার কারণে তারা নতুন করে টাকা বিনিয়োগ করেন না। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এখন শেয়ার বিক্রি করে অপেক্ষা করছেন। নির্বাচনের পর তারা ফের বিনিয়োগ করবেন।

এমএএস/এমএআর/আরএস/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।