কর ব্যবস্থায় দুর্নীতি রয়েছে : মত ৬৫ শতাংশ মানুষের
>> করদাতা বাড়াতে ঢাকার ফ্ল্যাট বাসায় খোঁজ-খবর নেয়া হচ্ছে
>> বিনিয়োগ বাড়াতে কার্যকর সংসদ ও আইনের শাসন জরুরি
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) জানিয়েছে, ৬৫ শতাংশ মানুষ মনে করে, এনবিআরের কর ব্যবস্থায় দুর্নীতি রয়েছে।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর স্থানীয় একটি হোটেলে সিপিডি আয়োজিত সংলাপে এই তথ্য জানানো হয়।
অনুষ্ঠানে দুটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান এবং সিনিয়র রিসার্স ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান। তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, কর ব্যবস্থা নিয়ে এক হাজার মানুষের মধ্যে জরিপ চালিয়েছে সিপিডি। এর মধ্যে ৩২ শতাংশ মানুষ আয় কর দিচ্ছে।
জরিপে মতামত দেয়া ৬৫ শতাংশ মানুষ মনে করে, এনবিআরের কর ব্যবস্থায় দুর্নীতি রয়েছে। ৫০ শতাংশ মানুষ মনে করে, এনবিআরের কর ব্যবস্থা অত্যন্ত জটিল। উচ্চ আয়ের ২৫ শতাংশ মানুষের এক তৃতীয়াংশ গত বছর আয়কর দেয়নি। যারা দিয়েছেন, তারাও পুরোপুরি দেননি। কর ফাঁকি দিয়েছেন।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, কর আদায় বাড়ানোর চেষ্টা করছে এনবিআর। এর অংশই করদাতা বাড়াতে ঢাকার ফ্ল্যাট বাসায় খোঁজ-খবর নেয়া হচ্ছে। অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন সিপিডির সম্মানিত ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, ড. মোস্তাফিজুর রহমান, বাংলাদেশে নিযুক্ত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) আবাসিক প্রতিনিধি রাগনার গুডমান্ডসন এবং মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) সভাপতি নিহাদ কবির।
জরিপে দেখানো হয়, ৭৫ শতাংশ মানুষ মনে করেন, কর ব্যবস্থায় ধনী-গরিবের মধ্যে পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করা হয়। ৫ শতাংশ মানুষ মনে করেন, এনবিআরের সেবা ও তার গুণগতমান বাড়ালে জনগণ কর দিতে উৎসাহিত হবে।
সিপিডির সুপারিশে বলা হয়, কর অফিসকে একটি দুর্নীতিমুক্ত প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করে মানুষের মধ্যে আস্থা বাড়াতে হবে। পাশাপাশি ধনী অথচ কর ফাঁকি দেন এমন ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনতে হবে। সমতাভিক্তিক কর ব্যবস্থা বিকশিত করা জরুরি। এক্ষেত্রে অধিকতর ন্যায্য এবং আধুনিক সম্পত্তি ও সম্পদ কর চালু করতে হবে।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য দেশে সুশাসন জরুরি। তিনি বলেন, সামগ্রিকভাবে দেশে সুশাসন নেই, বিচারহীনতার সংস্কৃতি চলছে। অপরাধীদের দায়মুক্তি দেয়া হচ্ছে, সেখানে এনবিআর চেয়ারম্যান রাজস্ব খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারেন না।
তিনি বলেন, বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিকে করছাড় দেয়া হয়। এছাড়া কেউ অপরাধ করেও শাস্তি পায় না।
রাগনার গুডমান্ডসন বলেন, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) বিপরীতে বাংলাদেশে কর আদায় একেবারে কম। জিডিপির অনুপাতে মাত্র ৯ শতাংশ কর আদায় হয়। দক্ষিণ এশিয়াতে এটি সর্বনিম্ন। ফলে কর আদায় বাড়াতে হবে।
মির্জ্জা আজিজ বলেন, সরকার ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির কথা বলছে। কিন্তু দেশে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়েনি। আবার লেবার সার্ভে রিপোর্ট বলছে, কর্মসংস্থান বেড়েছে। ফলে এর সঙ্গে অর্থনীতির স্বাভাবিক হিসাবের মিল পাওয়া যায় না।
তিনি বলেন, কর আদায়ে বড় ধরনের দুর্বলতা রয়েছে। কারণ ২০১৭ সালে নেপালের মাথাপিছু আয় ছিল এক হাজার ৩৩০ মার্কিন ডলার। কর আদায় জিডিপির ১০ শতাংশের কম। কিন্তু আলোচ্য সময়ে নেপালের মাথাপিছু আয় ছিল ৭৩০ মার্কিন ডলার। আর কর আদায় হয়েছে জিডিপির ২৪ শতাংশ। অর্থাৎ কম আয় করেও তারা বেশি কর আদায় করতে পারছে। ফলে এখানে নজর দিতে হবে। বিশেষ করে কর আদায়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়াতে হবে। এ সময়ে কর নীতি ও কাঠামোয় পরিবর্তন আনার সুপারিশ করেন তিনি।
এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, সরকারের বাজেটের লক্ষ্য পূরণে করের আওতা বাড়াতে এনবিআর এই পরিকল্পনা নিয়েছে। প্রতি বছর সরকারের বাজেটের আকার বাড়ছে। এজন্য করের আওতা বাড়াতে হচ্ছে। তাই করের আওতা বাড়ানোর একটি পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। তা হচ্ছে, ঢাকা শহরের যত ফ্ল্যাট ও বাড়ি আছে, এগুলো জরিপ করা। এই ফ্ল্যাট ও বাড়ির মধ্যে থাকা ভাড়াটে ও ফ্ল্যাটের মালিকদের সবাইকে রিটার্নের মাধ্যমে আগামী ছয় মাসের মধ্যে আওতায় নিয়ে আসা হবে। এজন্য একটি টিম কাজ করছে। পাশাপাশি ঢাকার বাইরে অফিসগুলো উপজেলা পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হবে। উপজেলার ব্যবসায়ী, জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় লোকজনকে করের আওতায় আনা হবে।
তিনি বলেন, সরকার কাস্টমস, ভ্যাট ও ট্যাক্স- এই তিনটি সোর্স থেকে রাজস্ব আহরণ করে। কিন্তু বিশ্বায়নের ফলে আগামীতে কাস্টমস ডিউটি কমবে। তাই ইনকাম ট্যাক্সকে গুরুত্ব দিতে হবে। আর করের আওতা বাড়ানোর জন্য রিটার্নধারীদের সংখ্যা বাড়াতে হবে।
মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, সারাদেশে এখন ই-টিনের সংখ্যা ৩৫ লাখের বেশি। কিন্তু তার মধ্যে ২০ লাখ রিটার্ন দিচ্ছে না। অন্যতম কারণ কর নিয়ে এক ধরনের ভয় আছে। তাই করদাতাবান্ধব এনবিআর গড়ে তোলার চেষ্টা করছি।
তিনি বলেন, এর মধ্যে ট্যাক্সে যারা আছে তাদের প্রশিক্ষিত করা, মোটিভেট করা এবং জনবল বৃদ্ধির জন্য সরকারের কাছে আবেদন করেছি। আশা করি এর সুফল পাওয়া যাবে।
তিনি আরও বলেন, এনবিআরের কর্মকর্তারা আমাকে সহায়তা করছে। কিন্তু দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর মেম্বরদের একেবারে বের করে দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।
এসআই/এমএ/এমএআর/এমএস