ভ্যাট দিচ্ছেন জনগণ, যাচ্ছে কোথায়?
>> নানা কৌশলে ভ্যাট ফাঁকি দিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা
>> হয়রানি ও ভীতি দূর করার তাগিদ
>> ভ্যাট ফাঁকি প্রতিরোধে আনা হচ্ছে নতুন মেশিন
>> ফাঁকি প্রতিরোধে জোর দিচ্ছে এনবিআর
মূল্য সংযোজন কর বা মূসক একটি পরোক্ষ কর, যা ভোক্তার নিকট হতে আদায়যোগ্য। রাজস্ব আদায়ে এটি একটি সহজ পন্থা। দেশে গত কয়েক বছরে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যাপক হারে বেড়েছে। কিন্তু সে হারে ভ্যাট আদায়ের হার বাড়েনি।
অভিযোগ উঠেছে, জনগণ যে ভ্যাট দেয় তার বড় অংশ যাচ্ছে ব্যবসায়ীদের পকেটে। বিভিন্নভাবে ভ্যাট আদায় হয়। এর মধ্যে বড় অংশই আদায় হয় ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে। জনগণ সেবা বা পণ্য নিতে গিয়ে ভ্যাটের টাকা দেন ব্যবসায়ীদের হাতে। সে টাকা সরকারের কোষাগারে জমা হওয়ার কথা। বাস্তবে তারা পুরো অংশ জমা দেয় না। ভ্যাট কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীদের যোগসাজশে জনগণের দেয়া ভ্যাটের একটি অংশ চলে যাচ্ছে তাদের পকেটে। ফলে রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।
আরও পড়ুন >> ‘অডিট হয়রানি’ আয়কর বৃদ্ধিতে বড় প্রতিবন্ধকতা
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্র জানায়, ১৯৯১-৯২ অর্থবছরে ভ্যাট আদায় করা হয় এক হাজার ৭৩৫ কোটি টাকা। আয়কর আদায় হয় এক হাজার ২৯৪ কোটি টাকা। এরপর থেকে ভ্যাটের ওপর নির্ভরশীলতা বেড়েছে।
২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রার ৩৭ দশমিক ৮০ শতাংশ ভ্যাট খাতে আদায়ের প্রাক্কলন করা হয়েছে। দেশে ১৯৯১ সালে ভ্যাট ব্যবস্থা প্রবর্তনের পর আশানুরূপ বাড়েনি ভ্যাটের পরিধি। ঘুরেফিরে একই ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান নিয়মিত ভ্যাট দিচ্ছে। নতুনরা খুব একটা যোগ হয়নি।
তথ্য অনুসারে, বর্তমানে দেশে নিবন্ধিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা আট লাখের বেশি। কিন্তু ভ্যাট দিচ্ছে মাত্র ৬০ হাজার প্রতিষ্ঠান। খোদ এনবিআর বলছে, ভ্যাট ফাঁকি হচ্ছে এটা ঠিক। ছোট-বড় অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান ভ্যাট ফাঁকি দিচ্ছে। তবে কর ফাঁকি রোধে পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে, অভিযান জোরদার করা হচ্ছে। আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তা নেয়া হচ্ছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কর ফাঁকি সংক্রান্ত বহু তথ্য এনবিআরের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলো থেকে সরকার অনলাইনে ভ্যাটের টাকা আদায় করে। তারপরও তাদের বিরুদ্ধে ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগ রয়েছে। এমনকী ব্যাংকের বিরুদ্ধেও ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগ রয়েছে।
এনবিআরের সাম্প্রতিক সময়ের এক অনুসন্ধানে দেশের বড় বড় ৬২ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ভ্যাট ফাঁকির তথ্য উদঘাটিত হয়েছে। এতে দেখা গেছে, মোবাইল কোম্পানি, সরকারি প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি শিল্প খাত, ব্যাংক-বীমা প্রভৃতি খাতের প্রতিষ্ঠান সব মিলিয়ে ভ্যাট ফাঁকি দিচ্ছে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর জাগো নিউজকে বলেন, ‘কর ব্যবস্থা আধুনিকায়নের ওপর জোর দিতে হবে। কর ফাঁকির প্রতিকার না করে প্রতিরোধে গুরুত্বারোপ করতে হবে। এটা হলে হয়রানি কমবে। একই সঙ্গে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়বে। তাই হয়রানি ও দুর্নীতি রোধে কর ব্যবস্থা অটোমেশনের বিকল্প নেই।’
আরও পড়ুন >> মেলার পঞ্চম দিনে ২৯০ কোটি টাকার রাজস্ব
তিনি আরও বলেন, ‘অনেকে কর ফাঁকি দিয়ে পার পেয়ে যান। আবার অনেকে ধরা খেলেও এনবিআরের দাবিকৃত অর্থ পরিশোধ না করে আদালতে মামলা করেন। সে মামলা নিষ্পত্তি হতে বছরের পর বছর সময় লাগে। এ সংস্কৃতি বাতিলের ব্যবস্থা করতে হবে।’
জানা গেছে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আয়কর, শুল্ক ও মূসক অনুবিভাগের বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ২১ হাজার ৩৯৭টি। এর মধ্যে আয়কর সংক্রান্ত চার হাজার ৪৪টি, ভ্যাট সংক্রান্ত তিন হাজার ৪৩২টি এবং শুল্ক সংক্রান্ত ১৩ হাজার ৯১০টি মামলা বিচারাধীন।
বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর সঙ্গে সঙ্গে দেশীয় কোম্পানিগুলোর রাজস্ব ফাঁকি দেয়ার প্রবণতা বাড়ছে। ভ্যাট ফাঁকি দিচ্ছে ছোট ও খুচরা ব্যবসায়ীরাও। খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সরকার ভ্যাট আদায় করে প্যাকেজভিত্তিতে।
বাস্তবে প্যাকেজের চেয়ে বেশি ভ্যাট জনগণের কাছ থেকে আদায় করে ব্যবসায়ীরা। বড় ও মাঝারি আকারের শো-রুমগুলো থেকে সরকার ইসিআর মেশিন স্থাপনের মাধ্যমে ভ্যাট আদায় করে। ব্যবসায়ীরা অনেক লেনদেনের তথ্য ওই মেশিন থেকে ফেলে দিয়ে ভ্যাটের টাকা আত্মসাৎ করে। অনলাইনে যেসব ভ্যাট আদায় হয় সেগুলোরও অনেক তথ্য মুছে ফেলছে তারা। ফলে এসব ভ্যাট সরকারের কোষাগারে যাচ্ছে না।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে ২৫ লাখের ওপর দোকান আছে। কিন্তু ভ্যাট দেন মাত্র ৬০ হাজার দোকান মালিক। এ ভ্যাট ফাঁকি বন্ধে সারাদেশের সব দোকানে ইলেকট্রনিক ক্যাশ রেজিস্ট্রার (ইসিআর) ও পয়েন্ট অব সেল (পিওএস) মেশিন স্থাপনের মাধ্যমে পণ্য বিক্রি বাধ্যতামূলক করেছে সরকার। কিন্তু সবাই সেটা বসায়নি। যারা বসিয়েছে তারাও নানা কৌশলে ভ্যাট ফাঁকি দিচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দীন বলেন, ব্যবসায়ীরা ভ্যাট ফাঁকি দেয়- এ কথা সবসময় ঠিক নয়। দেশে যে পরিমাণ রাজস্ব আদায় হচ্ছে তার সিংহভাগ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে আসছে।
আরও পড়ুন >> ধুঁকছে আর্থিক খাত
তিনি বলেন, অনেকে হয়রানির ভয়ে নিবন্ধন নেন না। নিলেও ভ্যাট পরিশোধ করেন না। এজন্য হয়রানি বা ভীতিকর পরিবেশ দূর করতে হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ভ্যাট পরিশোধে কিছুটা মিসিং হতেই পারে। তবে অনেক দুষ্টু ব্যবসায়ী আছেন, যারা ইচ্ছা করে ভ্যাট ফাঁকি দেন। আমি বলবো, এসব অসৎ ব্যবসায়ীদের পক্ষে আমরা নেই। এনবিআর যেন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়।’
‘তবে অহেতুক যেন কোনো ব্যবসায়ীকে হয়রানি করা না হয়, সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে’- যোগ করেন তিনি।
ভ্যাট ফাঁকি রোধে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াচ্ছে এনবিআর। এছাড়া বড় বড় কর ফাঁকিবাজদের বিষয়েও তদারকি বাড়ানো হয়েছে। বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ভ্যাট ফাঁকি প্রতিরোধে ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) নামে মেশিন বসানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ মেশিনগুলো বিদ্যমান ইলেকট্রনিক ক্যাশ রেজিস্ট্রারের (ইসিআর) পরিবর্তে ব্যবহার করতে হবে।
জানতে চাইলে এনবিআর সদস্য (ভ্যাটনীতি) রেজাউল হাসান বলেন, ‘কর ফাঁকি রোধে ইসিআর বসানো হয়েছিল। কিন্তু এতে চুরির সুযোগ থাকায় সেগুলোর পরিবর্তে ইএফডি বসানো হচ্ছে। এগুলো বসানো হয়ে গেলে খুচরা প্রতিষ্ঠানগুলো আর ভ্যাট ফাঁকি দিতে পারবে না।’
‘ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য আধুনিক মেশিন বসানো হলেও বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর বিষয়ে ভাবতে হবে’ বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, জনগণ ভ্যাট দেয় ঠিকই, কিন্তু যারা ভ্যাট আদায় করেন তাদেরকে আরও সক্রিয় হতে হবে। প্রযুক্তির ব্যবহার ও কর্মকর্তাদের দক্ষতা বাড়ানোর বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে। অসাধু কর্মকর্তাদের বিষয়েও কঠোর হতে হবে।
আরও পড়ুন >> কর ব্যবস্থায় দুর্নীতি রয়েছে : মত ৬৫ শতাংশ মানুষের
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এনবিআর চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, ‘আমরা ভ্যাট ফাঁকি প্রতিরোধে উদ্যোগ নিচ্ছি। এজন্য খুচরা পর্যায়ে আধুনিক প্রযুক্তি-সম্পন্ন মেশিন বসানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। আর বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো যেন ভ্যাট ফাঁকি দিতে না পারে সেজন্য নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে। এর বাইরে কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণও দেয়া হচ্ছে, দক্ষ করে গড়ে তোলা হচ্ছে।’
এক প্রশ্নে জবাবে তিনি বলেন, ‘অভিযান চালানো হবে ঠিকই, কিন্তু কোনো ব্যবসায়ীকে যেন অহেতুক হয়রানি করা না হয়, সে বিষয়টিও নিশ্চিত করা হবে। কেউ অহেতুক হয়রানি করলে তাকে ছাড় দেয়া হবে না।’
এমএ/এমএআর/আরআইপি